পকেটে তারা টাকার বান্ডিল পুরতে চায়, কৃষ্ণচূড়া নয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই কৃষ্ণাচূড়া গাছটি, এখন যেটির আর কোনো অস্তিত্ব নেই
ছবি: সংগৃহীত

কৃষ্ণচূড়া গাছটি তারা কেটে ফেলল। বিষয়টি যারা ইতিমধ্যে জেনে গেছেন, তাঁরা বলবেন, ‘ওদের কি একটুও হাত কাঁপল না!’ আবার পরক্ষণে এ-ও ভাবনায় আসবে, এ দেশে গাছ কাটা তো সহজ কিংবা মন চাইলেই যখন যেখানে ইচ্ছা গাছ কেটে ফেলা যায়, এতে হাত কাঁপার কী আছে। ফলে কৃষ্ণচূড়াগাছটিও কাটতে গিয়ে তাদের হাত কাঁপেনি। তবে অনেকের ঠিকই মন কেঁপে উঠেছে। সেটিই তো হওয়ার কথা। দেড় বছর ধরে বন্ধ থাকার পর আর সপ্তাহ তিনেক পরেই খুলতে যাচ্ছে ক্যাম্পাস। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এসে কৃষ্ণচূড়াগাছটি আর দেখতে পাবেন না। তাঁদের স্বাগত জানাবে না লাল ফুলের ঝালর হয়ে থাকা গাছটি। লাইব্রেরির সামনে থেকে সোজা তাকালেই সবুজের মাঝখানে আলো করে থাকা সে গাছ আর নেই। ডাকসুর ক্যানটিনের সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়ে বা মধুর ক্যানটিন থেকে ডাকসুর পেছন কোনাটা পার হয়েই রাস্তা ছেয়ে যাওয়া লাল ফুলের সেই চিরায়ত দৃশ্য আর কখনো দেখা যাবে না।  

মহামারিতে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকার পর খুলতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দেড় বছর ধরে শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ রাখা নিয়ে নানা সমালোচনার শেষ নেই, সেদিকে না যাই। এটি ঠিক যে, সদিচ্ছা থাকলে আরও আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়া যাইত। গত বুধবার ঢাবি কর্তৃপক্ষ এক বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সুপারিশ করেছে। শুরুতে গ্রন্থাগার, এরপর আবাসিক হল, সর্বশেষে ক্যাম্পাস। সেদিন সন্ধ্যায় টিএসসিতেই ছিলাম। সেখানে বসেই ক্যাম্পাস খোলার এ খবর জানতে পারলাম, এর একটু পর এ-ও জানতে পারলাম, কৃষ্ণচূড়াগাছটি কেটে ফেলা হয়েছে। মুহুর্তেই সব কিছু ফিকে হয়ে গেল যেন।

এ প্রতিষ্ঠানে না পড়লেও নানা কারণে বেশ কিছু সময় কেটেছে আমার। মনে পড়ে, কলাভবনের পাঁচতলায় কী এক কাজে গিয়েছিলাম। তখন বৃষ্টি পড়ছিল। বারান্দা থেকে দেখতে পেলাম, ফুলের ঝালরে লাল হয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়াগাছটি ভিজছে একা। আর বাতাসে ঝরে ঝরে পড়ছিল ফুল। নিচে ফুলের লালগালিচা এক। এমন নৈসর্গিক দৃশ্য চোখ বন্ধ করলেই এখনো দেখতে পাই।

কৃষ্ণচূড়া মানে লাল, লাল মানে দ্রোহ, দ্রোহ মানে সংগ্রাম, আর সংগ্রাম মানে ‘রক্তে আগুন প্রতিরোধ গড়ে নয়া সকাল’। কবিতা, গান, প্রেম, তারুণ্যে যে লাল ছোঁয়া—সেটিই তো কৃষ্ণচূড়া। লাল টুকটুকে উজ্জ্বল রঙের এই ফুল অনেক দূর থেকে আমাদের চোখে পড়লেও একুশে ফেব্রুয়ারি সেটিকে আমাদের আরও কাছে নিয়ে এসেছে যেন। ভাষাশহীদদের রক্তে ভেজা বুকপকেটে ঢুকে যাওয়া একমাত্র ফুল। মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী তাঁর বিখ্যাত ‘কাঁদতে আসেনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ শুরু হয়েছে এভাবে, ‘এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে/ রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়/ যেখানে আগুনের ফুলকির মতো/ এখানে ওখানে জ্বলছে অসংখ্য রক্তের ছাপ/ সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি.../ এখানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে/ আমি তাদের ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি/ যারা আমার অসংখ্য ভাইবোনকে/ নির্বিচারে হত্যা করেছে। কী আশ্চর্য, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণেই বলি হলো কৃষ্ণচূড়াগাছ।

একাত্তরে মুক্তিসংগ্রামের উত্তাল সময়ে যেখানে প্রথম লাল-সবুজ পতাকা উত্তোলন করেছিল ছাত্ররা। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের কি সাক্ষী ছিল কৃষ্ণচূড়াগাছটি? আগুনরাঙা ফুলই কি ধারণ করেছিল সেই পতাকার লালটুকু? সেসব প্রশ্ন এখন অবান্তর। সেই চত্বরে এখন বিষণ্নতা নেমে এসেছে। কারণ, সেখানে এখন লাল কিংবা সংগ্রাম বা দ্রোহের কোনো অস্তিত্ব নেই।

অপরাজেয় বাংলাদেশের পেছনে আগুনের ফুলকি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে না আর গাছটি। সেটি আর কখনো দেখা যাবে না কলাবাগানের সামনে। একাত্তরে মুক্তিসংগ্রামের উত্তাল সময়ে যেখানে প্রথম লাল-সবুজ পতাকা উত্তোলন করেছিল ছাত্ররা। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের কি সাক্ষী ছিল কৃষ্ণচূড়াগাছটি? আগুনরাঙা ফুলই কি ধারণ করেছিল সেই পতাকার লালটুকু? সেসব প্রশ্ন এখন অবান্তর। সেই চত্বরে এখন বিষণ্নতা নেমে এসেছে। কারণ, সেখানে এখন লাল কিংবা সংগ্রাম বা দ্রোহের কোনো অস্তিত্ব নেই। এরপরেও আশা রাখতে হয়তো বলা যায়, মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর কবিতার ভাষাতেই— ‘যদিও অসংখ্য মিছিল অস্পষ্ট নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করবে একদিন/ তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ঘণ্টা ধ্বনি/ প্রতিদিন তোমাদের ঐতিহাসিক মৃত্যুক্ষণ ঘোষণা করবে।’

২.
করোনা মহামারির চেয়েও বড় মহামারি হয়ে দাঁড়িয়েছে যত্রতত্র পরিবেশ ধ্বংস। যার সামান্য ক্ষমতা আছে সে-ও বন, পাহাড়, নদী দখল বা ধ্বংসে নাম লেখাচ্ছে। নয়তো ‘ইজ্জত’ থাকে না। অক্সিজেনের আহাজারির এমন কঠিন মুহূর্তে গাছ কাটা যেন পান্তাভাত। এর জন্য কোনো কারণ না থাকলেও একটা কারণ তো লাগেই। হ্যাঁ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষ্ণচূড়াগাছটি কাটা হয়েছে নিরাপত্তার অজুহাতেই। আর উন্নয়নের জন্য তো চোখ বন্ধ করে গাছ ফেলাটাই এখানে সংস্কৃতি। সে জন্য বিকল্প জায়গা থাকলেও যেন বেছে নেওয়া হয়, কোথায় গাছ আছে সেখানে।

রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও (রুয়েট) ৬০০ কোটি টাকার উন্নয়ন কার্যক্রম চালাতে গিয়ে কেটে ফেলা হচ্ছে প্রায় অর্ধশত গাছ। ইতিমধ্যে লাশের স্তূপের মতো ফেলে রাখা হয়েছে কিছু কাটা গাছ। অথচ এর জন্য বন বিভাগের কোনো অনুমতিই নেওয়া হয়নি। গাছ কাটার জন্য দরপত্র, এর আগে গাছের দাম নির্ধারণসহ কোনো কিছুর জন্যই অনুমতি নেওয়া হয়নি। উল্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বলছেন, ভবন করতে গিয়ে দু-চারটা গাছ কাটা পড়বেই। এ নিয়ে সমালোচনার কী আছে। কোনো প্রতিষ্ঠানে এমন বিকারহীন লোক থাকলে গাছ কাটার জন্য কোনো কারণই লাগে না আসলে।

দুই সপ্তাহ আগে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে নালা নির্মাণের জন্য কেটে ফেলা হলো একটি অর্জুনগাছ। যেটি ছিল শামুকখোল পাখিদের আশ্রয়। গাছটিতেই ফুটিয়েছিল শতাধিক ছানা তারা। ছানাগুলো অপেক্ষায় ছিল আকাশে ডানা মেলার। গাছটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশির ভাগ ছানা মারা যায়। যেগুলো বেঁচে ছিল, সেগুলো জবাই করে নিয়ে যায় মানুষেরা। গাছের ডালে মায়ের আদরে নিরাপদ আশ্রয়েও বাঁচতে পারল না শামুকখোলের ছানাগুলো। উড়তে শেখার আগেই ‘উন্নয়নের বলি’ হতে হলো তাদের। একটি গাছ কাটার সঙ্গে প্রাণবৈচিত্র্যের কী নিদারুণ ক্ষতি হয়ে যায়, কী নির্মমতা প্রকাশ পায়, সেটিই তো দেখা হলো এখানে।

চট্টগ্রামের ফুসফুসখ্যাত সিআরবি এলাকায় শতবর্ষী শিরীষগাছগুলোও আজকে হুমকির মুখে। বড় বড় বিনিয়োগের একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল থাকলেও নতুন আরও বেসরকারি হাসপাতাল করা লাগবে শহরটিতে। সেটি যদি করতেই হয়, এর জন্য বিকল্প জায়গা বা জমিরও অভাব নেই। এরপরেও সেটি করতে হবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও ব্রিটিশ রেলওয়ের স্মৃতিধন্য ও ঐতিহাসিক এলাকাতেই। কারণ, সেখানে গাছ আছে, পাখির কোলাহল আছে, জীববৈচিত্র্য আছে, আরও আছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। সে জন্য এমন জায়গাতেই প্রকল্প করতে হবে। হাজার প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, সমাবেশ, মানববন্ধনে কিছু যায় আসে না।

ক্ষমতা ও দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি পরিবেশবিধ্বংসী উন্নয়ন করেই ছাড়বে। এতেই তাদের সুখ। কারণ, পকেটে তারা টাকার বান্ডিলই পুরতে চায়, কৃষ্ণচূড়া ফুল নয়। ছোট্ট একটি শামুকখোল বাচ্চার ওজন যে সেই বান্ডিলের চেয়েও হালকা। সিআরবির গাছে গাছে ছুটন্ত কাঠবিড়ালিকে তো ধরা সহজ নয়, যতটা সহজ উন্নয়নের অছিলায় আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাওয়া।

রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক