নোয়াখালীতে কেন ধর্ষণ বেশি?

বৃহত্তর নোয়াখালী কি বাংলাদেশের ‘বুনো পশ্চিম’, যেখানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুরের’ সন্ত্রাসীরা?
প্রথম আলো

নোয়াখালীতে আবারও বসতঘরের দরজা ভেঙে ঢুকে ধর্ষণের অভিযোগ এসেছে। এবারের ঘটনা চৌমুহনীর। বেগমগঞ্জের সেই বীভৎস নারী নির্যাতনের পর আরও আরও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। যুবলীগের স্থানীয় কয়েকজন নেতাকে আটকও করা হয়েছে। দেশজুড়ে প্রতিবাদ, ধর্ষণের দায়ে মৃত্যুদণ্ডের বিধান—কোনো কিছুই তো ধর্ষণ কমাতে পারছে না। নারী নির্যাতনের এই আগুন থেকে ওঠা জ্বলন্ত প্রশ্নটা এই: নোয়াখালীতে ধর্ষণ কেন বেশি? নোয়াখালীর বিশেষত্বই–বা কী?

বৃহত্তর নোয়াখালী কি বাংলাদেশের ‘বুনো পশ্চিম’, যেখানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গ্যাংস অব ওয়াসিপুরের সন্ত্রাসীরা। শতবর্ষ আগে আমেরিকার বিরান পশ্চিমে ছিল সম্পদ, চাষের জমি আর কাজের অভাব। আর ছিল প্রচুর ভাগ্যসন্ধানী বেকার যুবকেরা। ঘোড়া আর পিস্তল নিয়ে তারা ঘুরে বেড়াত। আর ব্রিটিশ আমল থেকেই ওয়াসিপুরে ছিল ডাকাতির ঐতিহ্য। সেটাই পরে টিকে থাকে বন্দুকবাজ গ্যাংগুলোর পাল্লাপাল্লিতে। নোয়াখালীর ঐতিহ্য কি সে রকম? ক্ষমতাদণ্ড হাতে নারীর সন্ধানে কেন ঘুরে বেড়ায় তারা?

বৃহত্তর নোয়াখালীর মধ্যে পড়ে ফেনী থেকে লক্ষ্মীপুর পর্যন্ত এলাকা। ফেনীতে আমরা জয়নাল হাজারীর বর্বরতা দেখেছি, লক্ষ্মীপুরের উপজেলা চেয়ারম্যান তাহের ও তাঁর ছেলে বিপ্লবের খুনখারাবির কাহিনিও বেশি পুরোনো না। নতুন হলো সুবর্ণচর, বেগমগঞ্জ, চৌমুহনীর অপ্রতিরোধ্য ধর্ষণের ঘটনাগুলো।

প্রথমত এলাকাটি অপরাধবহুল। বেগমগঞ্জে গত ৯ মাসে খুন হয়েছেন ১৩ জন। থানায় ধর্ষণের অভিযোগ পৌঁছেছে নয়টি। চাঁদাবাজি, অপহরণ, সংঘর্ষও ঘটে আকছার। স্থানীয়রা বলছেন, সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে সব। অপরাধ বেশি ঘটা মানে অপরাধ সহজ, সুলভ ও বিচারহীন। বিচারহীনতা মানে অপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকেরা শক্তিশালী। প্রথম আলোসহ বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে নোয়াখালীর গ্রাম ও শহরে বিভিন্ন ‘বাহিনীর’ দাপটের কথা এসেছে। যেমন, বেগমগঞ্জের আলাইয়ারপুরে টিটু বাহিনী, রুবেল বাহিনী, রহিম বাহিনী, রাজগঞ্জ ইউনিয়নে সেন্টু বাহিনী, আমানউল্যাপুর ইউনিয়নে মন্নান বাহিনী, গোপালপুর ইউনিয়নে পিচ্চি রাসেল বাহিনী, মুজিদ বাহিনী, জীরতলী ইউনিয়নে মঞ্জু বাহিনী। পুলিশ শুধু খালাসি সুমন আর সম্রাট বাহিনীর কথা স্বীকার করে। মাফিয়াতন্ত্রের তৃণমূলকরণ ঘটে গেছে। তৃণমূলে ক্ষমতার খুঁটি হিসেবে কাজ করা এই সব বাহিনীর গোড়াও একই জায়গায়: ক্ষমতাসীন কিন্তু অনির্বাচিত জনপ্রতিনিধি।

প্রথম আলোর নোয়াখালী প্রতিনিধি থেকে শুরু করে ওই অঞ্চলের সমাজ–রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত বেশ কয়েকজন এই লেখককে দুটি কথা বলেছেন: ১. জনপ্রতিনিধিরাই সেখানে ইয়াবা ব্যবসা ও সেবনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত এবং ২. বেগমগঞ্জ বা সুবর্ণচরের মতো জায়গায় বিচার–প্রশাসন বলে কিছু ছিল না। চরাঞ্চলের মানুষের সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কথাও সুবিদিত।

নোয়াখালীতে অব্যাহত ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচী
প্রথম আলো

বাংলাদেশে এখন ভোট ছাড়াই জনপ্রতিনিধি হওয়া যায়। যারা একে চ্যালেঞ্জ জানাত, সেই বিরোধী দলগুলো অবশ ও অক্ষম। সুতরাং সন্ত্রাসী–লুটেরারা অনায়াসে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের পদ, বিভিন্ন কমিটির আসন, জনপ্রতিনিধির ক্ষমতা—সব কবজা করে বসে আছে। গত দুটি বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে চিরাচরিত নেতা/মুরুব্বিদের স্তরটি মোটামুটি উবে গেছে। জবাবদিহি তো দূরের কথা, প্রশাসনের ভয়ও এখন লোপ পেয়েছে। ডাণ্ডা যার ক্ষমতা তার। ধর্ষণের সুযোগও তার।

রাজনীতির এই অপরাধীকরণ দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশেরই আলামত। নোয়াখালী তার বাইরে যাবে কী করে। তবে সেখানে আরেক অস্বাভাবিক বাস্তবতা পেকে উঠেছে। অনেক পরিবারেরই উপার্জনকারী পুরুষ হয় প্রবাসী, নয়তো কুমিল্লা–চট্টগ্রামের ইটভাটায় কর্মরত। এর ফল হয়েছে দুটি। প্রবাসী বা অভ্যন্তরীণ অভিবাসী পুরুষের স্ত্রী–কন্যারা পড়েছেন একরকম অভিভাবকহীন অবস্থায়। সমাজপতি থেকে শুরু করে আগ্রাসী পুরুষের চোখে এঁরা ‘অরক্ষিত’ নারী। অরক্ষিত মানে কারও কারও চোখে সহজলভ্যও বটে।

এই ‘অরক্ষিত’ নারীদের ব্যাপারে ওই অঞ্চলে মনোভাবে বেশ জটিল। যেহেতু পরিবারের প্রধান পুরুষটি আবাসিক নন, সেহেতু পাড়া–প্রতিবেশীরা ওইসব বাড়ির মেয়েদের ওপর ‘অভিভাবকত্ব’ ফলান। তাদের শাসানো যেমন চলে; তেমনি চলে হরেদরে নারীবিদ্বেষী আলাপ। এই সব প্রচারণায় নারীকে শুধুই যৌনবস্তু হিসেবে দেখানো হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই সব শুনতে শুনতে ‘অরক্ষিত’ নারীদের প্রতি লোভী হয়ে ওঠে।

এখানেই ঘটে আরেক ঘটনা। যেহেতু স্বামী, বাবা, বড় ভাইয়েরা বিদেশ থেকে টাকা পাঠাচ্ছেন, সেহেতু দেবর, ভাই, ভাগ্নেদের পোয়াবারো। তাদের রোজগারের চিন্তা কম। জমি বর্গা দিয়ে দেওয়া হয়। ধান ছাড়া তেমন অর্থকরী ফসলের চাষও কম। তাই বেকারের সংখ্যা অনেক বেশি। এই সব প্রবাসীর অর্থধন্য বেকাররা বিদেশ থেকে পাঠানো টাকায় দিনগুজরান করেন। তাদের অনেক অবসর। তাদের অবসর ভরিয়ে তোলে অজস্র চায়ের দোকানের আড্ডা, ক্যারম খেলার হইচই, মাদকের মজা আর মোবাইল ফোনের টাচস্ক্রিনে পর্নো ভিডিও দেখা ও শেয়ারের আমোদ। মোবাইল ফোন এখানে নারীবিদ্বেষী অস্ত্রও বটে। ফোনের ক্যামেরায় লুকিয়ে মেয়েদের ছবি তোলা, সেগুলোকে বিকৃত করে ছড়িয়ে দেওয়া, তারপর ব্ল্যাকমেল করে ধর্ষণের শিকার হতে বাধ্য করা। বেগমগঞ্জের ঘটনায়ও মোবাইলে বিবস্ত্র নারীর ভিডিও তুলে তা ছড়াবার ভয় দেখিয়ে কুপ্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।

এই সব বেকার আর কী করবে? তারা যোগ দেয় গ্যাংবাজিতে। বাবার টাকায় কেনা মোটরসাইকেলে করে তারা এলাকায় দাপট দেখায়। জনপ্রতিনিধির আসনে বসে থাকা মাফিয়ারা এদের অবাধ আনন্দ–ফুর্তিতে মদদ দিয়ে দলে রাখে, অপরাধে সুরক্ষা দেয়, দেয় বিচারহীনতার স্পর্ধা।

সুবর্ণচরের পারুল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দ্বারা গত নির্বাচনের রাতে ধর্ষণের শিকার হন। পারুল বলেছেন, তাঁকে ধর্ষণকারী রুহুল আমিন মেম্বারের (বর্তমানে জেলে) যৌনদস্যুতার ভয়ে এলাকায় মেয়েদের লুকিয়ে রাখতে হতো। প্রথম আলোর প্রতিনিধিও বলেছেন, বেগমগঞ্জে এখনো বাবা–ভাইয়েরা কাজে গেলে গ্যাংবাজ যুবকের কুনজর থেকে বাঁচাতে উঠতি বয়সী মেয়েদের আত্মীয়ের বাড়িতে রাখেন। পারুল তো এও বলেছেন, আশঙ্কার রাতে দুর্বল পরিবারের মেয়েরা যেখানে পারত সেখানে লুকিয়ে থাকত।

সুতরাং অবাধ রাজনৈতিক ক্ষমতা যখন এমন অরক্ষিত সমাজ পায়, তখন তা মানুষের ঘরে নারীর জন্য হানা দেয়। এ অবস্থাকে আরও সহজ করে দেয় প্রবাসী আয়নির্ভর এলাকার সামাজিক পরিস্থিতি। এই দুই মিলেই গড়ে ওঠে ধর্ষণের রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব। যৌনায়িত বিনোদনের সংস্কৃতি এবং রক্ষণশীল প্রচারণা এক সুরে নারীর ভাবমূর্তিকে করে তোলে নাজুক আর পুরুষকে বানায় আগ্রাসী। তৃতীয় কারণটি ঐতিহাসিক। নোয়াখালী, বগুড়া বা বরিশালের মতো জায়গায় একসময় ছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের দাপট নক্ষত্র মরে গেলে সেখানে কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোলের জন্ম হয়। তেমনি ক্ষমতার পালাবদলে বিএনপির ভূমি হঠাৎ করে হয়ে পড়ে বিপরীত ক্ষমতার অভয়ারণ্য। গত কয়েক বছরের চালচিত্র বলে, ক্ষমতার আমূল পরিবর্তন কোনো কোনো এলাকাকে একেবারে আত্মরক্ষাহীন করে তোলে। নোয়াখালীর মতো জেলা হয়তো তারও শিকার।

ফারুক ওয়াসিফ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও লেখক।

[email protected]