পদদলিত, খানাখন্দ, উচ্চমূল্য এবং ঈদ

করুণ মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে​ আছে স্তূপীকৃত স্যান্ডেল, মানুষগুলো শুধু নেই
করুণ মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে​ আছে স্তূপীকৃত স্যান্ডেল, মানুষগুলো শুধু নেই

যানজট সারা শহরে, বিশেষ করে গত কুড়ি বছরের প্রতিটি বছরের এই সময়ে শান্তিনগর, মগবাজার, মালিবাগে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। ফিরিস্তিতে অবশ্যই যোগ হবে ট্রেন আর দূরপাল্লার বাসের টিকিটের জন্য সংগ্রাম, টিকিট না পাওয়ার আহাজারি অথবা কালোবাজারির দৌরাত্ম্য। ভেজাল খাবার নিয়ে প্রতিনিয়তই প্রিন্ট আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় রিপোর্ট। আর এবার ঈদের বাজারে বাড়তি পাওনা মন্ত্রীর পদ হারানোর প্রথমে গুঞ্জন, পরে সত্যতা আর তারপর অদ্ভুত সব ‘কারণ দর্শানো’।
মন্ত্রী-মিনিস্টার দিয়েই শুরু করি। সব ঈদে এই পর্বটি তো থাকে না, তাই এবার বাড়তি পাওনা। ‘স্যার, শুনেছেন। আজ রাতে আসতেই হবে।’ শেষে বিকেলে এক টিভি চ্যানেল থেকে ফোন। না, কোনো কিছু তো শুনিনি। ‘সৈয়দ আশরাফ সাহেবের মন্ত্রিত্ব গেছে’। টক শোটা জমবে, তাই পীড়াপীড়িতে রাজি হলাম। একটু পরে অবশ্য সহকর্মীর মাধ্যমে অনলাইন বার্তা সংস্থার বরাতে জানলাম, খবর পাক্কা না, রাতে টক শো হলো ‘গমের মায়া আর মায়ার গম’ গোছের শিরোনামে। ১০ জুলাইয়ের প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম ছিল ‘গুঞ্জনই সত্য হলো’। পত্রিকা বলছে, আরও কিছু বিতর্কিত মন্ত্রী পদ হারাতে পারেন। দেখা যাক।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মন্ত্রণালয় হারানোর পর দলের শীর্ষ নেতাদের উদ্ধৃত করে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বলেছে, এতে তিনি নাকি দলকে আরও সময় দিতে পারবেন। মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদকের কাজে নাকি তিনি যথেষ্ট সময় দিতে পারেননি।
এটা বুঝতে পাঁচ বছর লাগল! পাঁচ বছর এ জন্য যে তর্কের খাতিরে ধরে নিচ্ছি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর কোথায়, কোন কােজ কী সময় দিতে পারবেন তা বুঝতে বুঝতে এক বা দেড় বছর পেরিয়ে যেতে পারে। তারপরও আরও পাঁচ বছর?
অবশ্য বিষয়টা যখন ‘পদ’, তখন ছোটখাটো সাধারণ বিষয় বুঝতে অনেক কসরত লাগে। সারা দেশের পর ঢাকা মহানগর নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা মহানগরের দলীয় নেতা অর্থাৎ মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ারও মন্ত্রিত্বের কারণে তাঁর দলীয় দায়িত্ব পালনে অসুবিধা বা সময়ের টানাপোড়েনে পড়ার কথা। ‘আশরাফ লজিক’ কি এখানে প্রযোজ্য হবে? উদাহরণ যখন টানছি, তখন খোদ প্রধানমন্ত্রী? প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়াও তাঁকে সামাল দিতে হয় অন্তত আধা ডজন মন্ত্রণালয়। এত কিছু করে দলীয় সভাপতির দায়িত্ব সুচারু রূপে পালন করা কষ্টসাধ্য। অবশ্য সামান্য মন্ত্রীর ব্যাপারে যেটা প্রযোজ্য, সেটা খোদ প্রধানমন্ত্রীর বেলায় প্রযোজ্য না হওয়াই স্বাভাবিক। মোদ্দা কথা ‘আশরাফ লজিক’ বা দলের জন্য মন্ত্রিত্ব ছাড়া খুব জুতসই ঠেকছে না, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা। রাখঢাক করলে দলের জন্য ভালো হয় না।
আপিল বিভাগের রায়ের পর মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া নিঃসন্দেহে সাংসদ থাকার অযোগ্য হয়ে পড়েছেন। সংবিধানের কোনো কিছু লঙ্ঘন করলে কী শাস্তি বা পরিণতি হবে সেটা কোথাও বলা নেই, দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া। প্রথম ব্যতিক্রম, যেটা ১৯৭২-এর সংবিধানে ছিল এবং এখনো আছে, তা হলো কেউ সংসদ সদস্য না হয়েও সংসদ অধিবেশনে যোগদান করেন তাহলে ওইরূপ বেআইনিভাবে সংসদ অধিবেশনে উপস্থিত হওয়ার জন্য প্রতিদিন জরিমানা হবে এক হাজার টাকা।
মায়া সাহেব বিচারিক আদালতের রায়ে বর্তমানে একজন দোষী সাব্যস্ত হওয়া ১৩ বছরের কারাবাসের সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী। সত্য, রায়ের বিরুদ্ধে তাঁর আপিল বিচারাধীন। আপিল বিচারাধীন থাকলে যদি সংসদ সদস্যপদ বহাল থাকে তাহলে তাঁদের বিরুদ্ধে চলমান ফৌজদারি মামলার ব্যাপারে কোনো বিএনপি নেতা-কর্মীর উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। দোষী সাব্যস্ত হয়ে তাঁদের যদি সাজাও হয় তাঁরা সবাই আপিল দায়ের করে আপিল বিচারাধীন আছে এই যুক্তিতে আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। তখন সেটা হবে ‘মায়া লজিক’।
যে যেই পদের যোগ্য, সে সহজেই বিতর্ক এড়াতে বা বৃহত্তর স্বার্থে (যেমন: দলের ভাবমূর্তি, সহকর্মীদের মান-সম্মান, দেশ-গণতন্ত্র ইত্যাদি) পদত্যাগ করতে পারে। অধমের ধারণা, যারা পদ পাওয়ার যোগ্য নয়, তারা কোনোমতে একবার পদ পেলে যেকোনো মূল্যে তা ধরে রাখতে চেষ্টা করে। সরকার, দল, দেশ, গণতন্ত্র—সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত হোক, আমার পদে থাকা চাই-ই চাই। আরও একটা সমস্যা আছে। বিদেশে যে মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেন তাঁদের পুরোনো পেশায় বা কাজে বা ব্যবসায় যোগ দিতে অসুবিধা হয় না অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায়। আমাদের বেশির ভাগ মন্ত্রীর এই ‘অপশন’টা নেই, তাই পদত্যাগের প্রশ্নই আসে না!


কয়েক দিন ধরে ‘নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ’ ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ চিল্লাচিল্লিতে কান ঝালাপালা। সংবিৎ ফিরে পেলাম বিবিসি টেলিভিশনের ‘স্ক্রলে’ বাংলাদেশে পদদলিত হয়ে ২৭ জন মারা যাওয়ার শিরোনামে। সাততাড়াতাড়ি দেশি চ্যানেল ধরলাম।
আজকের (১১ জুলাই) পত্রিকায় খবর দেখলাম, পুলিশ বলছে জাকাতের শাড়ি, লুঙ্গি দিতে হলে আগেভাগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে খবর দেওয়া উত্তম।
চাকরির জন্য সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে শত শত নিরীহ চাকরিপ্রার্থীর সলিলসমাধি হয়েছে। অধমের আদি নিবাস সিলেট অঞ্চল থেকে গত শতাব্দীর প্রথম ভাগে অর্থাৎ প্রায় এক শ বছর আগে থেকে কলকাতা হয়ে জাহাজে চড়ে বহু লোক বিলাতে গিয়েছিল চাকরির খোঁজে। এ ধরনের পরিণতি কারও হয়েছে বলে শুনিনি।
১৯৭১-এর পর গণকবরে শায়িত হলো বাঙালি, চাকরির খোঁজে যাওয়ার পরিণতি হিসেবে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীর মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ব্যাপারে গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট (জিটুজি) নীতির পরিণামে গত তিন বছরে বৈধপথে মালয়েশিয়া যেতে পেরেছে মাত্র হাজার ১১, যেখানে যেতে পারত হয়তো লাখ তিনেক। তিন বছর ধরে গোঁ ধরে ছিলেন সরকার ম্যান পাওয়ারের ব্যবসা করবে। পরিণাম আমরা সবাই দেখলাম। দায়ী মন্ত্রীর উন্নতি হলো।
যেভাবে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার কারণেই হয়তো—সঠিক কারণ জানা নেই—আজকাল ঢাকার সবচেয়ে দামি হোটেলগুলোর সবচেয়ে দামি রেস্তোরাঁয় ইফতার-ডিনার খেতে লাগে জনপ্রতি তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা। অত্যন্ত অভিজাত সালোয়ার-কামিজের দোকানে সর্বনিম্ন মূল্য ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা আর ঈদ উপলক্ষে পাঁচ-সাত দিনের ঈদ টুরে গৃহকর্মী, আয়াকে নিয়ে যাচ্ছেন বিমানে নানা রকমের আয়েশের টিকিট কেটে। সুইস ব্যাংকে ডলার, কানাডা-মালয়েশিয়ায় বাড়ি তো আছেই।
জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ করার আগে পাঠক অবশ্যই পুলিশকে খবর দেবেন। জেলা প্রশাসনকেও বলতে ভুলবেন না।
বলা তো যায় না দেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ। রাজনীতিবিদ, তাঁদের চাঁদাবাজ-টেন্ডারবাজ দোসর, আমলা-সরকারি কর্মকর্তা (আজকাল কর্মচারীরাও পিছিয়ে পড়তে নারাজ) আর ভেজালি ব্যবসায়ীদের জন্য এটা মারহাবা-মারহাবা করার দেশ।
পাঁচ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। তিন বেলা খেতে পায় না অন্তত দেড় কোটি মানুষ।
আর আমরা নিম্ন মধ্যম আয়ের উল্লাস করছি সামান্য একটা শাড়ির জন্য পদদলিত হয়ে পিষ্ট লাশের ওপর দাঁড়িয়ে।
ড. শাহদীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট।