পরাণ আমার প্রিয় বন্ধু

শামসুন্নাহার রহমান
শামসুন্নাহার রহমান

পরাণের (শামসুন্নাহার রহমান) সঙ্গে আমার পরিচয় কাজের মাধ্যমে। সদা হাস্যমুখ সুমিষ্টভাষী পরাণ। আমরা দুজনে গল্প করতে বসলেই মুহূর্তের মধ্যে কর্মজগতে প্রবেশ করতাম নিজের অজান্তেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী বিধ্বস্ত পরিবারের নির্যাতিত নারীরা কেমন আছেন? শিশুরাই–বা কেমন আছে? তারা দুবেলা খেতে পারছে তো? প্রাণে বেঁচে থাকার মতো শক্তি তাদের আছে তো? এই অসহায় নারী-শিশুদের জন্য কী করা যায়? কীভাবে তাদের সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা যায়? কীভাবে তাদের আত্মনির্ভরশীলভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করা যায়? নারী উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন—সে তো পরবর্তী পর্যায়ের বিষয়। প্রথমত, তাদের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের ব্যবস্থা, মানসিকভাবে স্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টির ব্যবস্থা ইত্যাদি মৌলিক চাহিদা কীভাবে মেটানো যায়। এসব চিন্তাই পরাণের অন্তরকে অহরহ দগ্ধ করত। আর আমাদের মতো যারা সঙ্গী ছিল তাদের সঙ্গে আলোচনা করত এসব কঠিন সমস্যা থেকে উত্তরণের কথা। এভাবে দিনের পর দিন আমাদের আলোচনা চলত আর আমরা এসব প্রাথমিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিভিন্ন কৌশলের কথা গভীরভাবে চিন্তা করতাম।
পরাণের প্রতিষ্ঠিত ঘাসফুলকে কীভাবে একটা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো যায়, এটাই ছিল তখন তার কর্মজগতের বিষয়বস্তু। ঘাসফুলকে ঘিরে তার নানা স্বপ্ন। এবং এই স্বপ্নকে কেমন করে সফল করা যায়, এর মাধ্যমে এই ছিন্নমূল নারী-শিশুকে কীভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা যায়—এসব চিন্তাই ছিল তার শয়নে-স্বপনে-জাগরণে। স্বপ্নকে বাস্তব রূপদান করার জন্য যে মনোবল, আত্মবিশ্বাস এবং মানসিক উদ্যম প্রয়োজন, তার কোনো কিছুরই তো ঘাটতি ছিল না পরাণের মধ্যে। এই দুর্বার শক্তি নিয়ে সে একটি অঙ্কুর থেকে ঘাসফুলকে বহু শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত করল। শূন্য থলে হাতে নিয়ে শুরু করে এগিয়ে গেল বিপুল প্রত্যয় নিয়ে। আর সে শূন্য থলে সোনার থলেতে পরিণত করল ঘাসফুলকে পরিপূর্ণতা দিয়ে।
আমার স্মৃতিতে পরাণ দুপুরের সূর্যের মতো একটি প্রাণবন্ত তারকা। আবার সে চাঁদের জ্যোৎস্নার মতো স্নিগ্ধতায় সিক্ত একটি ব্যক্তিত্ব। স্মৃতির বেদনা অনুভব করা যায় কিন্তু স্পর্শ করা যায় না। তাই স্মৃতিকে আমরা বহন করেই চলি অন্তরের গভীরে। একটি আনন্দঘন ঘটনা আমার স্মৃতিতে উদিত এই মুহূর্তে যখন পরাণকে স্মরণ করতে বসেছি।
আমি তখন ইউনিসেফে নারী উন্নয়ন কর্মসূচির প্রধান। বিশেষ কাজে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। খবর পেয়েই পরাণ আমাকে ফোন করল। তার স্বভাবজাত বিনম্রতায় ঘাসফুলে যাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করল। বহুদিন পর প্রিয় বন্ধুর সুমধুর কণ্ঠস্বর শুনে আমি অত্যন্ত আনন্দবোধ করলাম। নির্ধারিত দিনে গেলাম চট্টগ্রাম ঘাসফুল অফিসে। যা দেখলাম তাতে চমৎকৃত হলাম। সুবিধাবঞ্চিত নারীরা বিভিন্ন পেশায় দক্ষতা লাভ করে কীভাবে আত্মনির্ভর হতে পারেন—এই দৃষ্টিকোণ থেকে নানা কর্মসূচি দিয়ে সাজানো হয়েছে ঘাসফুলকে। দেখলাম নারীরা নানা ধরনের হস্তশিল্প, দরজি বিজ্ঞান, সূচিশিল্প, উল বুনন, মৃৎশিল্প, বেতের কাজ ইত্যাদি কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষণরত। তার সঙ্গে লেখাপড়াও শিখছেন, যেন নিজের নাম-ঠিকানা লিখতে পারেন। কাজের হিসাব, টাকাপয়সার হিসাব রাখতে পারেন। এ ধরনের সহজ শিক্ষার পাঠ নেওয়াটাও যে প্রাথমিকভাবে তাঁদের জন্য অত্যাবশ্যক—এই অন্তর্দৃষ্টিও পরাণের মধ্যে দেখেছিলাম। তখন এত এনজিও ছিল না। সুতরাং আমাদের অভিজ্ঞতার ভান্ডারও তেমন সমৃদ্ধ ছিল না। এ পর্যায়ে পৌঁছাতে পরাণকে প্রচুর সংগ্রাম করতে হয়েছে।
অন্য ঘরে দেখলাম ছিন্নমূল শিশুরা লেখাপড়া শিখছে। তাদের জন্য পরাণ বিনা পয়সায় শিশুশিক্ষার উপযুক্ত বই-খাতা-পেনসিল ইত্যাদির ব্যবস্থা করেছে। এ ছাড়া এক বেলা টিফিনেরও ব্যবস্থা করেছে। দেখলাম পরাণকে তাদের সবার সঙ্গে বিনা দ্বিধায় অতি সহজ-সরল ভাষায় কুশল বিনিময় করতে। পরাণ নিঃসংকোচে তাদের বুকে টেনে নিয়ে আন্তরিক ভালোবাসা দিয়ে বলেছিল, ‘তোমরা আমার পরিবারের প্রিয় সদস্য।’ আরও বলেছিল, ‘আমরা সকলেই মানুষ। মানুষের মতো আত্মমর্যাদা নিয়ে সকলকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে।’ এভাবে তাদের আর পরাণের মধ্যে কোনো বিভেদ না রেখে সবাইকে নিজের মনের মতো মানুষ তৈরি করার সংকল্প নিয়ে সম্মুখের দিকে ছিল তার সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি।
সেদিন এই সমাজের অবহেলিত নারীদের সঙ্গে মাটিতে একই পাটিতে বসে পরাণ তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করল। আমিও বসলাম। মামুনা খাতুন (ছদ্মনাম) তাঁর বেদনাসিক্ত অতীত কাহিনি শোনালেন। শোনালেন মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কীভাবে নির্যাতিত হয়েছেন, লাঞ্ছিত হয়েছেন, পরবর্তী সময়ে তাঁর কোথাও ঠাঁই ছিল না, সমাজ গ্রহণ করেনি নষ্ট নারী আখ্যায়িত করে। ‘এই দুর্দিনে যাঁর কোমল স্পর্শে সঞ্জীবিত হলাম, তিনি আর কেউ নন, পরাণ আপা। তাঁর আকাশের মতো উদার, সমুদ্রের মতো বিশাল হৃদয়ে আশ্রয় পেলাম। ধীরে ধীরে একটা তৃণ ধরে দাঁড়ানোর শক্তি সঞ্চয় করলাম। নিজের অস্তিত্বকে খুঁজে পেলাম। জীবনে প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করলাম, নারীরাও মানুষ। আমিও মানুষ। নিজের মধ্যে যে অর্থ দুহাতে স্পর্শ করলাম, জীবনের অর্থ খুঁজে পেলাম। ভাবলাম সুকঠিন পথপরিক্রমা অতিক্রম করে অনেক দূর এগিয়েছি। মানুষের দৃষ্টি সম্মুখের পানে রাখতে হয় সর্বদা। এ শিক্ষা পেয়েছি পরাণ আপার কাছে।’ মামুনার গল্পের এখানেই ইতি টানছি। এবার নিজের কথায় আসি।
প্রিয় পরাণ,
ভোরের ফুরফুরে হাওয়ায় নারীরা যখন দল বেঁধে কর্মক্ষেত্রের দিকে অগ্রসর হন, তাঁদের যাত্রাধ্বনিতে শুনতে পাই তোমার সুমধুর কণ্ঠস্বর। হয়তো ঘাসফুলে প্রশিক্ষিত নারীদের সার্থকতা দেখে তোমার আত্মা শান্তির পরশে ঘুমিয়ে আছে। তুমি আমাদের মাঝে নেই। চলে গেছো জীবন-মরণের সীমানা ছাড়িয়ে দূরে-বহুদূরে। কিন্তু তোমার মহান কর্ম যে তোমার উপস্থিতি ঘোষণা করে চলেছে প্রতিনিয়ত। যে দীপ জ্বালিয়ে গেছো, তার প্রদীপ্ত শিখা প্রজ্বলিত থাকবে অনন্তকাল।
জওশন আরা রহমান: সাবেক পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির প্রধান, ইউনিসেফ।