পরাজিত হলে ট্রাম্প কি রায় মানবেন

ডোনাল্ড ট্রাম্প, জো বাইডেন
ডোনাল্ড ট্রাম্প, জো বাইডেন

আগামী নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প পরাজিত হলে কি নির্বাচনের ফল মেনে নেবেন? প্রশ্নটি উঠেছে জো বাইডেনের এক কথার সূত্র ধরে। বাইডেন ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিসেবে ট্রাম্পের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। গত মাসে এক সাক্ষাৎকারে বাইডেন বলেন, ট্রাম্প নির্বাচনে পরাজিত হলে হোয়াইট হাউস থেকে সরে যেতে আপত্তি করতে পারেন।

বিষয়টি হালকাভাবে নেওয়ার কারণ নেই। ট্রাম্প কখনোই কোনো ব্যাপারে পরাজয় মেনে নেন না; নিজের ভুল স্বীকার করেন না। তিনি নিজেকে আমেরিকার সেরা প্রেসিডেন্ট মনে করেন। এমন একজন আত্মপ্রেমী প্রেসিডেন্ট বিনা ‘যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনী’ ত্যাগ করবেন, এটা ভাবার কারণ নেই।

আগামী নির্বাচনে ট্রাম্প পরাস্ত হতে পারেন, এমন সম্ভাবনা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। জনমত জরিপগুলোতে ট্রাম্পের তুলনায় বাইডেন ১০–১৪ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন। রিপাবলিকান নেতৃত্ব নির্বাচনী জনমত জরিপগুলো পড়েন। বিপদটা তাঁরাও টের পাচ্ছেন। প্রবীণ রিপাবলিকান সিনেটর চাক গ্রাসলি এক টুইটে ট্রাম্পকে নিজেকে শুধরে নেওয়ার অনুরোধ করেছেন। তিনি হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেছেন, ব্যাপারটা ট্রাম্পকে বোঝাও।

ট্রাম্প সহজে পরাজয় মেনে নেবেন না—এ রকম ভাবার একাধিক কারণ আছে। তিনি কয়েক সপ্তাহ ধরে বলে আসছেন, আগামী নির্বাচনে ভোট ‘চুরির পাঁয়তারা’ চলছে। চুরিটা হবে ডাক-ভোটের মাধ্যমে। ডেমোক্র্যাটরা করোনার নাম করে ডাক মারফত ভোটের দাবি করে আসছেন—এর একমাত্র কারণ এভাবে সহজে কারচুপি করা যায়। একজনের ভোট অন্যজন দেবে, ব্যালট পেপার চুরি করা হবে, ইত্যাদি। ট্রাম্প তাই ডাক-ভোটের তীব্র বিরোধিতা করছেন। তিনি আগেও ডাক-ভোটের সমালোচনা করেছিলেন। ২০১৬ সালের নির্বাচনে তিনি হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে ৩০ লাখ ভোট কম পেয়েছিলেন। তখন ট্রাম্প বলেছিলেন, ওসব ছিল জাল ভোট। ২০১৮ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টি প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ হারালে ট্রাম্প বলেছিলেন, সেটাও নাকি জাল ডাক-ভোটের কারণে।

কিন্তু ডাক-ভোট নিয়ে অধিকাংশ সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, ডাক-ভোটের মাধ্যমে কারচুপির প্রমাণ নেই। নির্দলীয় হিসেবে পরিচিত ব্রেনন সেন্টার ফর জাস্টিস গত কয়েকটি নির্বাচনের ফলাফল সমীক্ষা করে বলেছে, আমেরিকার কোনো নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, এমন সম্ভাবনা সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক শূন্য শূন্য শূন্য ৩ শতাংশ।

কিছু পর্যবেক্ষকের ধারণা, ডাকযোগে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা হলে ডেমোক্র্যাটদের বেশি সুবিধা হবে। বিভিন্ন অশ্বেতাঙ্গ ভোটার গোষ্ঠী (বিশেষত আফ্রিকান-আমেরিকান) এবং যুবক বয়সী ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার আগ্রহ কম। করোনা মহামারির কারণে আরও অনেক ভোটার ভোটকেন্দ্রে যেতে ইতস্তত করতে পারে। ডাকের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকলে তারা ভোট দেবে। ফলে নির্বাচনে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বেশি ভোট পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। ডাক-ভোটের ব্যাপারে ট্রাম্পের আপত্তির কারণ এটাই। কদিন আগে তিনি টুইটারে লিখেছেন, ডাক-ভোটে নির্বাচন হলে কারচুপি হবেই। প্রমাণ ছাড়া এমন কথা লেখা হয়েছে বলে টুইটার কর্তৃপক্ষ ট্রাম্পের ওই বক্তব্য ‘ভিত্তিহীন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।

প্রমাণ ছাড়া নানা গুজব ছড়ানো ট্রাম্পের পুরোনো অভ্যাস—এ কথা উল্লেখ করে নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে লিখেছে, জনমত জরিপে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ায় ট্রাম্প আগামী নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগাম ব্যবস্থা করে রাখছেন। রিপাবলিকান নেতৃত্বের একাংশ ট্রাম্পের এই অভিযোগের সঙ্গে সুর মিলিয়েছে। ‘অনেস্ট ইলেকশনস প্রজেক্ট’ নামের এক রক্ষণশীল গ্রুপ ডাক-ভোটের বিরুদ্ধে কয়েক লাখ ডলারের প্রচারণা শুরু করেছে। তবে রিপাবলিকান নেতৃত্বের সবাই যে ট্রাম্পের এই রণকৌশলে খুশি তা নয়। ডাক–ভোটের সুযোগ থাকলে ভোটদানের সম্ভাবনা পাবে, তা ডেমোক্রেটিক–রিপাবলিকান উভয় দলের ক্ষেত্রেই সত্য। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নিজেই যদি এর বিরোধিতা করেন, তাহলে ডাক-ভোটে অংশগ্রহণের পক্ষে প্রচারণা করা রিপাবলিকানদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে।

নির্বাচনের রায় বিপক্ষে গেলে ট্রাম্প তা মানবেন না, এমন বিতর্কের ফলে মার্কিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর মার্কিন জনগণের আস্থা কমছে। দক্ষিণপন্থী একাধিক ওয়েবসাইট বলেছে, তারা শুধু এমন ফলাফল প্রত্যাখ্যানই করবে না, বিদ্রোহেও অংশ নেবে। মার্কিন কংগ্রেসে অভিশংসনের বিরোধিতা করে ট্রাম্পের নিকট মিত্র রজার স্টোন সাবধান করে বলেছিলেন, ট্রাম্পকে ক্ষমতা থেকে সরানোর চেষ্টা হলে ‘অভূতপূর্ব বিদ্রোহের সূচনা হবে।’ ট্রাম্পের আরেক সাবেক মিত্র ও ব্যক্তিগত আইনজীবী মাইকেল কোহেন গত বছর কংগ্রেসের এক শুনানিতে বলেন, ‘আমার ভয়, ২০২০ সালে ট্রাম্প পরাজিত হলে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না।’ একই সতর্ক বার্তা দিয়েছেন সাবেক শ্রমমন্ত্রী রবার্ট রাইশ। তিনি গার্ডিয়ান পত্রিকায় সম্প্রতি এক কলামে লিখেছেন, ‘ভয়ানক বিপদ হতে পারে।’

বিপদ আছে তা ঠিক, কিন্তু এই বিপদকে অতিরঞ্জিত করা হচ্ছে তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। নির্বাচনের ফলাফলে দুই প্রার্থীর ব্যবধান খুব কম হলে, যেমন ২০০০ সালে জর্জ বুশ বনাম আল গোরের বেলায় হয়েছিল, তেমন হলে আইন-আদালত পর্যন্ত ব্যাপারটা গড়াবে। সুপ্রিম কোর্টে এখন রক্ষণশীলদের সংখ্যাধিক্য। ফলে তাঁরা যদি ট্রাম্পকে জিতিয়ে দেন, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। হার্ভার্ডের অধ্যাপক স্টিফেন লেভিটস্কি বলেছেন, অল্প ভোটে পরাস্ত হলে ট্রাম্প যে ভোট চুরির অভিযোগ তুলবেন, এটা নিশ্চিত। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলে যদি বড় রকমের ব্যবধান ঘটে, তাহলে গলা উঁচিয়ে যতই সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ তোলা হোক, তা ধোপে টিকবে না। নির্বাচনে ট্রাম্প পরাস্ত হলে রিপাবলিকানরা সিনেটেও নিয়ন্ত্রণ হারাবে বলে ভাবা হচ্ছে। তাহলে সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদ দুটোই ডেমোক্র্যাটদের দখলে আসবে। কংগ্রেসের উভয় কক্ষের বিরোধিতার মুখে বড় গলা করে চোর-পুলিশ খেলার মুখ রিপাবলিকান নেতৃত্বের থাকবে না।

বড় কথা হলো আমেরিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অতটা ঠুনকো নয়। প্রায় আড়াই শ বছর দেশটির বয়স, অনেক ঝড়-ঝাপ্টা তাকে পোহাতে হয়েছে। সব সামলে জনগণ গণতন্ত্র আগলে রেখেছে। এই অর্জন তারা সহজে বিসর্জন দেবে না।

এই সত্যটা ট্রাম্প নিজেও জানেন। তাঁর এই মুহূর্তের হম্বিতম্বি আসলে রাজনৈতিক খেলা, নিজের অনুগত সমর্থকদের মনোবল চাঙা রাখার চেষ্টা মাত্র। কদিন আগে ফক্স নিউজ তাঁকে প্রশ্ন করেছিল, নভেম্বরে হেরে গেলে এরপর তিনি কী করবেন? জবাবে ট্রাম্প দার্শনিকের মতো বলেছিলেন, ‘না জিতলে না জিতব, কিন্তু সেটা আমাদের দেশের জন্য বড় দুঃখের ঘটনা হবে।’

সত্যি? এ প্রশ্নের উত্তর পাঠকের হাতেই ছেড়ে দিলাম।

হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক