নেতার ডিএনএ, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান

পৃথিবীতে যুগে যুগে খলনায়কের অভাব হয় না। কিন্তু মানুষ উপমা হিসেবে বেছে নেয় অল্প কিছু নাম। যেমন মধ্যযুগে বর্বরতার প্রতীক হালাকু খান। আধুনিক যুগে ফ্যাসিজমের প্রতীক হিটলার-মুসোলিনি, আরও পরে চিলির পিনোশে বা রুমানিয়ার চসেস্কু।

বর্তমান সময়ের জন্য প্রিয় উপমা অবশ্য জিম্বাবুয়ের রবার্ট মুগাবে। প্রয়াত এই নেতা শুধু ব্যক্তিস্বার্থে একটা দেশের সব সম্ভাবনা বিনষ্ট করে গেছেন, ক্ষমতায় থাকার জন্য হেন অপকর্ম নেই, করেননি। আমেরিকার নির্বাচনের পর ডোনাল্ড ট্রাম্পের কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁকে তুলনা করা হচ্ছে রবার্ট মুগাবের সঙ্গে। তুলনা যাঁরা করছেন তাঁদের মধ্যে ডেমোক্র্যাটরা তো আছেনই, আছেন পুলিৎজার বিজয়ী লেখক সামান্থা পাওয়ারের মতো ব্যক্তিরা। (কোনো কোনো বিশ্লেষক অবশ্য এ তুলনার মধ্যে আমেরিকানদের শ্রেষ্ঠত্ববাদকে দেখছেন এবং ট্রাম্পের মতো রাজনীতিক যে দেশে জনপ্রিয়, সেখানকার মানুষের রুচি ও মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।)

ট্রাম্পের ডিএনএ হয়তো বিশ্বের অনেক দেশের নেতার মতোই। কিন্তু পার্থক্যটি ব্যবস্থায়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রব্যবস্থা আমাদের দেশের মতো নয়। সেখানে রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান কাজ করে স্বাধীনভাবে, মর্যাদা নিয়ে। একজন সিটিং প্রেসিডেন্টের সাধ্য নেই তা উল্টে ফেলার।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার আরও কিছু হতভাগা দেশের সরকারপ্রধানদের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। যেসব দেশে সুনির্দিষ্টভাবে এসব তুলনা করা বিপজ্জনক, সেখানে বলা হচ্ছে ট্রাম্পের কর্মকাণ্ড ‘আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের’ মতো।

ট্রাম্প কোনো প্রমাণ ছাড়া নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আনছেন, ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকার করছেন, ফলাফল উল্টে দেওয়ার জন্য নিজে এমনকি বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের নির্বাচন কর্মকর্তা এবং রাজ্য আইনসভার প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। রাজ্যে রাজ্যে মামলা করছেন, হেরে গেলে ফেডারেল সুপ্রিম কোর্টে যাবেন বলে হুমকি দিচ্ছেন। আমেরিকার ইতিহাসে এসব আচরণের কোনো নজির নেই। তাঁর এসব অবিশ্বাস্য কর্মকাণ্ডে প্রীত হয়ে ‘ট্রাম্প দেখি আমাদের রাজনীতিবিদদের মতো’ বলেই অনেকে সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এতে প্রীত হওয়ার আসলে কিছু নেই। কারণ, এসব মুদ্রার একটি দিকমাত্র।

মুদ্রার আরেকটি দিক হচ্ছে ট্রাম্পের এসব চেষ্টা এখন পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে এবং এটি অবধারিত যে তাঁর বাকি চেষ্টাও ব্যর্থ হবে। কারণ, আমেরিকার সিস্টেম ও সেখানকার প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের ভিত। ট্রাম্পের ডিএনএ হয়তো বিশ্বের অনেক দেশের নেতার মতোই। কিন্তু পার্থক্যটি ব্যবস্থায়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রব্যবস্থা আমাদের দেশের মতো নয়। সেখানে রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান কাজ করে স্বাধীনভাবে, মর্যাদা নিয়ে। একজন সিটিং প্রেসিডেন্টের সাধ্য নেই তা উল্টে ফেলার।

ট্রাম্প এবারের নির্বাচনে ভোট পেয়েছেন আমেরিকার এর আগে নির্বাচিত যেকোনো প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি। যেবার তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন, তার চেয়েও প্রায় এক কোটি বেশি। নির্বাচনে কারচুপির যে অভিযোগ তিনি তুলছেন, তার পক্ষে রয়েছে বহু রিপাবলিকান সিনেটর ও নেতা, তাঁর কয়েকজন মন্ত্রী, ফেডারেল অ্যাটর্নি জেনারেল। আদালতে রয়েছেন তাঁর নিয়োগ করা বিচারক, যাঁদের অনেকে প্রকাশ্যে রিপাবলিকান। কিন্তু তারপরও এখন পর্যন্ত কোথাও তিনি ফলাফল উল্টে দিতে পারেননি। পারেননি এমনকি এ ধরনের কোনো জোরালো সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে।

নির্বাচনের ফলাফল তিনি মানেননি, কিন্তু তারপরও তাঁকে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাথমিক পদক্ষেপগুলোতে সম্মতি দিতে হয়েছে। প্রকৃত গণতন্ত্রে ব্যক্তি এতই অনুল্লেখ্য রাষ্ট্রের কাছে।

২.

নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এমন কিছু নেই ট্রাম্প করেননি। তিনি নির্বাচন পেছানোর প্রস্তাব দিয়েছেন, ভোটার উপস্থিতি কমানোর জন্য কোভিড ও জাতিগত সংঘাত পরিস্থিতি তীব্র হতে দিয়েছেন এবং নির্বাচনে ডাক–ভোট বাতিল, সীমাবদ্ধ বা প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন।

নির্বাচনের পর তিনি পদক্ষেপ নিয়েছেন কিছু ব্যাটল গ্রাউন্ড অঙ্গরাজ্যে ভোট পুনর্গণনার আর মামলা করার। কিন্তু পুনর্গণনায় ভোটের ফলাফল বদলায়নি, বদলানোর কোনো সম্ভাবনাও নেই। আমেরিকার ইতিহাসে রিকাউন্টে ভোটের ফলাফল উল্টে যাওয়ার ঘটনা নেই বললেই চলে। যে দুবার এমন ঘটনা ঘটেছিল (যেমন ২০০৮ সালে মিনেসোটার সিনেট নির্বাচন বা ২০০৪ সালে ওয়াশিংটনের গভর্নর পদে নির্বাচন) দুবারই রিকাউন্টের আগে ভোটের পার্থক্য ছিল ৫০০-এর চেয়েও কম। কিন্তু ট্রাম্পের সঙ্গে এবার বাইডেনের ভোটে পার্থক্য সবচেয়ে কম যে অঙ্গরাজ্যে (জর্জিয়ায়), সেটিও ১২ হাজারের মতো। আবার রিকাউন্টে এটি বদলে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে রিপাবলিকান শাসনাধীন সে অঙ্গরাজ্যে ইতিমধ্যে ফলাফল সার্টিফাই (নিশ্চিতকরণ) করা হয়ে গেছে তাই।

অঙ্গরাজ্যগুলোতে ট্রাম্প মামলায় পরাজিত হয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ সব প্রশ্নে। তাঁর দলের বিচারক পেনসিলভানিয়ায় তাঁর পক্ষের মামলা খারিজ করেছেন তীব্র ভর্ৎসনা করে। এরপর সেখানে তাঁর দলের সিনেটরই তাঁকে আহ্বান করেছেন ফলাফল মেনে নিতে। ফেডারেল সুপ্রিম কোর্টে অ্যামি কোনি ব্যারেটের নিয়োগের পর রিপাবলিকানদের সংখ্যাধিক্য রয়েছে ৬-৩-এ। কিন্তু সেই বিচারকেরা জনগণের রায় পাল্টে দিয়ে ট্রাম্পকে বিজয়ী করার পদক্ষেপ নেবেন, এটা সম্ভবত ট্রাম্পও আশা করতে পারেন না। আমেরিকায় বিচার বিভাগ নিয়েও কিছু বিতর্ক আছে, কিন্তু এতটা নগ্নভাবে জনরায়ের বিপক্ষে দাঁড়ানোর কোনো নজির সেখানে নেই।

ট্রাম্প এখন আর যা পারেন তা হচ্ছে যেসব অঙ্গরাজ্যে বাইডেন অল্প ব্যবধানে জিতেছেন কিন্তু আইনসভায় রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, সেসব আইনসভাকে প্রভাবিত করা। এসব আইনসভাকে দিয়ে রাজ্যের জনগণের ভোটারদের রায়কে বাতিল করে ট্রাম্পকে ভোট দেবেন, এমন ব্যক্তিদের নিয়ে ইলেকটোরাল কলেজ নির্বাচিত করা এবং ১৪ ডিসেম্বর ইলেকটোরাল ভোটের ফলাফলকে এভাবে ছিনতাই করা। মিশিগানের প্রাথমিক প্রচেষ্টা তিনি ইতিমধ্যে করেছেন। কিন্তু সেখানকার দুজন রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা তাঁর সঙ্গে মিটিংয়ের পরও বলেছেন, আইনের বাইরে যাবেন না তাঁরা।

এমন অবিশ্বাস্য কাণ্ড অন্য কোথাও হবে বলেও মনে হয় না। কারণ, ব্যক্তির লোভ সেখানে প্রতিষ্ঠানকে পদানত করতে পারে না। অন্তত জাতীয় নির্বাচনের মতো মহাগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে না।

৩.

ট্রাম্প কী কী করেছেন বা তাঁর দেশে কী কী হচ্ছে, তা আমরা সবাই দেখছি। কিন্তু তঁার দেশে কী কী হয়নি, তা বোধ হয় ভেবে দেখিনি। ট্রাম্পের দেশে নির্বাচনে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া বা প্রতিপক্ষ নির্বাচনী এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। পুলিশ দিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর মামলা-হামলা করানো হয়নি। প্রশাসন, আদালত, নির্বাচনব্যবস্থাকে ব্যক্তি ও দলের স্বার্থে ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। নির্বাচনের এক মিনিট আগেও নির্বাচন শুরু হয়নি, প্রকাশ্যে কেউ ব্যালট বাক্স ভর্তি করে ফেলেনি, সেখানে গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করা হয়নি।

রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান সেখানে আইন অনুসারে কাজ করেছে। ব্যক্তি ট্রাম্পের প্রতি আনুগত্য বা প্রলোভন তাঁদের কাউকে দায়িত্ব পালনে বিরত করতে পারেনি। এমন সর্বনাশা কাণ্ড করার চিন্তা বা চেষ্টা কেউ করেছেন, এমন কথাও শোনা যায়নি। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ সেখানে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে পদানত করতে পারেনি।

ট্রাম্পের রাজনীতির সঙ্গে হয়তো অনেকেই আমাদের রাজনীতির নানা মিল খুঁজে পাচ্ছেন। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তি, মর্যাদা ও দায়িত্ববোধের কথাও আমাদের বিবেচনার মধ্যে থাকা উচিত।


আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক