পদ্মা সেতুর আনন্দ, বানভাসির কষ্ট ও লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা

বন্যা উপদ্রুত এলাকার সব মানুষ নিঃসম্বল হয়ে পড়েছে। ঘরে খাবার নেই। ঈদ করবে কী করে

বাংলাদেশের মানুষের কপাল এমনই মন্দ যে একটি আনন্দের খবরের রেশ না কাটতেই অনেকগুলো দুঃখ এসে ভিড় জমায়। গত ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর সবাই ভেবেছিলেন, এবার দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ স্বস্তিতে বাড়িতে গিয়ে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন। কেবল দক্ষিণের মানুষ কেন, যাঁরা ঈদের ছুটিতে কুয়াকাটাা, সুন্দরবন কিংবা কলকাতা যাবেন, সড়কপথে তাঁদের যাত্রা সময়–সাশ্রয়ী হবে। ২৬ জুন থেকে যাঁরা সেতু পার হয়ে দক্ষিণাঞ্চলে গেছেন, তাঁরা দ্রুত ও নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছেন। আশা করি, তাঁদের ফিরতিযাত্রা আনন্দদায়ক হবে।

কিন্তু বাংলাদেশের সব মানুষ তো পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যাওয়া–আসা করবে না। এর বাইরে যে বিশাল জনগোষ্ঠী, তাদের বাড়ি যেতে হয়েছে নানা যন্ত্রণা ও বিড়ম্বনা সহ্য করে। পত্রিকা ও টেলিভিশনে দেখলাম, যেভাবে মালের বস্তা বাইরে থেকে ভেতরে ফেলা হয়, সেভাবে মানুষকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে ট্রেনের জানালা দিয়ে। ছাদের ওপরে চড়েও অনেকে যাচ্ছেন। এরপরও তঁারা গ্রামে যান স্বজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিতে। এই মানুষগুলো জীবিকার জন্য শহরে থাকলেও শহর কখনো তাঁদের আপন করে নেয় না।

আবার এই শ্রমজীবী মানুষের একটা বড় অংশ বেতন–ভাতা না পাওয়ায় ঈদে বাড়ি যেতে পারবেন না। শুক্রবার প্রথম আলোর খবর: ‘সব কারখানা শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেয়নি’। বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত ৫৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ কারখানা জুন মাসের বেতন পরিশোধ করেছে। আর বোনাস পরিশোধ করেছে ৮৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ। কারখানার মালিকদের যুক্তি, বেতন-বোনাস দুটি দিয়ে দিলে শ্রমিকেরা বেশি দিন বাড়ি থাকবেন। কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হবে। শ্রমিকেরা মালিকদের কাছে অগ্রিম বেতন চাইছেন না। যে মাসে কাজ করেছেন, সেই মাসের বেতন পাওয়া তাঁদের হক। মালিকেরা বরাবর নিজেদের স্বার্থই বড় করে দেখেন। ঈদের ছুটি নিয়ে প্রতিবারই মালিকেরা টালবাহানা করেন। মালিকেরা বেতন-বোনাসটা আগে দিলে শ্রমিকদের ঈদযাত্রায় ভোগান্তিটা কম হতো। গতকাল পর্যন্ত উত্তর-উত্তর পূর্বাঞ্চলে প্রায় সব সড়কে প্রচণ্ড যানজট ছিল। ভাড়াও বেশি গুনতে হয়েছে।

হাওর অঞ্চলে দফায় দফায় বন্যা হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছে। তাদের খেতের ফসল, গোলার ধান ভেসে গেছে। অনেকে হাঁস–মুরগি–গবাদিপশুও রক্ষা করতে পারেননি। কোনো কোনো এলাকায় নতুন করে পানি উঠেছে। এ অবস্থায় হাওরপারের ও সোমেশ্বরীর তীরের লাখ লাখ মানুষ ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে। নেত্রকোনার দুর্গাপুরের গাঁওকান্দিয়া এলাকার এক ব্যবসায়ী আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘বন্যা আমাদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। আমাদের এবার কোনো ঈদ নেই। কোরবানির গরু কেনা তো অসম্ভব।’ অথচ গত বছর তিনি ১ লাখ ১০ হাজার টাকা দিয়ে কোরবানির গরু কিনেছিলেন। বন্যা উপদ্রুত এলাকার সব মানুষ নিঃসম্বল হয়ে পড়েছে। ঘরে খাবার নেই। ঈদ করবে কী করে?

প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক–ই–ইলাহী চৌধুরীর আশা, সেপ্টেম্বর নাগাদ বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তিনি কিসের ভিত্তিতে এই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন? এই সময়ের মধ্যে যদি ইউক্রেন যুদ্ধ না থামে, যদি আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও গ্যাসের দাম বাড়তেই থাকে, তাহলে কোনো সাশ্রয়ী পরিকল্পনাই কাজে আসবে না।

অতীতে দেখেছি, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় রাজনীতিকেরাই সবার আগে এগিয়ে আসেন বিপন্ন মানুষকে সহায়তা করতে। এবার তাঁরাই সবার পেছনে। কয়েক দিন আগে সিলেটে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল সমাবেশ করে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করল। এরপর আওয়ামী লীগ ও একটি বড় দল সেখানে গেল ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করতে। দুই দলের নেতারা ত্রাণসামগ্রী বিতরণের ফটোসেশন করে চলেও এসেছেন। কিন্তু তাঁরা যদি একবার সাহায্যপ্রার্থী মানুষগুলোর জীর্ণ পোশাক ও শীর্ণ চেহারার দিকে তাকাতেন, বাহাসে লিপ্ত হতে পারতেন না। লজ্জা পেতেন। এক মুঠো ত্রাণসামগ্রীর জন্য যখন অভাবী মানুষের দীর্ঘ সারি দেখি কিংবা ন্যায্যমূল্যের বিক্রয়কেন্দ্রের সামনে বয়স্ক নারী-পুরুষের সামনে নিরুপায় তরুণেরা ভিড় করেন, তখন মনে হয় আমাদের উন্নয়নে মস্ত বড় ফাঁকি আছে। উন্নয়নের সুফল বৃহত্তর জনগোষ্ঠী পায়নি। পেয়েছে কতিপয় মানুষ।

বিএনপি সরকার বিদ্যুতের উন্নয়নে কিছু করেনি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হতো। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে যখন বিদ্যুৎ–সংকট মোকাবিলায় বড় বড় প্রকল্প হাতে নিল, পরিবেশের ঝুঁকি সত্ত্বেও মানুষ সমর্থন জানাল। সংকট মোকাবিলার আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হলো। সংসদে আইন পাস করে এদের দায়মুক্তিও দেওয়া হলো।

কিন্তু সরকার নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে যতটা উৎসাহ দেখিয়েছে, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাস উত্তোলনে ততটাই নিস্পৃহ ছিল। গ্যাস অনুসন্ধান, আবিষ্কার ও উত্তোলন অনেক পরিশ্রমের কাজ। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা সেই কষ্টকর পথে না গিয়ে তেল ও এলএনজি (লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস) আমদানির দিকে ঝুঁকেছেন। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে যে বিরোধ ছিল, সরকার তা নিষ্পত্তি করল। সমুদ্র জয়ের কৃতিত্ব নিল। কিন্তু সেই সমুদ্রের নিচে যে গ্যাস আছে, তা অনুসন্ধান বা উত্তোলনের চেষ্টাই করল না। মিয়ানমার তাদের সমুদ্রসীমায় গ্যাস উত্তোলনের কাজ শুরু করেছে। আমরা পারলাম না। এই ব্যর্থতার দায় নিশ্চয়ই ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির ওপর চাপানো যাবে না।

যখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কম ছিল, সরকার লাভ করেছে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি কমিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে চাইছে। এটি কতটা বাস্তবসম্মত, তা–ও ভেবে দেখার বিষয়। শপিং মল, মার্কেট আটটার পর বন্ধ রেখে, সামাজিক অনুষ্ঠানে আলোকসজ্জা না করে কিংবা অফিসের সময় কমিয়ে কিছু বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা যাবে। এমনকি বাসাবাড়িতেও বিদ্যুতের ব্যবহার কমানো যাবে। কিন্তু শিল্পকারখানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ কমালে পণ্য উৎপাদন কমবে। উৎপাদন কমলে রপ্তানি কমবে। আমদানিনির্ভর অর্থনীতিকে আরও ঝুঁকিতে ফেলবে।

প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক–ই–ইলাহী চৌধুরীর আশা, সেপ্টেম্বর নাগাদ বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তিনি কিসের ভিত্তিতে এই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন? এই সময়ের মধ্যে যদি ইউক্রেন যুদ্ধ না থামে, যদি আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও গ্যাসের দাম বাড়তেই থাকে, তাহলে কোনো সাশ্রয়ী পরিকল্পনাই কাজে আসবে না।

ঢাকার বাইরে বিদ্যুতের লোডশেডিং চলে আসছিল বহুদিন ধরে। এখন রাজধানী শহরও যুক্ত হলো। উন্নয়নে আমরা সমতা না আনতে পারলেও লোডশেডিংয়ে সমতা এনেছি। এটাই বা কম কী!

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]