নীলা-বিউটি বোন ডাকে ‘সাত ভাই’ ছুটে আয়

কিশোরী নীলা রায় হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত তরুণ মিজানুর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

আচমকা এমন ঘটনা ঘটে, মনে হয় যেন ভয়ংকর অলীক জগতে আছি। বাস্তবের সঙ্গে যেন এর কোনো মিলই নেই। আঁধার রাতে রূপকথার রাজ্যে রাক্ষস এসে হানা দেয়, বেঘোরে প্রাণ যায় নাদান প্রজার। দেখার কেউ থাকে না। গত রোববার রাতে সাভারের পৌর এলাকায় মিজান নামের এক বখাটের জিঘাংসার বলি হলো নীলা নামের কিশোরী। এ যেন রূপকথার সেই রাক্ষসেরই নির্বিচারে প্রাণসংহারের ঘটনা।

নীলা রায় তার ভাই অলকের সঙ্গে রিকশায় করে হাসপাতালে যাচ্ছিল। মেয়েটির তখন প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট। দমটা স্বাভাবিকভাবে নিতে না পারলে যে কী অবর্ণনীয় যন্ত্রণা, এই করোনাকালে তা দেখা যাচ্ছে দেদার। অসুস্থতার মধ্যেই রিকশা থেকে মেয়েটিকে অস্ত্রের মুখে টেনেহিঁচড়ে নামাল মিজান। খানিক দূরে নিয়ে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে বুঝিয়ে দিল প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দিলে কী হয়। নির্বিঘ্নে হত্যাকাণ্ড সেরে সদর্পে পালিয়ে গেল সে। পেছনে রেখে গেল বিরাট ধাঁধা। রাজধানীর উপকণ্ঠে থাকা সাভার সভ্য দুনিয়ার কোনো পৌর শহর না, না কোনো যুদ্ধাক্রান্ত জনপদ?

শৈশবের যেসব স্মৃতি দীঘল কালো পেরেকের মতো মনের ভেতর আমূল গেঁথে আছে, এর মধ্যে পাঠ্যবইয়ের একটি লেখা রয়েছে। সেটা ‘অনেক অনেক দিন আগের কথা’ ধাঁচের লেখা। পুরোটা মনে নেই। শুধু মনে আছে যে আরব দেশে প্রাচীন যুগে কন্যাসন্তানকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলা হতো। আমার ছোট বোনটি তখন মায়ের কোলে, মোটে কয়েক মাস বয়স। ঘুরেফিরে ওর মায়াভরা মুখটাই চোখের সামনে বারবার উঁকি দিতে লাগল। কষ্টের সাগরে হাবুডুবু খাই আর আড়ালে চোখের জল মুছি। কী যে একটা অবস্থা!

বখাটে মিজানের হত্যাকাণ্ড প্রাচীন যুগের সেই বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। সে যুগে মানুষ কুসংস্কারে অন্ধ ছিল বলে যা খুশি তা–ই করেছে। কিন্তু মিজান কলেজছাত্র। বিদ্যা যা–ই থাকুক, আছে। কেবল নেই মানবতাবোধ। নীলার কাছে যে প্রেম সে নিয়ে গিয়েছিল, এতে ছিল না প্রেমের চিরন্তন মাধুর্য, ছিল নিছক উদগ্র কামনা। এ আগুন একবার জ্বললে নেভানো তার নিজেরই দায়। কিন্তু নিজেকে সংযত না করে সে হামলে পড়ল মেয়েটির ওপর। পরিণতিতে নেমে আসে অনিবার্য ধ্বংস। মেয়েটি মারা গেছে, আর বিচারের জন্য মিজান এখন আটক।

ঘটনার সেলুলয়েড ফিতা পেছনে টানলে বখাটে কিশোর–যুবার কারণে মৃত্যুর শিকার হওয়া এমন অনেক নীলার সন্ধান পাওয়া যাবে। ১০ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে আসে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার কিশোরী বিউটি মণ্ডলের আত্মহত্যার ঘটনা। বিউটির মুখের ছবি ফটোশপ করে আপত্তিকর মিথ্যা ছবি বানানো হয়। তারপর একটি ফেসবুক আইডি থেকে পোস্ট করা হয় সে ছবি। এর সঙ্গে ছিল আপত্তিকর কথা ও ফোন নম্বর। রাগে–দুঃখে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। গতকাল সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। কী সাংঘাতিক!

আমাদের দেশে মেয়েরা যে তথাকথিত অবলা বা বিদ্যাবুদ্ধিতে দুর্বল, তা বলা যাবে না। বরং কিছু ক্ষেত্রে যোগ্যতার প্রমাণ রেখে পুরুষের চেয়ে নারী অনেক এগিয়ে। প্রশাসন ও পুলিশ থেকে শুরু করে দেশের নানা পর্যায়ে নারী এখন নেতৃত্বের আসনে থেকে সুনাম অর্জন করছেন। এমনকি খেলাধুলায়ও মোটের ওপর পুরুষের চেয়ে নারীর অর্জন এখন বেশি। এরপরও কিছু ক্ষেত্রে যেন নারী বেগম রোকেয়ার সেই ‘অবরোধবাসিনী’র মতো আটকে আছেন।

বেশির ভাগ সচ্ছল ঘরে কন্যাসন্তান বড় হয় আদরে। তাদের কারও নাম নীলা, কারও–বা বিউটি, কারও–বা অন্য কোনো মিষ্টিমধুর নাম। মায়ের, ভাইয়ের, বাবার সোহাগে নির্ভাবনায় বেড়ে উঠতে থাকে তারা। তাদের রাঙা পায়ে যখন নূপুর বাজে, পুরো ঘরটাই যেন ঝুমুর ঝুমুর নাচে। কিন্তু কিছুদিন পর এই পা দুটো যখন বাইরে যেতে শুরু করে, ধীরে ধীরে মা-বাবার হাসিও মিলিয়ে যেতে থাকে। আর পাড়া বা মহল্লায় যদি বখাটে দু-চারজন থাকে, তাহলে তো রাতের ঘুম হারাম। যেমনটি ঘটেছে নীলার বেলায়।

সংবাদমাধ্যমে নীলার মা মুক্তি রায় বলেন, মিজানের বখাটেপনার বিষয়টা তার মা-বাবাকে জানানোর পরও তাঁরা গা করেননি। বরং মিজানের ইচ্ছা অনুযায়ী ফেসবুকে তার সঙ্গে নীলাকে চ্যাট করতে বলেছেন। এঁরা কেমন মা-বাবা? মিজানের খপ্পর থেকে রক্ষা পেতে একপর্যায়ে নীলার পরিবার মানিকগঞ্জ চলে যায় বলে জানান মুক্তি রায়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। কয়েক মাস পর ছেলেমেয়ের পড়াশোনার জন্য আবার ফিরে আসতে হয়েছে সাভারে। তারপর কী ঘটল, সে তো সবারই জানা।

এর মধ্যে সংবাদমাধ্যমে এসেছে যে সাভারে নীলাদের ওই এলাকায় বখাটেদের উৎপাতের বিষয়টি স্থানীয় মেয়র ও পুলিশের জানা আছে। এ ব্যাপারে মেয়র বিবৃতিও দিয়েছেন। সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, মেয়র ও পুলিশের বিষয়টা জানা থাকলে এ ঘটনা ঘটে কী করে?

কিশোরী বিউটির বাবা নিতাই মণ্ডলের অভিযোগ, মেয়ের ছবি বিকৃত করে ফেসবুকে ফোন নম্বরসহ ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি ৭ সেপ্টেম্বর তিনি থানায় লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। পুলিশ ব্যবস্থা নিলে হয়তো এমন পরিণতি হতো না।

এখানে রোমানিয়ায় এক কিশোরীকে অপহরণ করে হত্যার ঘটনা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যায়। বিবিসি অনলাইনের খবরে জানানো হয়, আলেকজান্দ্রা মাসেসানুকে (১৫) গত ১৪ জুলাই অপহরণের পর হত্যা করা হয়। দেশটির জরুরি সেবায় তিনবার ফোন করেও সাহায্য পায়নি মাসেসানু। ঘটনাটি জানাজানি হলে দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশপ্রধান তো পদত্যাগ করলেনই, শিক্ষামন্ত্রীকেও বরখাস্ত করা হয়।

কোনো দেশে আইনি ব্যবস্থা দুর্বল হলে সেখানে জনসচেতনতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে, রোমানিয়ার ঘটনাটি এর উজ্জ্বল উদাহরণ। বাংলাদেশ সেখান থেকে অনেক দূরে।

এখনকার বেশির ভাগ কিশোর–যুবা পড়ে থাকে ফেসবুকে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই এর যাত্রা শুরু। গভীর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগপর্যন্ত তা চলে। যুগের চাহিদা অনুযায়ী ফেসবুক নিঃসন্দেহে সামাজিক যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। একই সঙ্গে এর নেতিবাচক প্রভাবও কম নয়। উদাহরণ টেনে কুলানো যাবে না।

বখাটেরা সংখ্যায় যতই হোক, একটা মহল্লা বা পাড়ার জোটবদ্ধ তরুণ-যুবার চেয়ে তো বড় কিছু নয়। এমন নয় যে বখাটেদের বিরুদ্ধে হাতাহাতি করতে হবে, লাঠি নিয়ে লড়তে হবে। করতে হবে সবাই মিলে প্রতিবাদ। নীলা বা বিউটির মতো ‘পারুল’ বোনদের জন্য তারা হবে সাত ভাই চম্পা।

শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

[email protected]