নয়া অর্থনীতি-বিপ্লবের জনক ও তাঁদের জাদারা

সাংসদ হাজি সেলিম ও তাঁর ছেলে ইরফান সেলিম
ছবি: প্রথম আলো

সামন্ততন্ত্রের যুগে নবাবের পুত্রকে বলা হতো নবাবজাদা। যেমন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান। পীরপুত্রকে সম্বোধন করা হতো পীরজাদা। যেমন পাকিস্তানে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও লেখক সৈয়দ শরিফুদ্দিন পীরজাদা। ফারসি শব্দ ‘জাদাহ’ প্রত্যয় হিসেবে যোগ করে হয় বাদশাহজাদা, নবাবজাদা, পীরজাদা প্রভৃতি। বর্তমানে বাদশাহ বা নবাবদের যুগ নেই, এটা গণতন্ত্রের যুগ। বাদশাহ-নবাব না থাকতে পারেন, কিন্তু ‘জাদা’রা আছেন এবং জাদাদের জন্মদাতারা আমির, ওমরাহ ও নবাবদের চেয়ে বিষয়-সম্পত্তিতে ও ক্ষমতায় কিছু কম নয়। এখনকার নব্য নবাবদের ধনদৌলত বহুগুণ বেশি।

কেউ যখন সামান্য অবস্থা থেকে বিপুল বিত্তের অধিকারী হন, অবশ্যই বলতে হবে তিনি প্রতিভাবান। একালের গণতন্ত্রের প্রতিভাবানেরা ক্ষমতার জোরে সিকি শতাব্দীর মধ্যে বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পারেন। মোগল আমলের ঢাকার সিকি অংশ—সোয়ারীঘাট, বাদামতলী, লালবাগ, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর তল্লাটে এক নবাবের বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে দ্রুততম সময়ে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে যাঁর দখল করার মুরোদ আছে, ক্ষমতার রাজনীতিতে তাঁর কদর আছে, সমাজেও তাঁর দাম আছে। ভোটারদের মধ্যেও রয়েছে তঁার জনপ্রিয়তা। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি করা একজন খ্যাতিমান চিকিৎসকের চেয়ে একজন সাম্রাজ্য বিস্তারকারীর সমর্থক এলাকায় বেশি। ভোটের দিন লাইন ধরে গিয়ে মানুষ তাঁর মার্কায় সিল মারতে থাকে। দোষ শুধু রাজনৈতিক দলকেই-বা দিই কী করে? নাগরিকদের আক্কেল-বুদ্ধি, বিচার-বিবেচনার কথা চিন্তা করেই বড় রাজনৈতিক দল উপযুক্ত ব্যক্তিকেই মনোনয়ন দেয়। বিমল মিত্রের উপন্যাসের চরিত্রের ভাষায় বলতে হয়—কড়ি দিয়ে সব কেনা সম্ভব। নির্বাচনে মনোনয়ন পর্যন্ত।

বিএনপির আশীর্বাদে গরুর গাড়ি মার্কা নিয়ে সিটি করপোরেশনের কমিশনার নির্বাচিত হওয়া দিয়ে যাত্রা শুরু। ভেবেছিলেন বিএনপি বহুকাল ক্ষমতায় থাকবে, ম্যাডামের পরে ভাইয়া আসবেন, তাই সংসদ নির্বাচনে ওই দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু এলাকায় তখন বিএনপির আরেক সুযোগ্য নেতা নাসির উদ্দিন পিন্টু সাহেব থাকায় হাজি সাহেবকে মনোনয়ন দেয়নি। তিনি শহরের নাগরিক, তাই ধানের শীষের গোছা হাতে নিয়ে বসে থাকতে পারেন না। বিশেষ করে তিনি বুড়িগঙ্গাপারের মানুষ। ঘাটে নৌকাও তৈরি ছিল। গরুর গাড়িতে বসে না থেকে নৌকায় উঠে যান। তারপর আর তাঁকে পেছনে তাকাতে হয়নি।

রাজনৈতিক ক্ষমতা এমন জিনিস, যা মৃতকে পর্যন্ত জীবিত করতে পারে। বাক্‌শক্তিহীনকে ফিরিয়ে দেয় কথা বলার শক্তি। ২০১৬ সালের মাঝামাঝি স্ট্রোকের কারণে বাক্‌শক্তি হারিয়ে ফেলেন তিনি। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান। মনোনয়ন পাওয়ার পর আবার একটু একটু করে কথা বলতে শুরু করেন। নির্বাচনে জয়লাভ করে আগের মতোই ক্ষমতার প্রদর্শন ও দখল কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। [বণিক বার্তা, ২৯ অক্টোবর]

বাঙালি তর্কপ্রিয় জাতি। কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন সেদিন রাস্তার মধ্যে সাংসদজাদা নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত না করলে সবকিছু যথাপূর্ব স্বাভাবিকভাবেই চলত। ওয়ার্ড কমিশনারের ‘দাদাবাড়ি’ প্রাসাদের জীবনযাত্রা আগের মতোই থাকত। একটি অবাঞ্ছিত ঘটনা একটি রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার মুখোশ উন্মোচনে সহায়ক হলো।

আশির দশক থেকে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির আনুকূল্য পেয়ে হাজারখানেক গ্যাংস্টার ব্যবসায়ীর উত্থান। অবৈধ ও অসাংবিধানিক শাসকের অকুণ্ঠ আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে এই শ্রেণি, তঁারা একটির পর একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এক ব্যবসার জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অন্য জায়গায় খাটিয়েছেন। তারপর সগৌরবে হয়েছেন ঋণখেলাপি।

এই শ্রেণির প্রধান পেশা দখলদারি। এঁরা নদীতীর দখল করেন। বনভূমি দখল করেন। খাসজমি দখল করেন। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি করায়ত্ত করেন। এঁদের লোভের শিকার হয়ে কেউ সাত পুরুষের ভিটা থেকে বিতাড়িত হন। এঁরা সিমেন্টের সঙ্গে বালু ও মাটি মিশিয়ে বাজারজাত করেন। এই নবযুগের বিজনেস টাইকুনদের জন্যই ৩০ টাকার পেঁয়াজ এক শ-দেড় শ টাকায় কিনতে হয়। ২০ টাকার আলু ৫০ টাকায় কেনে সীমিত আয়ের মানুষ। এঁরাই যান পার্লামেন্টে দেশের আইন প্রণয়ন করতে। এই শ্রেণিটি বাংলাদেশে যে নয়া অর্থনীতির জন্ম দিয়েছে, তা আঠারো শতকে ব্রিটেনের শিল্পবিপ্লবের চেয়ে কম বৈপ্লবিক নয়।

কেউ দ্রুততম সময়ে যদি অগাধ সম্পদের মালিক হন, তাতে কারও অন্তর্দাহ হওয়ার কারণ নেই। আদমজী, ইস্পাহানী, বাওয়ানি, এ কে খানকে নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না। অক্লান্ত পরিশ্রম করে কেউ যখন ব্যবসা-বাণিজ্য করে মিল-কারখানা প্রতিষ্ঠা করে সম্পদশালী হন, সেটা খুবই গৌরবের। তবে ২০-২৫ বছরের মধ্যে একজনের ১৫-২০টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্পকারখানার মালিক হওয়া আলাদিনের জাদুর চেরাগের ছোঁয়া ছাড়া সম্ভব নয়।

সাংসদজাদার দাদাবাড়িতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গিয়ে যেসব বস্তু পেয়েছেন, তার মধ্যে ২টি বিদেশি পিস্তল, ইয়াবা, বিদেশি মদ, ৩৮টি ওয়াকিটকি ও হ্যান্ডকাফ রয়েছে। জননেতাদের বাড়িতে এসব থাকা খুবই স্বাভাবিক। মদ্যপানও তাঁদের মৌলিক অধিকার। কিন্তু সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে হ্যান্ডকাফ। অনেকটা প্রতীকী। এই হ্যান্ডকাফ শুধু প্রতিপক্ষের হাতে পরিয়ে টর্চার সেলে এনে নির্যাতনের জন্য নয়। এ যেন বাঙালি জাতির হাজার বছরের সভ্যতা ও সংস্কৃতির হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে বন্দী করার অপচেষ্টা। এঁদের এই হ্যান্ডকাফ থেকে মুক্তির ভেতর দিয়েই জাতির মুক্তি।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক