ন্যুব্জ সংবাদমাধ্যম ও দুর্বল গণতন্ত্র

জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কয়েকটি বিষয় আমাকে পড়াতে হয়, তার মধ্যে একটি হচ্ছে ‘গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকার ও সংবাদমাধ্যম’। জাপান একটি অগ্রসর গণতান্ত্রিক দেশ এবং জাপানের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আমাদের পাঠক্রম নির্ধারিত করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার আবশ্যকীয় একটি উপাদান হচ্ছে সংবাদমাধ্যম। সরকারের ভেতরে কী ঘটছে, জনগণের কাছে রাখা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে সরকার কীভাবে অগ্রসর হচ্ছে এবং সেই ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য বা ব্যর্থতা কতটুকু, সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব হচ্ছে সেসব বিষয়ে জনগণকে অবগত করার মধ্য দিয়ে সঠিক পথে সরকারকে পরিচালিত করায় সহায়তা করা।
প্রশ্ন উঠতে পারে, জনসংযোগের মতো সরকারের সুনির্দিষ্ট কিছু বিভাগ নিজে থেকেই সেই দায়িত্ব পালনে সক্ষম হওয়ায় সংবাদমাধ্যমকে কেন আগ বাড়িয়ে তা করতে হবে? জনসংযোগের কাজ যেহেতু হচ্ছে ব্যর্থতাকে আড়াল করে রেখে সাফল্যের ঢোল পেটানো, ফলে সে রকম কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে সরকারের ব্যর্থতার দিকগুলো সম্পর্কে জানতে পারা নাগরিকদের পক্ষে একেবারেই সম্ভব নয়। আর এখানেই এসে যায় গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সংবাদমাধ্যমের গুরুত্বের প্রসঙ্গটি এবং একই সঙ্গে যা ফুটিয়ে তোলে সাংবাদিকতার সঙ্গে জনসংযোগের যোজন দূরত্বের পরিষ্কার ছবি।
ফলে যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দলের অবস্থান অপেক্ষাকৃত দুর্বল, সে রকম গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সংবাদমাধ্যমের গুরুত্ব আরও অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক হয়ে দেখা দেয়। জাপানের এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বাহ্যিক বেশ কিছু মিল সহজেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব। দুই দেশেই ক্ষমতাসীন দলের অবস্থান যথেষ্ট শক্তিশালী হওয়ায় দলের স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার আশঙ্কা নিয়ে উদ্বেগ সংবাদমাধ্যমজুড়ে বিস্তৃত। তবে গুণগত পার্থক্য এ রকম, জাপানের সংবাদমাধ্যমের একটি অংশ সেই উদ্বেগ সম্পর্কে দেশবাসীকে জোর গলায় সতর্ক করে দেওয়ায় নিয়োজিত থাকা সত্ত্বেও সরকার কিংবা ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে না যে এদের গলা টিপে ধরো, কিংবা মামলার মারপ্যাঁচে কুপোকাত করে দিয়ে নাভিশ্বাস তুলে দাও এর মালিক বা সম্পাদকদের। সরকার বরং সমালোচনার পরোক্ষ জবাব দিয়ে চলেছে সরকার–সমর্থক সংবাদমাধ্যমে নানা রকম বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা ও সংলাপের মধ্য দিয়ে, যা-ও কিনা কোনো অবস্থাতেই অতিক্রম করছে না শালীনতার গণ্ডি।
জাপানের সংবাদমাধ্যমের মধ্যে দৈনিক সংবাদপত্রকে রাজনৈতিক দিক থেকে অনেক বেশি প্রভাবশালী গণ্য করা হয়। জাতীয় পর্যায়ের দৈনিক সংবাদপত্রগুলো মোটা দাগে দুই ভাগে বিভক্ত। বর্তমান সরকারের দক্ষিণপন্থী অবস্থানের সমর্থনে আছে সবচেয়ে বেশি প্রচারিত দৈনিক ইওমিউরি শিম্বুন-এর পাশাপাশি কট্টর জাতীয়বাদী চেতনায় অনুপ্রাণিত দৈনিক সাঙ্কেই শিম্বুন। অন্যদিকে, সরকারবিরোধী শিবিরে নেতৃত্বের অবস্থানে আছে প্রচার সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে অবস্থানকারী দৈনিক আসাহি ও মায়নিচি শিম্বুন। সরকারের অনুসৃত কতিপয় নীতি নিয়ে দুই শিবিরের কলমযুদ্ধ বলা যায় হাড্ডাহাড্ডি পর্যায়ের। একে অন্যকে ঘায়েল করার জন্য দোষত্রুটি খুঁজে বের করে তা নিয়ে ফলাও প্রচারেও পিছিয়ে নেই এরা।
ঠিক তেমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল আসাহির বিরুদ্ধে যৌনদাসী-সংক্রান্ত বানোয়াট প্রতিবেদন প্রকাশের অভিযোগ ইওমিউরির উত্থাপন করা নিয়ে। জাপান সরকারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ইওমিউরি যৌনদাসীদের অস্তিত্ব অনেকটাই অস্বীকার করে আসছে। অন্যদিকে আসাহি নানা রকম ঐতিহাসিক দলিলপত্রের ভিত্তিতে সেই সত্যতা প্রমাণের চেষ্টা অনেক দিন থেকে করে আসছে। সেই প্রক্রিয়ার একটি বিচ্যুতি ছিল ত্রুটিপূর্ণ সেই প্রতিবেদন, যেটিকে পুঁজি করে কোমর বেঁধে নেমেছিল ইওমিউরি। আসাহি অবশ্য ভুল স্বীকার করে নিলেও উল্লেখ করেছিল যে একটিমাত্র প্রতিবেদনের মিথ্যা প্রমাণিত হওয়া উদ্ধৃতির মধ্য দিয়ে পুরো বিষয়টির অর্থহীনতা প্রমাণিত হয় না। একপর্যায়ে ইওমিউরির সঙ্গে গলা মিলিয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে কঠোর ভাষায় আসাহির সমালোচনা করলে জাপানের জনগণ এবং সার্বিকভাবে সংবাদমাধ্যম সেটাকে সহজভাবে নিতে পারেনি এবং বিতর্কের বাইরে থাকার ইঙ্গিত প্রধানমন্ত্রীর কাছে তারা পৌঁছে দিয়েছিল। সেই একবারের কঠোর সমালোচনার পর প্রধানমন্ত্রীও বুঝে গিয়েছিলেন, সংবাদমাধ্যমের মধ্যে চলা বিতর্কে সরকারের আগ বাড়িয়ে নাক গলাতে নেই এবং এর পর থেকে সে রকম কঠোর কোনো মন্তব্য তাঁর মুখ থেকে উচ্চারিত হয়নি। আসাহিকেও ভুল স্বীকার করে নেওয়ার জন্য জড়িয়ে পড়তে হয়নি একের পর এক মামলার ফাঁদে।
এবার আমরা একটু পেছন ফিরে অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আরও যে একটি বিষয়ে বাংলাদেশের অল্প কিছুদিন আগের পরিস্থিতির সঙ্গে জাপানের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের মিল কিছুটা হলেও খুঁজে পাব, সেটা হলো স্বৈরাচারী শাসনের অধীনে সংবাদমাধ্যমের আচরণ। একালের আসাহি আর ইওমিউরি একে অন্যের বিপরীতে অবস্থান নিলেও জাপানের সেই যুদ্ধের দিনগুলোয় এরা ছিল দেশের সামরিক আগ্রাসনের কট্টর সমর্থক। যুদ্ধের পর অবশ্য সবাই আগের সেই অবস্থানের জন্য দলবদ্ধভাবে ক্ষমা চেয়ে উল্লেখ করেছিল যে কঠোর সেন্সরশিপের আওতায় এর বাইরে কোনো কিছু করার পথ তাদের সামনে বন্ধ ছিল।
সামরিক শাসন বা স্বৈরতন্ত্র ক্ষমতাসীন হয়েই প্রথম যে কাজটি করে তা হলো সংবাদমাধ্যমকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। পাঠক হয়তো ভুলে যাননি সেই পাপিষ্ঠ কণ্ঠ: ‘আমি মেজর ডালিম বলছি।’ বঙ্গবন্ধুকে খুন করে খুনির দল প্রথমেই ছুটে গিয়েছিল বেতার কেন্দ্রে এবং বেতারের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পর গলা টিপে ধরেছিল সব কটি সংবাদপত্রের। ফলে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতাসীন নতুন সরকারকে স্বাগত না জানানোর কোনো উপায় সেদিন বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের ছিল না।
২০০৭ সালে বেসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আড়ালে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের বেলায়ও একই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি লক্ষ করা গেছে। সেদিন এমন কোনো সংবাদপত্র ছিল কি, যেটা কিনা সরকারের সমালোচনা করে সেই সরকারকে অবৈধ আখ্যায়িত করেছিল? যদি না থাকে, তবে কেন মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে সম্মিলিত এই বিষোদ্গার। সবাই যে কাজ করেছে, সেই একই কাজ তাঁকেও করতে হয়েছে এবং এর পক্ষে কোনো রকম সাফাই না গেয়ে তিনি বরং নিজের সেই অক্ষমতার জন্য অনুতপ্ত হওয়ার প্রকাশকেই তুলে ধরেছেন। এটাকে তো মনে হয় সৎ সাংবাদিকতার একটি দৃষ্টান্ত হিসেবেই দেখা উচিত, মামলার প্যাঁচে তাঁকে ঘায়েল করে দেওয়ার মতো বেইমানি হিসেবে নয়।
মাহ্ফুজ আনামের সমালোচনায় যাঁরা মুখর, তাঁরা অবশ্য বলে থাকেন যে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে নেতৃত্বশূন্য করে তোলায় চালানো প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে জঘন্য অন্যায় কাজ তিনি করে ফেলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এত দিন আপনারা কোথায় ছিলেন? ঘটনা ঘটে যাওয়ার প্রায় আট বছর পর অতীতের একটি ভুলের জন্য দোষ স্বীকার করে নেওয়ার অর্থ অবশ্যই এ রকম নয় যে তাঁর সব রকম পদক্ষেপই তখন ছিল কলঙ্কিত।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।