পরিপূরক আরেকটি ভাষণের অপেক্ষায়

মুজিব বর্ষের সমাপ্তি পর্যায়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সূচনাকাল। এ দুইয়ের মাঝখানে আজ স্বাধীনতার মন্ত্রে জাতির দীক্ষার দিন। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি আজ একাত্তরের অপরাহ্ণে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল। ভাষণটি বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের ইতিহাসে অনির্বাণ-শিখার মতো। এর আলো আজও আমাদের পথ দেখায়। ৫০ বছরের ব্যবধানেও এটি আজও তাজা, প্রাসঙ্গিক এবং একইভাবে উদ্দীপনাময়। এটি যেন এক কল্পতরু। জাতির প্রয়োজনে সংগ্রামের প্রেরণা-পুষ্টি জোগাতে সদাই প্রস্তুত, সদাই সক্ষম। আজ এ ভাষণের সুবর্ণজয়ন্তী।

সেদিন লাখো মানুষের সমাবেশে কোটি প্রাণের ডাকে সাড়া দিয়ে মহানায়ক মুজিব জাতিকে মুক্তির মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন। তাই এটি কোনো সাধারণ বক্তৃতা নয়। এর তুলনা হতে পারে শিল্পের সঙ্গে। বলা যায়, এটি আধুনিক শ্রুতিশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন। তাই বিশ্বের সাংস্কৃতিক সম্পদ ও ঐতিহ্যের অভিভাবক সংস্থা ইউনেসকো এ ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি মূল্যবান স্মারক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

উৎকণ্ঠায়-উত্তেজনায় অস্থির জাতির চেতনাকে ১৯ মিনিটের একটি ভাষণ সেদিন প্রেরণা দিয়েছিল এবং আজও তার চেতনায় সংগ্রামের অনিঃশেষ প্রেরণা সঞ্চারিত করে চলেছে। ৭ মার্চ ১৯৭১ অপরাহ্ণে বঙ্গবন্ধু যখন জনসভার মঞ্চে উঠছেন, তখন তো জনসমুদ্র প্রবঞ্চক পাকিস্তানিদের প্রত্যাখ্যান করে নায়কের নির্দেশের অপেক্ষায় মাত্র। তারা তো জানে যুদ্ধ অনিবার্য, আসন্ন। নেতা লড়াইয়ের অগ্নিমন্ত্রে শাণিয়ে দিলেন জনতার অন্তর। যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পথে এভাবেই রওনা করিয়ে দিলেন জাতিকে ৭ মার্চ অপরাহ্ণে।

এক তারে বাঁধা ভাষণটির পাঁচটি বাঁক ফেরা লক্ষ করা যাবে। শুরুটা করেছেন সারা দেশে মানুষের আত্মত্যাগ স্মরণ করে এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি তাঁর ও বাঙালির সহজাত পক্ষপাতের কথা দিয়ে। তারপরই কিন্তু সুর চড়িয়ে পাকিস্তানি শাসকদের কাছে পাওয়া বঞ্চনা-নির্যাতন-প্রতারণার প্রসঙ্গ টেনে—’৭০-এর নির্বাচনের পরও তাঁর সমঝোতার ইচ্ছাকে উপেক্ষার কথা তুললেন। একই সূত্রে চলে এল ভুট্টোর ভূমিকা, বিশেষত ষড়যন্ত্রকারী ভুট্টোকে ছেড়ে আওয়ামী লীগ, তিনি নিজে এবং বাংলাদেশের মানুষকে অভিযুক্ত করার জন্য পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে রাখলেন জনতার দরবারে। এরপর ছোট্ট একটা বাঁক নিলেন। তিনি যাদের নেতা এবং তাঁর নিজের যারা ভরসা, সেই জনমানুষের কাছে খুলে বললেন শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম সত্ত্বেও ইয়াহিয়ার আক্রমণাত্মক ভূমিকা ও ষড়যন্ত্রের কথা। জবাব দিলেন সব অভিযোগের আর প্রতিবাদ জানালেন হত্যা ও নির্যাতনের। নেতা ও জনতার ঐক্য তাতে যেন গাঢ় হয়ে উঠল। এবার জননায়ক স্বৈরাচার ও ষড়যন্ত্রকারীদের পেছনে ফেলে আত্মবিশ্বাস ও সৎসাহসে ভর করে মুখোমুখি তাঁর দেশবাসীর। দ্বিধাহীন স্পষ্ট ভাষায় দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন সরকারের জন্য শর্ত, আর জনগণের জন্য দিলেন নির্দেশনা। সরকারকে দিলেন হুঁশিয়ারি, জনগণকে করলেন সতর্ক। তারপর জনগণকে চরম সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিতে বললেন, নিজে নিলেন বিকল্প সরকারের ভূমিকা। করণীয় জানালেন, না, করণীয় সম্পর্কে বলতেও ভুললেন না।

শেষে টান টান উত্তেজনার মধ্যে যেন জ্যা-মুক্ত করলেন ধনুকের তির। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

এবার আমরা বুঝে নেব এই ভাষণ আমাদের কী দিয়েছে।

২.

৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে একটি জাতির জন্ম হয়েছে, আর সেই জাতি একজন অবিসংবাদী নেতাকে পেয়েছিল। মুক্তিপাগল যে জাতি স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য অধীর প্রতীক্ষায় ছিল, তারা এই ভাষণের মাধ্যমে সেই সংকেতটি পেয়েছিল। এই ভাষণ ঘরকুনো নিতান্ত ছাপোষা বাঙালিকে রূপান্তরিত করেছিল বীরের জাতিতে।

এই ভাষণের পর কারও মনের সামান্য দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব দূর হয়ে গেল; স্বভাবত বিভক্ত, কলহপ্রিয় মানুষগুলো সব ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা পেল এ থেকে। এই ঐক্য কোনো সীমা মানেনি, জাত মানেনি। সব বাংলা ভাষাভাষীকে এক করে দিয়েছিল। ব্যক্তিগত জীবন, সংসার, পরিবার, নিজেদের নৈমিত্তিক কাজগুলো বড্ড ছোট অকিঞ্চিৎকর মনে হতে থাকল। এই একটি ভাষণ সবার অন্তরের রুদ্ধ কপাটগুলো খুলে দিয়ে শত ক্ষুদ্র ভাবনা দূর করে তাদের নিয়ে এল জাতীয় জীবনের ঘটমান ইতিহাসের মহা–রণাঙ্গনে। হঠাৎ করে ক্ষুদ্রতা, তুচ্ছতা ভুলে সবাই বড় হয়ে উঠল, মহৎ কাজের প্রেরণায় সবাই উজ্জীবিত। রমনার রেসকোর্সের ময়দানে সেদিন অপরাহ্ণের এক অলৌকিক ভাষণে অবগাহন করে একটি জাতি নবজন্ম লাভ করেছিল।

৭ মার্চের ভাষণটি ধর্ম-বর্ণ-বয়স-লিঙ্গনির্বিশেষে সব বাঙালিকে জয় বাংলার সৈনিকে রূপান্তরিত করেছিল। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে জয় বাংলা ছিল রণধ্বনি, মুজিব ছিলেন মহানায়ক আর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল অনুপ্রেরণার অফুরন্ত উৎস। ৭ মার্চের ভাষণ কেবল অবিস্মরণীয় নয়, বাঙালির জন্য অনিঃশেষ এর প্রেরণা। এটি রাজনীতির চিরায়ত এক ভাষ্য, ধ্রুপদি সৃষ্টি।

৩.

৭ মার্চের ভাষণের পরে ৫০টি বছর অতিবাহিত হয়েছে। আজকের প্রেক্ষাপট থেকে একবার কি মূল্যায়ন করব না? বিশেষত এ ভাষণ উত্তরসূরিদের কাছে যে প্রত্যাশা তুলে ধরেছিল, তা আমরা পূরণ করেছি কি না, তা তো আলোচনা হওয়া দরকার।

প্রথমে বলি ব্যক্তি ও সমষ্টিগতভাবে মানবিক অবস্থান থেকে। হ্যাঁ স্বীকার করতে হবে ৭ মার্চের ভাষণের চেতনা-প্রেরণাকে আমরা একাত্তরের পর আর এগিয়ে নিতে পারিনি। এ ভাষণ একাত্তরে আমাদের মধ্যে আদর্শিক চেতনা জাগিয়েছিল কিন্তু সেটা বিজয়ের পরও ধরে রাখতে পারিনি আমরা। পরিস্থিতির দাবির প্রতি মনোযোগ না দিয়ে কেউ আদর্শিক চরমপন্থায় ঝুঁকলেন, কেউবা স্বার্থের গণ্ডিতে বাঁধা পড়লেন।

এ ভাষণ যে ত্যাগোদ্দীপ্ত বীরত্বের বীজ বপন করেছিল, তা আমাদের ক্ষেত্রে যেন একফসলা শস্য হয়ে থাকল, বিজয়ী বীরের ভূমিকা ছেড়ে অচিরেই আমরা ভাগ-ভোগের ক্ষুদ্রতার বিকারে ভুগতে থাকলাম।

এই সুযোগে পরাজিত আদর্শের ষড়যন্ত্রী আর অনৈতিক ক্ষমতালিপ্সুর দল প্রত্যাঘাত হানতে পেরেছিল। আমরা ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে পারিনি। এমনকি তাঁর রেখে যাওয়া অতুলনীয় সম্পদ এই ভাষণের চর্চা করিনি, কেবল এটাকে ব্যবহার করে ফায়দা পেতে চেয়েছি, যখন-তখন মাইক্রোফোনে বাজিয়ে দিয়েছি এর পবিত্রতা ও মহত্ত্বের কথা না ভেবে।

পঁচাত্তরের পরবর্তীকালে যে ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতার প্রসার ঘটল, তার বিরুদ্ধে বাঙালির এবং বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে পারিনি। বরং বিরুদ্ধ স্রোতের প্রবল জোয়ারে সমাজ ও মূলধারার রাজনীতি আপস করে নিল সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের প্রকট উপস্থিতিতে, সাম্প্রদায়িকতাও এরই দোসর হিসেবে টিকে রইল। অন্যদিকে সমাজতন্ত্রের পতন ও বিশ্বায়নের আগ্রাসনের বাস্তবতায় নিজেদের উপযোগী রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক জাগরণের পথ খুঁজতে পারিনি। গা ভাসিয়ে দেওয়ার ফলে শিক্ষা ও মানবিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক সর্বক্ষেত্রে অবক্ষয় স্পষ্ট। এর মধ্যে মানুষ জীবনযাপন ও উদ্‌যাপনে সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়ে উৎপাদনে, যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গে উদ্দীপনা ও অগ্রগতির ছাপ রাখতে পারল। সরকারও এগিয়ে যাওয়ার অন্তত কিছু ক্ষেত্রের সন্ধান পেল। বাংলাদেশ কৃষি, তৈরি পোশাক, অভিবাসী শ্রম, নানা রকম ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে কৃতিত্ব দেখিয়েছে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার উপার্জন বেড়েছে, বৈষম্য ও দারিদ্র্য সত্ত্বেও আয়, আয়ু এবং জীবনমানেরও উন্নতি দৃশ্যমান, পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে যোগাযোগ, যাতায়াত, আইটি সেক্টরের উন্নতিও উল্লেখযোগ্য। আন্তরিকতা থাকলে যে সক্ষমতাও বাড়ে, তা বোঝা গেছে সাম্প্রতিক দুর্যোগ করোনা মহামারির মোকাবিলায়।

তবে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি তো এক রাজনৈতিক দলিল। একটি জাতির মুক্তির সনদ। আমাদের রাজনৈতিক অবক্ষয় এবং ব্যক্তিমানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার পরিসর যে সংকুচিত হচ্ছে, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। অর্থাৎ ভাষণের সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে আফসোসের বিষয় থেকেই যাচ্ছে। তবু এ ভাষণের এমন প্রাণশক্তি যে এত অবহেলা ও অপব্যবহার সত্ত্বেও ঠিকই মানুষের চেতনা-প্রদীপের সলতেটি জ্বালাতে সক্ষম। অন্ধকারে আলোর উৎস আজও।

৪.

ফলে এর সুবর্ণজয়ন্তীতে বলতে চাই, কোনো সর্বনাশা পরিণতি এ জাতির হওয়ার কথা নয়। কারণ, ৭ মার্চের ভাষণটিকে এখনো অনেক মানুষ অঙ্গীকারের শিখা-অনির্বাণ হিসেবে চেতনায় ধারণ করেন। তার অবিনশ্বর ঐতিহ্যের ভান্ডারে এটি একটি দীপ্র শিখা। যেকোনো সর্বনাশের পথ চিরকালের মতো বন্ধ করে একাত্তরের চেতনায় নতুন প্রভাতের সূচনার জন্য সেই শিখাটি তুলে ধরার এখনই সময়।

তাই ৭ মার্চের ভাষণের পরিপূরক ভাষণটি আজ চাই। একই ধারাবাহিকতায় ঐক্যের, সংগ্রামের, গঠনের পথনির্দেশ চাই। ঠিক একইভাবে এক তারে বাঁধা ভাষণে কয়েকটি বাঁকবদল থাকবে। দেশ ও জাতিকে নিয়ে নির্মম ষড়যন্ত্র আর খলচরিত্রের নানা বিকারের কথার পর আদর্শ, ইতিহাস, রাষ্ট্র ছিনতাইয়ের কথা আসবে। খলচরিত্রগুলো উন্মোচন করে কীভাবে অস্ত্র ও অর্থের দূষণে রাজনীতিকে তারা বিষিয়ে তুলেছিল, সে কথাও তুলে ধরতে হবে। বলতে হবে রাজনীতির নতুন উপসর্গ জঙ্গিবাদ ও ধর্মান্ধতার কথা। মানুষের কাছে খোলামনে বলতে হবে কঠিন দুঃসময়ে নিজেদের অপারগতা, ব্যর্থতা কিংবা ভুলের কথা। সেই সঙ্গে গণমানুষের পাশে থাকার ঐতিহ্য ও অঙ্গীকার স্মরণ করতে হবে। আর সবশেষে আদর্শের লড়াইয়ে নিঃস্বার্থ দৃঢ়তায় ঐক্যের ডাক দিতে হবে। সবার প্রাণে দেশসেবার মন্ত্র দিতে হবে। শুধু ৭ মার্চের সেই মহানায়কের সততা, দৃঢ়তা, সাহস, দূরদর্শিতা ও ঔদার্যের সমন্বয়েই সেই পথে আজ জাতিকে পথ দেখাতে পারেন কেউ।

আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক