নোংরা মন্তব্যের যেন উৎসব চলছে

এই ঘরবন্দী সময়ে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপসহ অনলাইন দুনিয়াই মানুষে–মানুষে যোগাযোগের অবলম্বন হয়ে উঠেছে।
রয়টার্স ছবি: রয়টার্স

জ্ঞান হওয়ার পর থেকে পথঘাট, স্কুল-কলেজ, খেলার মাঠ ও অফিস-আদালতে নারীকে শব্দের আঘাতে জর্জরিত হতে দেখছি। নিজেও কারণ ছাড়াই শব্দে জব্দ হয়েছি বহুবার। পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে নারীকে নিয়ে করা নোংরা মন্তব্য শোনেননি; এমন মানুষ পাওয়া বিরল। এমনকি সাহিত্যের ভাষাতেও রয়েছে নারীর প্রতি অবমাননা।

অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের ‘সেফ সিটিজেন ফর উইমেন’ নামের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ৮৮ শতাংশ নারী রাস্তায় অপমানজনক মন্তব্যের মুখে পড়েন এবং ৪৬ শতাংশ নারী অপমানজনক ভাষার শিকার হন। এসব অসম্মানজনক ভাষা আর নোংরা মন্তব্যের মূলে রয়েছে নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। এ দৃষ্টিভঙ্গি এতটাই প্রকটভাবে আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে যে এর উপস্থিতি আমরা আর আলাদাভাবে টের পাই না; এমনকি নারীও টের পান না।

বললে ভুল হবে না, নারীর প্রতি অবজ্ঞাপূর্ণ পরিবেশে শিশুরা অনেকটা সহজাতভাবেই নারীকে সম্মান না করার মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠছে। শৈশব পেরিয়ে কৈশোর, কৈশোর পেরিয়ে যৌবন, এভাবে একসময় জীবন-পরিক্রমা শেষ হয়। কিন্তু নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না।

নোংরা মন্তব্যের জালে যে শুধু নারীই বন্দী, তা কিন্তু নয়। বরং পুরুষেরাও এর শিকার হচ্ছেন, শিকার হচ্ছেন লিঙ্গগত বৈচিত্র্যের অধিকারী অন্য মানুষগুলোও। এমনকি শিশুরাও এসব হয়রানি থেকে মুক্ত নয়। তবে এ প্রবণতার চরম শিকার হলেন তারকা ব্যক্তিত্বরা। আর নারী ব্যক্তিত্ব হলে তো কথাই নেই!

এর জ্বলন্ত উদাহরণ আজকের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এ মাধ্যমগুলো নারীর প্রতি অশ্লীল মন্তব্য করার যেন অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল অনেক পুরুষকেও অবলীলায় নারীকে নিয়ে নোংরা উক্তি করতে দেখেছি। এমনকি এক নারীও অন্য এক নারী সম্পর্কে অমর্যাদাকর কথা বলেন, যদিও তা পুরুষদের তুলনায় অনেক কম। একই সামাজিক কাঠামোতে বেড়ে ওঠা নারীরাও নিজেদের সম্মান রক্ষা করতে শেখেননি ঠিকমতো।

আমাদের ভাষায় প্রচলিত গালির সিংহভাগই নারীর উদ্দেশে, তাঁর চরিত্রকে আবর্তন করে। গালির ভাষা প্রয়োগের সময় এসবের অর্থ তলিয়ে দেখারও প্রয়োজন অনুভব করেন না অনেকেই। অথচ এ শব্দগুলো প্রতিনিয়ত নারীকে আঘাত করে। শারীরিক আঘাত তবু চোখে দেখা যায়, কিন্তু কারণে-অকারণে নোংরা ভাষার আঘাতে জর্জরিত নারীর হৃদয় অন্তরালে রয়ে যায়।

শৈশব পেরিয়ে বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে আমাদের অনেককেই শুনতে হয়েছে, ‘যারা ভালোভাবে চলে, কেউ তাদের মন্দ কথা বলে না।’ কিন্তু ভালোভাবে চলার মানদণ্ডটি যে কী, তা আজও আমার কাছে এক গোলকধাঁধা। বড়দের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেও স্কুল কিংবা কলেজ যাওয়ার পথে বখাটেদের ছুড়ে দেওয়া নোংরা মন্তব্যগুলো এড়াতে পারিনি। এ মন্তব্যগুলো ভিন্ন মোড়কে আজও পিছু নেয় প্রকাশিত যেকোনো লেখায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে কিংবা চ্যাটবক্সে। কটূক্তিকে উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে, এ মূলমন্ত্রকে বুকে ধারণ করেই অধিকাংশ নারী জীবনের পথ পাড়ি দিচ্ছেন। প্রতিকারের আশাও যেন দিন দিন ক্ষীণ হয়ে আসছে।

তথ্যপ্রযুক্তির যুগে অশ্লীলতার চর্চা আর নোংরা কথার যেন মহোৎসব শুরু হয়েছে। শুধু অলিগলি আর পথঘাট নয়, বখাটেদের জন্য আজ উন্মুক্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অবারিত প্রান্তর। রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটি মেয়েকে হয়রানি করতে যে ঝুঁকিটুকু আছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেন সেই ঝুঁকিটুকুও নেই। যার যা খুশি, সে তা-ই লিখছে। এখানে কে কী লিখছে, সেসব দেখার যেন কেউ নেই! তাই অবাধে চলছে নোংরা কথার উৎসব।

এসব নোংরা মন্তব্যের জালে যে শুধু নারীই বন্দী, তা কিন্তু নয়। বরং পুরুষেরাও এর শিকার হচ্ছেন, শিকার হচ্ছেন লিঙ্গগত বৈচিত্র্যের অধিকারী অন্য মানুষগুলোও। এমনকি শিশুরাও এসব হয়রানি থেকে মুক্ত নয়। তবে এ প্রবণতার চরম শিকার হলেন তারকা ব্যক্তিত্বরা। আর নারী ব্যক্তিত্ব হলে তো কথাই নেই! তাঁদের পোস্ট কিংবা খবরের নিচে নোংরা মন্তব্যের জোয়ারে চোখ রাখা দায়। এ ছাড়া আছে চটুল শিরোনামের সস্তা খবরের দৌরাত্ম্য। সস্তা এ শিরোনামগুলোই একজন মানুষকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য যথেষ্ট।

তারকা হওয়া কোনো অপরাধ নয় যে তাঁদের সম্পর্কে যার যা খুশি, তা-ই বলা যায়। তারকাদের অনেকে আবার সর্বংসহা ধরিত্রীর মতো সব ধরনের মন্তব্যই মেনে নেন। কিন্তু তাঁদের সর্বংসহা এ মানসিকতার পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। যেহেতু তাঁরাই সবচেয়ে বেশি সাইবার অপরাধের শিকার হয়ে থাকেন, তাই এ বিষয়ে তাঁদের সমন্বিত প্রতিবাদ প্রয়োজন। মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এই মানুষগুলোই যখন এসব নোংরা মন্তব্যকে নিয়তি বলে মেনে নেন, তখন সাধারণ ভুক্তভোগীদের জন্য সমস্যা সমাধানের কোনো উদাহরণ তৈরি হয় না।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথা আমরা জানি। এ আইন পাস হওয়ার পরও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নারী যদি এতটাই অনিরাপদ বোধ করেন, তবে সে আইনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। এ আইনে প্রতিদিনের লাখ লাখ নোংরা মন্তব্যের স্তূপ কীভাবে রোধ করা সম্ভব, তা স্পষ্ট নয় অনেকের কাছেই। অথচ এসব নোংরা মন্তব্যের প্রতিটির বিচার হওয়া প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, তাদের এ হয়রানিগুলো কিন্তু বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, এটি আসলে একটি সামগ্রিক সমস্যার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।

হাজার মন্তব্যের ভিড়ে যদি একটি নোংরা মন্তব্যও থাকে, তবে সেটিও বিবেচনায় নেওয়া উচিত। যদিও জানি, শুধু আইন দিয়ে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়; তারপরও আইনের কঠোর প্রয়োগ এ সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। নারীর প্রতি বিরূপ আচরণকারীদের প্রতি রাষ্ট্রের কঠোর অবস্থান নিতে হবে। পাশাপাশি প্রয়োজন বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মের শিশুদের মানসিকতার পরিবর্তন নিয়ে বড় ধরনের কর্মপরিকল্পনা। তবে যাঁরা এ পরিকল্পনার অংশ হবেন, তাঁরা যেন ইতিবাচক মানসিকতার হন, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।

বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে, এ ক্ষেত্রে একটি বড় সীমাবদ্ধতা রয়েছে আমাদের। মনে রাখতে হবে, পরিকল্পনা প্রণয়নকারীরাও বেড়ে উঠেছেন একই সামাজিক কাঠামোতে। মানুষের আচরণগত পরিবর্তন এক দিনে আসবে না। তবে থেমে থাকলে চলবে না, প্রতিবাদ করতে হবে এবং প্রতিকারের জন্য একযোগে কাজ করতে হবে। ভাষায় মানুষের অপমান আর নয়।

নিশাত সুলতানা লেখক ও গবেষক