নূর হোসেনের রক্তে গণতন্ত্র কতটুকু এগোল

বাংলাদেশের রাজনীতি অনেক বছর ধরেই ঘুরপাক খেয়েছে রাজপথে আর ময়দানে। বিক্ষোভ সমাবেশ ও জনসভায়। এ দেশে রাজনীতি মানেই মিছিল, অবরোধ, লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস আর গুলিবর্ষণ। এসব ক্ষেত্রে পুলিশ বরাবরই সরকারের হুকুম তামিল করে। যারা পিটুনি বা গুলি খায়, তারা যখন সরকারে যায়, তারা আবার বিরোধীদের পেটায়, গুলি করে। ব্যাপারটা চলে আসছে মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো।

রাজপথে গুলি খেয়ে আজ পর্যন্ত কতজন নিহত হয়েছেন, তাঁদের সংখ্যা কেউ বলতে পারবে না। দলের বড় নেতারা দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বড় রকমের হামলার শিকার হন না। বেশির ভাগই দেখা যায়, পথচারী, রিকশাওয়ালা, দোকানদার, ভবঘুরে কিশোরেরা হতাহত হয়। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিয়ে কিছুটা সময় মাতম করে। তারপর তা ঝিমিয়ে পড়ে। তবে কিছু কিছু ঘটনা মানুষের স্মৃতিতে থেকে যায় অনেক দিন। তেমন একটি ঘটনা হলো ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বরের। ওই দিন ঢাকার জিরো পয়েন্টের কাছে গুলিতে নিহত হয়েছিলেন নূর হোসেন। দেশে তখন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সরকার।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারকে হটিয়ে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা নেন সেনাপতি এরশাদ। বাংলাদেশে এর আগেও সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় পালাবদল হয়েছে। কিন্তু এবারই প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করল। ওই সময় বিএনপি সরকারের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছিল। বিএনপির একটি অংশ তলে–তলে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আঁতাত করেছিল। আওয়ামী লীগের মতো বড় রাজনৈতিক দল এটিকে প্রকারান্তরে স্বাগত জানিয়েছিল। আওয়ামী লীগ হয়তো ভেবেছিল—শত্রুর শত্রু তো বন্ধু। এ দেশে যখনই কোনো সামরিক অভ্যুত্থান হয়, তখনই দেখা যায়, একটি দল ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়েছে, তাদের প্রতিপক্ষ এই পরিবর্তনে খুশি হয়েছে। এটি ১৯৭৫ সালে ঘটেছে, ২০০৭ সালেও এর পুনরাবৃত্তি দেখা গেছে।

অনেক টালবাহানা করে এরশাদ একটি সংসদ নির্বাচন দিয়েছিলেন ১৯৮৬ সালের ৭ মে। বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করে। আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা নির্বাচনে অংশ নিয়ে এরশাদকে একধরনের রাজনৈতিক বৈধতা দিয়ে দেয়। সীমাহীন কারচুপির এই নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটেনি। আওয়ামী লীগকে বিরোধী দলের আসনে বসতে হয় এবং শেখ হাসিনা সংসদে বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন। এরশাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিএনপিবিরোধী এই সমীকরণ টেকসই হয়নি। অনেক ব্যাপারেই এরশাদ ‘কথা রাখেননি’।

তখন ছিল জোটের রাজনীতি। একদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫-দলীয় জোট আর বিএনপির নেতৃত্বে ৭-দলীয় জোট। পরে ১৫-দলীয় জোট ছেড়ে কয়েকটি দল গড়ে তোলে ৫-দলীয় বাম জোট। একপর্যায়ে তারা সবাই মাঠে নামে। জামায়াতে ইসলামী এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ছিল সব সময়। তারা কোনো জোটে না থেকেও একই ধরনের কর্মসূচি দিত। এ নিয়ে জোটগুলোর মধ্যে কোনো অস্বস্তি ছিল না। তবে এ সময় একটি ঘটনা ঘটেছিল, যার তাৎপর্য ছিল সুদূরপ্রসারী।

১৯৮৭ সালের ২৮ অক্টোবর ১৫-দলীয় জোটের নেতা শেখ হাসিনার সঙ্গে ৭-দলীয় জোটের নেতা খালেদা জিয়ার একটি সাক্ষাৎ ও কথা হয় শেখ হাসিনার স্বামী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার মহাখালীর আণবিক শক্তি কমিশনের আবাসিক কলোনির ফ্ল্যাটে। তাঁরা একটি যৌথ ইশতেহারও তৈরি করেন। এর ফলে রাজপথের আন্দোলন বেগবান হয়।

এরশাদবিরোধী সব দল মিলে ১০ নভেম্বর (১৯৮৭) ঢাকায় অবরোধ ডেকেছিল। সেদিন ঢাকা শহর ছিল উত্তাল। জিরো পয়েন্টের কাছে এক সমাবেশে পুলিশের গুলিতে নিহত হলেন তিনজন—নুরুল হুদা বাবুল, আমিনুল হুদা টিটো ও নূর হোসেন। নূর হোসেন সবার নজর কেড়েছিলেন। গায়ের শার্ট খুলে তিনি প্যান্টের ওপর পেঁচিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর বুকে আর পিঠে শিল্পীর নিপুণ তুলিতে আঁকা ছিল দুটি চমৎকার স্লোগান। বুকে ছিল, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ আর পিঠে ছিল ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। বোঝা যায়, তিনি তৈরি হয়েই এসেছিলেন। তিনজন নিহত হলেও এই স্লোগান দুটি নূর হোসেনকে অমরত্ব দিয়েছে। পরে তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় জানা যায়। তিনি ছিলেন আওয়ামী যুবলীগের ঢাকা নগর শাখার একজন সংগঠক। থাকতেন বনগ্রামে। লেখাপড়া বেশি দূর হয়নি। ক্লাস এইটে উঠে দারিদ্র্যের কারণে স্কুল ছাড়েন। বাবা ছিলেন বেবিট্যাক্সির চালক। ২৬ বছরের নূর হোসেন ‘গণতন্ত্রে’র জন্য প্রাণ দিলেন।

নূর হোসেনের আত্মত্যাগ মানুষের মনকে নাড়া দিয়েছিল। বুকে-পিঠের স্লোগানসংবলিত তাঁর শরীর হয়ে উঠল আন্দোলনের প্রতীক। এরশাদ ঘাবড়ে গেলেন। মাস না পেরোতেই ৬ ডিসেম্বর তিনি জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন। তিন মাস পর তিনি জাতীয় সংসদের আরেকটি নির্বাচনের আয়োজন করেন। ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে বড় দলগুলো অংশ নেয়নি। ফলে এই সংসদ রাজনৈতিক বৈধতা পায়নি। এরশাদ এরপরও ক্ষমতায় টিকে ছিলেন পৌনে তিন বছর। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তাঁর পদত্যাগের মধ্য দিয়ে ঘটনাবহুল একটি দশক শেষ হয়। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দল অংশ নেয়। বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে।

নূর হোসেনকে কেউ ভোলেননি। কিন্তু কীভাবে দিনটি স্মরণ করা হবে, এ নিয়ে ঐকমত্য হয়নি। বিএনপি দিনটিকে ঐতিহাসিক ১০ নভেম্বর দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়। আওয়ামী লীগ ঘোষণা দেয় নূর হোসেন দিবস হিসেবে।

১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। এরশাদ এই পাঁচ বছর ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। তাঁর দল জাতীয় পার্টি সরকার গঠনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয়। এরশাদ সব কটি মামলায় জামিন পেয়ে যান। জেলে থেকেই তিনি পাঁচটি আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি জাতীয় সংসদের অধিবেশনে নূর হোসেনের মৃত্যুর জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চান। জাতীয় পার্টি ১০ নভেম্বরকে গণতন্ত্র দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। ২০১২ সালে এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমালোচনা করে এরশাদ বলেন, বিরোধী দলগুলো জনগণকে উসকে দেওয়ার জন্য লাশের রাজনীতি করে।

২০১২ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেন দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নূর হোসেনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশের মানুষ ভোট ও ভাতের অধিকার ফিরে পেয়েছে। এ সময় নূর হোসেনের মা মরিয়ম বিবির একটি কথা তৈরি করে অ্যান্টি-ক্লাইমেক্স। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে যে জন্য প্রাণ দিল, তা অর্জিত হয়নি। তবে আমার কোনো দুঃখ নেই। আমি নূর হোসেনের জন্য গর্ব অনুভব করি।’

জিরো পয়েন্ট এখন নূর হোসেন চত্বর। তাঁর স্মরণে ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়েছে। নূর হোসেনের রক্তে এ দেশে গণতন্ত্র কতটুকু এগোল, তা নিয়ে কথা-চালাচালি চলছে, চলবে। নূর হোসেন শহীদের মর্যাদা পেয়েছেন, তবে আরও অনেক শহীদের মতোই তাঁর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত বা বিচার হয়নি। বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে আজ অবধি রাজপথের আন্দোলনে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, তার দায় কেউ নেননি। কারও বিচার হয়নি।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক

[email protected]