নুরুল হক ও সরকারের আরাধ্য ‘দায়িত্বশীল বিরোধী দল’

নুরুল হক গঠন করেছিলেন ছাত্র অধিকার পরিষদ। তারই পরিণত ফল হিসেবে গঠিত হলো গণ অধিকার পরিষদ।
ছবি: প্রথম আলো

ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে নুরুল হকের নাম যখন ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন ক্যাম্পাসে নূরবিরোধীদের অনেকেই তাঁকে ‘ভুয়া!’ বলে তাচ্ছিল্য করেছিলেন। পাঁচ বছর বয়সে মাকে হারিয়ে পটুয়াখালীর প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা সেই হতদরিদ্র ‘ভুয়া’ নুরুল শেষ পর্যন্ত ভিপি হলেন। সবশেষে জাতীয় পর্যায়ের নেতাও হয়ে গেলেন।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবি’ উপন্যাসের ‘চোর–ডাকাতের বংশের ছেলে’ নিতাইচরণ যেমন আচমকা ‘কবি হইয়া গেল’, নূরের আত্মপ্রকাশে ততটা তাৎক্ষণিকতাসঞ্জাত আকস্মিকতা না থাকলেও বাংলাদেশের রাজননৈতিক বাস্তবতায় তা দস্তুরমতো বিস্ময়কর ঘটনা বটে।

‘সৎপাত্র’ গঙ্গারামের শিক্ষাগত যোগ্যতার বর্ণনা দিতে গিয়ে সুকুমার রায় বলেছিলেন, ‘উনিশটি বার ম্যাট্রিকে সে/ ঘায়েল হয়ে থামল শেষে’। কিন্তু রাজনীতির নুরুল হক আক্ষরিক অর্থে ‘উনিশটি বার’ বেদম মার এবং ১৭টি মামলা খেয়েও ঘায়েল হননি। তিনি শেষ পর্যন্ত রীতিমতো একটি রাজনৈতিক দল খুলে বসলেন। দলটির নাম ‘গণ অধিকার পরিষদ’।

কবি হিসেবে নিতাইচরণের অভাবিত আত্মপ্রকাশে তার বন্ধু রাজালাল বায়েনের শ্যালিকার বিস্ময়ের ঘোর না কাটার কারণ বর্ণনায় তারাশঙ্করের ব্যাখ্যা ছিল, ‘যে মানুষকে মানুষ চেনে তাহার মধ্যে অকস্মাৎ এক অপরিচিতজনকে আত্মপ্রকাশ করিতে দেখিলে বিস্ময়ে সে এমনই হতবাক হইয়া যায়।’ নুরুল হকের রাজনৈতিক আবির্ভাবের বিষয়ে এই ব্যাখ্যা অনেকখানি প্রাসঙ্গিক। নুরুল হকের অতি সাধারণ জায়গা থেকে মূলধারার রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আসাকে চেনা মানুষের মধ্যে ‘অপরিচিতজনের আত্মপ্রকাশ’ বললে অত্যুক্তি হয় না।

এ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের সুদীর্ঘ লালিত ঐতিহ্য অনুসারে নেতার সন্তান নেতা হয়ে আসছেন। কোনো সাংসদ মারা গেলে সেই আসনের উপনির্বাচনে তাঁর সন্তান কিংবা স্ত্রী বা ভাই—কেউ একজন দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। একটা বংশপরম্পরা অলিখিতভাবে রাজনৈতিক মাঠের ইজারাদারি নিয়ে বসে আছে।

আমার ছেলে বা মেয়ে বড় হয়ে ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে, শিল্পী হবে, বিজ্ঞানী হবে, শিক্ষাবিদ হবে, ব্যারিস্টার হবে—এমন স্বপ্ন আমরা দেখতে পারি। সেই স্বপ্নের কথা বুক ফুলিয়ে কাউকে বলতেও পারি। কিন্তু আমার সন্তান বড় হয়ে রাজনীতি করবে এবং এই দেশের প্রধানমন্ত্রী হবে—এই কথা আজ পর্যন্ত কাউকে বলতে শুনিনি।

সেই স্বপ্ন দেখা বা এ ধরনের স্বপ্নের কথা বলতে যাওয়ার মধ্যে একধরনের সরকারবিরোধিতার গন্ধ ও ধৃষ্টতা প্রদর্শনের সূক্ষ্ম দ্যোতনা নিহিত আছে। যার শরীরে ‘রাজরক্ত’ নেই, যিনি কোনো রাজনৈতিক নেতার সন্তান নন; যিনি নিতান্ত সাধারণ পরিবার থেকে আসা লোক; সেই ধরনের কোনো সাধারণ ভূমিপুত্র যখন সে ধরনের অসাধারণ ‘ধৃষ্টতাসূচক স্বপ্ন’ দেখেন, তখনই সাধারণ মানুষ চমকে যায়। নুরুল হকের উত্থান সেভাবেই অনেককে চমকে দিয়েছে।

শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের দিকে সাধারণ মানুষের জমায়েত হওয়ার একটা বড় কারণ ছিল, সেই আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তাঁদের প্রায় সবাই ছিলেন গণপরিসরে অপেক্ষাকৃত অপরিচিত। অনালোচিত। আকস্মিক উদ্‌গত তরুণদের সেই বক্তব্যে মানুষ কৌতূহলী হয়েছে। পুরোনো মুখের একঘেয়ে কথার ভিড়ে নতুন মুখের নতুন ভাষণ শুনতে পেয়ে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।

নুরুল হক যখন কোটা সংস্কারের আন্দোলনে নামেন, তখন তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অল্প কিছু শিক্ষার্থী ছাড়া কেউ তাঁকে চিনত না। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যখন তাঁর চেহারায় মধ্যবিত্তের ছাপ দেখেছেন, ইংরেজি বিষয়ের ছাত্র হওয়ার পরও তাঁর উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গির মধ্যে আটপৌরে ‘বরিশাইল্যা’ ভাব যখন সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে, তখনই তাঁরা আকৃষ্ট হয়েছেন। বারবার মার খেয়েও ‘ঘাড় ত্যাড়া’ করে যখন তিনি আন্দোলন চালানোর স্পৃহা দেখিয়েছেন, তখন শিক্ষার্থীরা তাঁর ওপর ভরসা করেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় নুরুল হক গঠন করেছিলেন ছাত্র অধিকার পরিষদ। তারই পরিণত ফল হিসেবে গঠিত হলো গণ অধিকার পরিষদ।

দলের সদস্যসচিব হয়েছেন নুরুল হক। আহ্বায়ক হয়েছেন রেজা কিবরিয়া। এইখানে আনকোরা নেতৃত্বের আকর্ষণ কিছুটা ফিকে হয়েছে বলে মনে হয়। কারণ, এ দেশের মানুষের কাছে রেজা কিবরিয়ার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে। তিনি অক্সফোর্ডে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ২০১৮ সালে আইএমএফের চাকরি ছেড়ে দেশে ফেরেন। গত সংসদ নির্বাচনে তিনি গণফোরামে যোগ দিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হয়ে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করেন। পরে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক হন রেজা কিবরিয়া। গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি গণফোরাম থেকে পদত্যাগ করেন।

রেজা কিবরিয়ার এই বিত্তবৈভবমুখর পরিচয় ও দোদুল্যমান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং নুরুল হকের মধ্যবিত্ত ঘরানার পরিচয় ও আপসহীন ভাবমূর্তিকে একসঙ্গে মেলানো কঠিন। এটিকে ‘অসবর্ণ’ মেলবন্ধন বলে মনে হয়। আওয়ামী লীগ-বিএনপিসর্বস্ব রাজনীতির বাইরের নতুন রাজনীতিতে বিশ্বাসী মানুষ এটিকে কতটা সহজভাবে নেবে, সেটি বড় প্রশ্ন।

রেজা কিবরিয়া ও নুরুল হক বলেছেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে তাঁদের দল ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবে। এর আগে দেশে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি আদায়ে সব পক্ষকে নিয়ে তাঁরা রাজপথে আন্দোলন গড়ে তুলবেন।

গৎবাঁধা কথার মতো তাঁরাও বলেছেন, তাঁদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, মানবিক এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা।’ এর মধ্যে সবচেয়ে যেটি উচ্চাভিলাষী ও ধৃষ্টতাপূর্ণ লক্ষ্য, সেটি হলো ‘অরাজনৈতিক নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার’ নিশ্চিত করা।

নুরুল হক বলেছেন, ‘এটা নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করব। সরকার যদি রাজি হয় তাহলে তো ভালো, রাজি না হলে আমরা আন্দোলন কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে বাধ্য করব। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আমরা নির্বাচনে অংশ নেব।’

‘গণ অধিকার পরিষদ’ নামটির মধ্য দিয়ে নুরুল হক সম্ভবত বোঝাতে চান দেশে এখন ‘গণ’ তথা সাধারণ মানুষ অধিকারবঞ্চিত। তাঁরা সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা করবেন। অর্থাৎ প্রধান বিরোধী দল একটি গণতান্ত্রিক দেশে যে কাজটি করে থাকে, তারা তা–ই করবে। নাগরিকের সার্বিক অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারকে বাধ্য করবে।

এসব কথাকে রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর হিসেবে নেওয়ার মধ্যে দোষ বা অবিবেচনাপ্রসূত কিছু নেই। রাজনীতিতে এসব কথা নতুন কিছু নয়। সব দলই এসব কথা বলে থাকে। তবে নুরুল হকের কথার মধ্যে খানিকটা জোর লক্ষ করা যাচ্ছে।

গণ অধিকার পরিষদের আত্মপ্রকাশের ঘোষণায় অনেক ষড়যন্ত্রতত্ত্ব বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেকে মনে করছেন, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সরকার যে নীতিকৌশল ও পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, নুরুল হক তারই অংশ। তাঁরা মনে করছেন, বিএনপি ‘নিবু নিবু’ একটি দলে পরিণত হলেও আগামী নির্বাচনে যদি তারা অংশ না নেয়, তাহলে আবারও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার দোষ পড়বে আওয়ামী লীগের ওপর।

এ কারণে নির্বাচনের আগে গণ অধিকার পরিষদ নামের নতুন দলটিকে কিছু রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের সুষম চর্চা প্রমাণে সরকার আগ্রহী হয়ে থাকতে পারে। এ ছাড়া বিএনপিকে আরও চুরমার করে সে জায়গায় নুরুল হককে প্রতিষ্ঠা করার কোনো কৌশলও থাকতে পারে।

দলের নাম ঘোষণার সময়ই নুরুল হক বলেছিলেন, তাঁরা আন্দোলনে অন্য দলগুলোকেও সঙ্গে নেবেন। তার মানে সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে মূলত তিনি বা রেজা কিবরিয়া থাকবেন। সে আন্দোলন বেগবান হলে বিএনপি দৃশ্যত তৃতীয় সারিতে চলে আসবে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের দেওয়া বিএনপি–সংক্রান্ত সর্বশেষ বক্তব্যকে এই প্রসঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া যায়। গতকাল রোববারই তিনি বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলনকে ‘কথাসর্বস্ব’ ও ‘ভার্চ্যুয়াল’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, সরকার চায় শক্তিশালী ও দায়িত্বশীল বিরোধী দল। কিন্তু বিএনপি মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় তুলতে চায়। এর সঙ্গে জনগণ ও রাজপথের কোনো সংযোগ নেই।

নুরুল হকের গণ অধিকার পরিষদ যেহেতু রাজপথে নামার কথা বলছে এবং শুধু ‘ভার্চ্যুয়াল’ না থেকে সভা–সমাবেশ করছে, সেহেতু তারাই কি সরকারের আরাধ্য ‘রাজপথের সঙ্গে সংযোগ’ থাকা ‘শক্তিশালী ও দায়িত্বশীল বিরোধী দল’ কি না, সে প্রশ্ন উঠছে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে নুরুল হকের দল গঠন নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। সরকার বিএনপি ও জাতীয় পার্টির বদলে নুরুল হকের দলকে ‘‘শক্তিশালী ও দায়িত্বশীল বিরোধী দল’ হিসেবে দেখতে চাইছে কি না সে প্রশ্ন সংগত কারণে অনেকেরই উপলব্ধির অন্তর্লোকে উঁকি দিচ্ছে।

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]