পরামানিক প্রসঙ্গ

পাকিস্তান আমলের গভর্নর জেনারেল অশীতিপর বৃদ্ধ গোলাম মোহাম্মদ করাচি থেকে ঢাকায় তসরিফ এনেছেন। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদকে বিমানবন্দরে মাল্যদানপূর্বক বরণ করে নিলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে তাঁকে অভিনন্দিত করা হলো। শেরেবাংলা ফজলুল হকও তখন অশীতিপর বৃদ্ধ। তো কার্জন হলের সেই মজলিশে শেরেবাংলা ও গোলাম মোহাম্মদ—এ দুই বয়োবৃদ্ধকে পাশাপাশি বসে কথাবার্তা বলতে ও হাসাহাসি করতে দেখে তখনকার উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক নেতারা খুব উৎফুল্ল বোধ করতে লাগলেন। কিন্তু পরে যখন শেরেবাংলাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলো, তখন নাকি তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ অট্টহাসি হেসে বলেছিলেন, ‘আমি ওর কথা কিছুই বুঝতে পারি নাই, সে–ও আমার কথা বুঝতে পারে নাই; দুজনে না বুঝেই হাসছি।’
তা শুরুতেই এই উপাখ্যানটির অবতারণা কেন, সেটাই তাহলে খুলে বলি।
গোটা মার্কিন মুল্লুকটা ফাস্টফুডের দোকানে ছেয়ে গেছে। এগুলোকে বলা হয় ‘ফ্র্যাঞ্চাইজ’ দোকান। লিট্ল সিজার শীর্ষক ফ্র্যাঞ্চাইজ পিৎজার দোকান এগুলোর একটি। রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারকে প্রথম তাঁর মায়ের পেট কেটে ধরাধামে নিয়ে আসা হয়েছিল বিধায় এ ধরনের প্রসবকে বলা হয় ‘সিজারিয়ান’; আর তিনি তাঁর সময়ে পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিধর নৃপতি ছিলেন বিধায় এশিয়া মাইনরের একটি দেশ অনায়াসে জয় করে রোমে লিখে পাঠিয়েছিলেন: ‘আমি এলাম, দেখলাম, জয় করে নিলাম।’ এহেন ব্যক্তির নামানুসারেই পিৎজার এই দোকানগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে ‘লিট্ল সিজার’।
নিউইয়র্কে বসবাসরত আমার এক নিকটাত্মীয় এ ধরনের চারটি দোকানের মালিক। তিনি সেলুনে চুল কাটতে যাওয়ার সময় যখন বললেন, ‘চলুন, আপনারও চুল কাটিয়ে নিয়ে আসি’, তখন আমার মনে পড়ে গিয়েছিল বহু পূর্বে শ্রুত মজার গল্পটি: একটি লোক সেলুনে চুল কাটিয়ে অতঃপর সঙ্গের বাচ্চা ছেলেটিকে চুল কাটার চেয়ারে বসিয়ে ‘আমি আসছি’ বলে সেই যে গেল আর ফেরার নামগন্ধটি নেই। নাপিত ছেলের চুল কেটে অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর ‘তোমার বাবা তো এখনো ফিরলেন না’ বলতেই ছেলেটি বলে উঠল, উনি তো আমার বাবা নন। আমি রাস্তায় খেলছিলাম; উনি আমাকে বললেন, ‘চল, তোকে বিনা পয়সায় চুল কাটিয়ে নিয়ে আসি।’
যা হোক, গেলাম তো ওনার সঙ্গে সেলুনে। উনি বসলেন একটি চেয়ারে, আমাকে বসালেন দূরবর্তী একটি খালি চেয়ারে। যে যুবকটি আমার চুল কাটতে উদ্যত, সে স্প্যানিশ ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানে না। আর আমি মাত্র একটি স্প্যানিশ শব্দ ‘সি’ (হ্যঁা) ছাড়া আর কিছুই জানি না। কী রকম ছাঁট চাই, সেটা তাকে বোঝাব কী করে বুঝতে না পেরে কেবলই হাসতে থাকলাম, সে–ও ক্রমাগত হাসতে লাগল। সেই মুহূর্তেই আমার মনে পড়ে গিয়েছিল শুরুতে উল্লেখিত শেরেবাংলা ও গোলাম মোহাম্মদের হাসাহাসির উপাখ্যানটি।
এক হলিউডি অভিনেত্রী স্প্যানিশ ভাষায় অজ্ঞতা সত্ত্বেও মেক্সিকোর ফ্যামিলি কোর্টে অপেক্ষাকৃত সস্তায় ডিভোর্স সম্পাদন করতে গিয়ে উকিলের পরামর্শ অনুসারে হাকিমের প্রশ্নের উত্তরে ‘সি’, ‘সি’ বলতে থাকলে একপর্যায়ে কোর্টের সবাই হো হো করে হেসে উঠলে পর দুভাষীকে জিজ্ঞেস করে শুনেছিলেন, ডিভোর্স? সে তো অনেক আগেই হয়ে গেছে। এইমাত্র হাকিম সাহেবের সঙ্গে আপনার বিয়ে হয়ে গেল। তেমনিভাবে আমিও নাপিতের দু-এক প্রশ্নের উত্তরে কিছু না বুঝেই ‘সি’, ‘সি’ বলেছি। ফলাফল? আমাকে যে ছাঁট দিয়ে সে বিদায় জানাল, ঢাকায় থাকলে অন্তত এক মাস লোকসমক্ষে বেরোতে লজ্জাবোধ হতো।
বিচারপতি হাবিবুর রহমান কর্তৃক সম্পাদিত ‘যথাশব্দ’ অনুসারে নাপিত-এর প্রতিশব্দ হচ্ছে নরসুন্দর, ক্ষৌরকার ও পরামানিক। একমাথা ঝাঁকড়া চুল ছেঁটে মুখের আসল আদলটুকু বের করে নিয়ে আসে যে শিল্পী, তাকে বহুব্রীহি সমাস অনুসারে ‘নরসুন্দর’ বলাই যায়। আর ক্ষৌরকারও বুঝলাম, যে কারণে বাংলা ভাষায় একই ধরনের আচার-আচরণ বোঝাতে ‘একই ক্ষুরে মাথা মোড়ানো’ বাগধারাটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু পরামানিক? সে আবার কী এবং কেন? আমার অল্প বিদ্যায় কুলায় না।
আর হ্যাঁ, পরামানিক প্রসঙ্গ উঠলেই আমার বেশ কটি খোশগল্প মনে পড়ে যায়। ছোটবেলায় আমার আব্বা শুনিয়েছিলেন: রাজার আইবুড়ো মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না দেখে রাজা একদিন পণ করলেন, পরদিন প্রাতঃকালে যে যুবকের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটবে, তাকেই তিনি জামাতা বানাবেন। ভাগ্যচক্রে সেই যুবকটি হলো একজন সৌম্যদর্শন ক্ষৌরকার, কিন্তু রাজা সেটা জানেন না। অতএব রাজা তাঁর প্রধান উজিরের কাছে জামাই নির্বাচন কেমন হয়েছে জানতে চাইলে উজির যুবকটির দিকে একবার তাকিয়েই বলে উঠলেন, ‘ওহে দত্তের পুত, থাকিও মতে মতে; নতুবা যেই কে সেই, নাপতের ক্ষুর আর চামটি।’
এবং সেদিন একজন শোনালেন: এপার বাংলার নাপিতের ছেলে পার্টিশনের পর ওপার বাংলায় গিয়ে পারিবারিক পদবি ‘শীল’ পরিত্যাগপূর্বক ধারণ করেছে ‘ব্যানার্জি’ পদবি। তো একবার ওর গাঁয়ের একজন কলকাতায় বেড়াতে গিয়ে ওর অবর্তমানে মেস-মেইটের কাছে প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করে দিলে পরবর্তী সময়ে মেস-মেইট ওকে উদ্দেশ করে বলল, ‘এসেছিল ডি-কে দত্ত/ দিয়ে গেছে সকল তত্ত্ব/তুমি নাকি এমন তেমন।’ এটা বলে সে হাতের চেটোয় আঙুল ঘষে ক্ষুর আর চামটি প্রদর্শন করে যা বোঝানোর বুঝিয়ে দিয়েছিল।
আরেকটি গল্প আমাকে শুনিয়েছিলেন বিলেতে অনেকগুলো বছর আগে, আমাদের কাছাড় থেকে আগত এক ভদ্রলোক: জাতিতে পরামানিক দুই ভাইয়ের একজন লেখাপড়া করে হয়েছে উকিল, পদবি নিয়েছে ‘বিশ্বাস’; অপরজন ক্ষৌরকর্ম করে, পদবি রেখেছে যথারীতি ‘শীল’। তো এ ব্যাপারে বার-এর জনৈক সহকর্মী বিশ্বাসকে প্রশ্ন করলে প্রত্যুত্তরে সে বলেছিল, ‘আপনি নিশ্চয়ই আমার ভাইয়ের কাছে সপ্তাহান্তে দাড়ি কামাতে যান। সে যখন ক্ষুর হাতে থুতনির দাড়ি কামিয়ে কণ্ঠনালির দিকে এগোয়, তখন আপনার গলা কাটার ভয় হয় না?’
‘না, হয় না’, প্রশ্নকারী বললেন, ‘কেননা তার ওপর আমার বিশ্বাস আছে।’
‘আমি হলাম গিয়ে সেই বিশ্বাস।’ এবারে উত্তরদাতা একগাল হেসে বলল।
পরিশেষে আরেকটা কথা বলতে চাই। আমেরিকানদের সেন্স অব হিউমার তথা রসবোধ কিন্তু প্রচণ্ড। পিৎজা হাটের বুড়ো ম্যানেজার যখন কথা প্রসঙ্গে জানলেন আমি রিটায়ার্ড আমলা, তখন সহাস্যে বলে উঠলেন, ‘রিটায়ার করা খুব ভালো। আমিও পাঁচবার রিটায়ার করেছি।’
এটা অনেকটা মার্ক টোয়েনের সেই গল্পের মতো আরকি: মার্ক টোয়েন একবার বলেছিলেন, ‘ধূমপান পরিত্যাগ করা খুব সহজ। আমি নিজেই কয়েকবার ওটা পরিত্যাগ করেছি।’
আতাউর রহমান: রম্য লেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷