নৈতিক স্খলন: মুরাদ মন্ত্রী না থাকলে সাংসদ থাকবেন কীভাবে

মো. মুরাদ হাসান
ছবি: প্রথম আলো

মঙ্গলবার সকালে কথা হয় প্রথম আলোর সরিষাবাড়ী প্রতিনিধি শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তখনো তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান পদত্যাগ করেননি। এরই মধ্যে তাঁর নির্বাচনী এলাকা সরিষাবাড়ীতে ছাত্রলীগ তাঁর বিরুদ্ধে মিছিল করেছে। কেবল মিছিল নয়, মুরাদ পদত্যাগ করবেন, এ খবরে সেখানে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে। জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগ মঙ্গলবার বিকেলে জরুরি বৈঠক ডেকেছে। ধারণা করা হয়, তারাও মুরাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে। তাহলে কি কেন্দ্র থেকে কোনো ইঙ্গিত পেয়ে তারা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে? এর আগে লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করার পর স্থানীয় কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ তাঁকে বহিষ্কার করে।

এ লেখা চলাকালেই খবর এল মুরাদ হাসান প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। তিনি যে মুহূর্তে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন, সে মুহূর্তে তিনি আর মন্ত্রিসভার সদস্য নেই। অর্থাৎ সাবেক প্রতিমন্ত্রী। এর আগে তাঁর সম্পর্কে সরিষাবাড়ীর একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রীকে পদত্যাগের নির্দেশ আমাদের জন্য লজ্জাজনক বিষয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলকে ক্ষতির হাত থেকে মুক্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রী মুরাদের বক্তব্যের জন্য আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মুরাদ হাইব্রিড নেতাদের মূল্যায়ন করতেন। ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করতেন না। তাই তাঁর পদত্যাগ করার নির্দেশের খবর পেয়ে আমরা মিছিল করেছি।’ সরিষাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছানোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বলতে চাই, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর আচরণ ও বক্তব্য দলকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিল। পদত্যাগ না করায় দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছিল।’

কে এই মুরাদ হাসান? অভিযোগ আছে, ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্রদল করতেন। পরে ছাত্রদল থেকে ছাত্রলীগে আসেন। ছাত্রত্ব শেষ হলে আওয়ামী লীগের টিকিটে সাংসদ হন। সাংসদ থেকে প্রতিমন্ত্রী। প্রথমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে, পরে তথ্য ও সম্প্রচারে আসেন। কিন্তু এই দুই মন্ত্রণালয়ে তিনি আদৌ কোনো অবদান রেখেছেন, তা কেউ বলতে পারবেন না। তবে তিনি অন্য বিষয়ে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। আর সে কারণে আকাশ থেকে ধরণিপ্রপাত।

বেশ কিছুদিন ধরে তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের অশালীন, অনৈতিক ও কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় হলেও সরকারের নীতিনির্ধারকদের ঘুম ভাঙছিল না। প্রথমে তিনি রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে কথা বললেন। বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিতে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন। এ রকম ঘোষণা গত ১৩ বছরে আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী-নেতা দিয়েছেন। কিন্তু কাজ করছেন তার বিপরীত। ফলে জনগণ তাঁর এ বক্তব্যকে খুব আমলে নেয়নি। আমলে নিয়েছে তাঁর অশালীন ভাষাভঙ্গি, অমুককে মেরে শুইয়ে দেওয়া, অমুককে দেশছাড়া করার দম্ভ।

যে দেশের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমানাধিকার স্বীকৃত, যে দেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সামাজিক ন্যায় ও মানবিক মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে, সেই দেশের একজন প্রতিমন্ত্রী এ রকম অভব্য ও রুচিবিগর্হিত ভাষায় কথা বলতে পারেন? ব্যক্তি মুরাদ হাসান, যত বলবানই হোন না কেন, রাষ্ট্রক্ষমতার জোর না থাকলে এ মাত্রায় স্বেচ্ছাচারিতা ও যা খুশি তা করার সাহস তিনি পেতেন না।

এরপর তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, যিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ও তাঁর নাতনি জাইমা রহমানকে নিয়ে যেসব কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা বলেছেন, তা ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য। এটিও বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তখনো সরকারের হুঁশ ফিরেছে বলে মনে হয়নি। বিএনপি ও নাগরিক সমাজের কেউ কেউ প্রতিবাদ করলেও সরকারের তরফ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

এরই মধ্যে মুরাদ হাসানের দুই বছর আগের একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়ে পড়ে। ফোনালাপটি ছিল একজন খ্যাতনামা অভিনেত্রীর সঙ্গে। সেই ফোনালাপে তিনি যেসব কথা বলেছেন, তা এতই রুচিহীন যে নিন্দা ও ধিক্কার জানানোর ভাষাও আমাদের জানা নেই। এসব কথা বলেও দুই বছর ধরে তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। কারণ, তিনি তো মাননীয় সাংসদ, আমাদের সর্বোচ্চ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান মহান জাতীয় সংসদের সদস্য, তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একজন সদস্য এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী। তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কার আছে?

প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান ওই অভিনেত্রীর সঙ্গে অশালীন, অভব্য ভাষা ব্যবহার করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার লোক দিয়ে তাঁকে হোটেলে নিয়ে আসার হুমকি দিয়েছেন। তিনি নাহিদ হেলালের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে রোকেয়া হল ও শামসুন্নাহার হলে যে মেয়েরা থাকেন এবং ছাত্রলীগ করেন, তাঁদের সম্পর্কেও জঘন্য মন্তব্য করেছেন। এসব মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি কেবল ওই মেয়েদেরই অপমান করেনি, সমগ্র নারী সমাজকে অপমান করেছেন। যে দেশের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমানাধিকার স্বীকৃত, যে দেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সামাজিক ন্যায় ও মানবিক মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে, সেই দেশের একজন প্রতিমন্ত্রী এ রকম অভব্য ও রুচিবিগর্হিত ভাষায় কথা বলতে পারেন?
ব্যক্তি মুরাদ হাসান, যত বলবানই হোন না কেন, রাষ্ট্রক্ষমতার জোর না থাকলে এ মাত্রায় স্বেচ্ছাচারিতা ও যা খুশি তা করার সাহস তিনি পেতেন না।

প্রথমে তিনি ক্ষমতাসীন দলটির পদ দখল করে আছেন, সেই পদের অপমান করেছেন। এরপর সাংসদ পদের এবং সর্বশেষ মন্ত্রিসভার সদস্য পদের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। যে ব্যক্তি বিরোধী দলের নেতা-নেত্রী, তাঁদের নাতিনাতনি সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিতে পারেন, তিনি নিজের দলের নেতা-নেত্রী সম্পর্কে সুরুচিপূর্ণ কথা বলতে পারেন না। আরেক ভিডিওতে দেখা গেছে, মুরাদ হাসান এক বিয়েবাড়িতে অতিথিদের সামনে কোনো এক ব্যক্তিকে উচ্চারণের অযোগ্য ভাষায় গালাগাল করছিলেন। চিকিৎসাশাস্ত্র পড়া এই ব্যক্তি নিজেই বলেছেন, তাঁর মুখ বড্ড খারাপ। এ ধরনের মুখ খারাপ লোকের স্থান ভদ্রসমাজে হতে পারে না।

অভিনেত্রীর সঙ্গে মুরাদের টেলিফোন সংলাপ ফাঁস হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগ করতে বলেছেন এবং সে অনুযায়ী তিনি মঙ্গলবার পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। এর আগে সোমবার দুপুরে সাংবাদিকেরা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, অভিনেত্রীর সঙ্গে তথ্য প্রতিমন্ত্রীর ফোনালাপ ও ছাত্রলীগের নেত্রীদের সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করার পর তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তিনি বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করবেন। এরপর রাত আটটায় দলের সাধারণ সম্পাদক জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী মুরাদ হাসানকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগ করতে বলেছেন। জানা গেছে, এর আগে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ পরীক্ষা করে দেখেছে, আসলেই এটি মুরাদ হাসানের কথোপকথন কি না। যখন প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিত হয়েছেন, তাঁরই কথোপকথন, তখন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।

সে ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, নৈতিক স্খলনের দায়ে তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে সরে যেতে হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো নৈতিক স্খলনের কারণে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করলে সাংসদ পদে থাকবেন কী করে? সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের ঘ-এ বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি তিনি নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে দণ্ডিত হন।’ মুরাদ হাসানের বিষয়টি আদালতে যায়নি। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধের কারণেই প্রধানমন্ত্রী তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছেন। এ লেখা পর্যন্ত দল থেকে তাঁর বিরুদ্ধে সংগঠনবিরোধী তৎপরতার কারণে ব্যবস্থা নেয়নি। সে ক্ষেত্রে নৈতিক স্খলনই তাঁর অপরাধ হিসেবে প্রমাণিত। এ বিষয়ে আইনজীবী জেড আই খান পান্নার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, নৈতিক স্খলনের কারণে মন্ত্রী না থাকলে তিনি সাংসদও থাকতে পারবেন না। একই মন্তব্য করেছেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়াও।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]