পরিবর্তনের মূলমন্ত্র হোক নারী নেতৃত্ব


‘আমার ওপর বাবা-মায়ের আস্থা আছে। আমি এখন আওয়াজ তুলতে আত্মপ্রত্যয়ী,’ বলছিলেন কুড়িগ্রামের ১৯ বছর বয়সী সাদিয়া, এই তরুণী বাল্যবিবাহ রোধে তাঁর কমিউনিটিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর এই যাত্রা যখন শুরু, তখন তাঁর বয়স ১৬ বছর। বান্ধবীর বিয়ের আয়োজনের কথা জানতে পেরে অন্য বন্ধুদের নিয়ে তিনি তাঁর ওই বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে বিয়ে থামাতে পরিবারকে রাজি করান।

‘কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। তার বাবা-মা ভেবেছিলেন, অল্প বয়সে বিয়ে দিতে পারলেই মেয়ের জন্য ভালো হবে। আমরা তাঁর বাবা-মাকে বুঝিয়ে বিয়ে বন্ধ করি, যেন সে তার পড়ালেখা শেষ করতে পারে।’

সাদিয়া এখন স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। স্বাস্থ্য খাতে স্বেচ্ছাসেবী কর্মী হিসেবে তিনি কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্য প্রদানসহ স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে চিকিৎসাসেবা পেতে সহায়তা করছেন।

সাদিয়ার মতোই এমন অসংখ্য কিশোরী ও নারীর নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কঠোর পরিশ্রম, যুগোপযোগী বিনিয়োগ ও দূরদর্শী পরিকল্পনার বদৌলতে স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে ওপরে উঠে এসেছে। অর্থাৎ দেশের সব অনন্যসাধারণ উন্নয়ন ও অর্জন বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এই স্বীকৃতির আনন্দ উদ্‌যাপনের পাশাপাশি প্রত্যেক নাগরিকের উন্নতির ব্যাপারটিও আমাদের মনে রাখতে হবে।

উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোতে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন রয়েছে। প্রাথমিকে প্রকৃত ভর্তির হার ছেলে ও মেয়ে উভয় শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেই ৯৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মাধ্যমিকে ভর্তির হারও বেড়েছে। লৈঙ্গিক সমতা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সরকার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। মেয়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া ঠেকাতে নানা বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব অর্থাৎ প্রযুক্তিনির্ভর যুগের উপযোগী করে গড়ে তুলতে কিশোর-কিশোরীদের প্রযুক্তি শিক্ষায় আগ্রহী করে তোলা হচ্ছে। প্রযুক্তির উন্মেষের পাশাপাশি তৈরি হয়েছে নানা প্রতিকূলতাও। সেই প্রতিকূলতা মোকাবিলায়ও নেতৃত্ব দিচ্ছে যুবরা।

‘আমি আমার সম্প্রদায়ের কিশোরী ও নারীদের নিরাপত্তার জন্য কাজ করি। তাদের একটি মুক্ত ও নিরাপদ পরিবেশ দরকার। কোভিড–১৯ সময়ে শিক্ষার জন্য অনলাইনে সবার যুক্ত থাকার প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। কিন্তু অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কিশোরী ও নারীদের হয়রানির শিকার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, যা তাদের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। আমি এ ব্যাপারে কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। অনলাইনে নিজেদের নিরাপদ রাখা ও সহিংসতার শিকার হলে এ বিষয়ে অভিযোগ জানাতে সবাইকে সচেতন করতে কাজ শুরু করলাম,’ বলছিলেন খাগড়াছড়ির মারমা তরুণী নিউমা।

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই কৈশোরে সন্তান জন্মদানের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০ জন মেয়ের মধ্যে ১ জন ১৫ বছর বয়সের আগেই সন্তানের জন্ম দেয়। আর প্রতি ৩ জনের ১ জন কিশোরী ১৯ বছর বয়সের মধ্যে সন্তান জন্ম দেয় অথবা গর্ভধারণ করে। ৫১ শতাংশ নারীর বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছর বয়সের আগেই।

১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সরকার নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য দূরীকরণে জাতিসংঘ ঘোষিত সিডও সনদে স্বাক্ষর করে। দেশে শিশু নীতিমালা ২০১১, চিলড্রেন অ্যাক্ট ২০১৩ এবং বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ রয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান ১১তম সংসদে এযাবৎকালের সর্বোচ্চসংখ্যক (২৩ জন) নারী সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন। নারীর অংশগ্রহণ ২০০০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। পরিবর্তনের ধারায় ভূমিকা রাখতে যুবরাও এগিয়ে আসছে।
তাহলে সমস্যা কোথায়?

আজ আমরা আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করছি। এই সময়ে গোটা বিশ্বের নজর নারীর নেতৃত্বের দিকে। এখনই নিজেদের প্রশ্ন করার সময়, আমরা কি নারী নেতৃত্বকে সমর্থন জানাতে যথেষ্ট সহযোগিতা করছি?

বাংলাদেশে জেন্ডার সমতা এখনো অধরাই থেকে গেছে। এখনো মেয়েদের অবজ্ঞা-অবহেলা করা হচ্ছে। এই বৈষম্যের কারণে লাখ লাখ কন্যাশিশু ও কিশোরী তাদের সমতার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই সমাজ এখনো বৈষম্যমূলক জেন্ডার ধারণাগুলোর বশবর্তী হয়ে মেয়েদের জীবনকে যথেচ্ছভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে।
অষ্টম শ্রেণির পর মেয়েদের ঝরে পড়ার হার ৮ শতাংশ, বিপরীতে ছেলেদের ঝরে পড়ার হার ৫ শতাংশ।

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই কৈশোরে সন্তান জন্মদানের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০ জন মেয়ের মধ্যে ১ জন ১৫ বছর বয়সের আগেই সন্তানের জন্ম দেয়। আর প্রতি ৩ জনের ১ জন কিশোরী ১৯ বছর বয়সের মধ্যে সন্তান জন্ম দেয় অথবা গর্ভধারণ করে। ৫১ শতাংশ নারীর বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছর বয়সের আগেই। বিবাহিত নারীদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার প্রবণতা অবিবাহিতদের তুলনায় চার গুণ বেশি। বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের প্রতি ১০ জনের ৫ জন ১৮ বছর বয়সের আগেই সন্তানের জন্ম দেয় এবং প্রতি ১০ জনের ৮ জন সন্তানের জন্ম দেয় ২০ বছর বয়সের আগেই।

তৈরি পোশাকশিল্প বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত। এই খাতে প্রায় ৩০ লাখ নারী কর্মরত, কিন্তু সরকারের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও নারীরা এই খাতে এখনো অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার। এখনো ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর ৪১ শতাংশ (৬৫ দশমিক ৭ শতাংশ নারী ও ১২ দশমিক ৭ শতাংশ পুরুষ) শিক্ষা, কর্ম বা প্রশিক্ষণের আওতার বাইরে রয়ে গেছে।

২০২১ সালে এসেও বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ আশঙ্কাজনকভাবে কম। সমাজে নারী-পুরুষের ভূমিকা বিষয়ে বিদ্যমান পুরোনো ও ভ্রান্ত ধ্যানধারণার কারণে নারীরা অনেক ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। এই চিত্র শহর ও গ্রাম, উভয় ক্ষেত্রেই বিরাজমান। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক প্রতিবেদন অনুয়ায়ী, ২০২০ সালে অন্তত ২৪০ জন নারী তাঁদের স্বামী বা পরিবারের সদস্যদের দ্বারা হত্যার শিকার হয়েছেন।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে মেয়েশিশুদের অধিকারের বিষয়টিকে সব সময় শিশু কিংবা নারী অধিকারের ছকে ফেলে ভাবা হয়। আমরা দেখেছি যে মেয়েশিশুর অধিকার রক্ষায় যে চ্যালেঞ্জ, প্রতিনিয়ত তা শিশু ও নারী অধিকারের আলোচনায় হারিয়ে যায়। যদিও রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সনদে সবার অধিকারের বিষয়টি আলোকপাত করা হয়ে থাকে, তথাপি আইন-নীতিমালা-কর্মপরিকল্পনাতে মেয়েশিশুদের অধিকারের বিষয়টিকে জোরালোভাবে গুরুত্ব পেতে দেখা যায়নি। আমরা যখন পরবর্তী ১০ বছরের কর্মকৌশল তৈরি করছিলাম, তখন মেয়েশিশুদের অধিকার আদায়ের বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে নিয়ে কাজ করার তাগিদ ছিল সব সময়।

আমরা দেখেছি এবং প্রতিদিন দেখছি, সহিংসতার ভয় প্রতিনিয়ত কীভাবে একজন মেয়ে, একজন কিশোরী, একজন তরুণীর বিকাশ, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার, শিক্ষা-কর্মসংস্থান-নেতৃত্ব-সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে নিরুৎসাহিত করছে। আর তাই আগামী ১০ বছর শিশু ও যুবদের নিয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি থাকলেও আমরা জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠা ও মেয়েশিশুর অধিকার রক্ষার বিষয়টিকে আমাদের কাজের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেব।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল এমন এক সমাজের স্বপ্ন দেখে, যেখানে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ও চলাচলের স্বাধীনতা রয়েছে। যেখানে তারা সমাজ পরিবর্তনের অংশীদার হতে পারে। আর স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসতে এসব শর্ত পূরণ খুব জরুরি। ২০৩০ সালের মধ্যে জেন্ডার সমতা অর্জন একটা বড় চ্যালেঞ্জ, তবে তা অসম্ভব নয়। কিন্তু এ জন্য আমাদের এখনই উদ্যোগী হতে হবে।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের আগামী ১০ বছরের জাতীয় কর্মপরিকল্পনার লক্ষ্য হলো জেন্ডার বৈষম্যের মূল কারণগুলো খুঁজে বের করা। এ জন্য শিক্ষা, যুব নেতৃত্ব, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক অধিকার ও দক্ষতা এবং যুবদের কর্মসংস্থান—এই চারটি দিককে নির্বাচন করা হয়েছে। যুবদের, বিশেষ করে কিশোরী ও তরুণীদের, সম্পৃক্ত করে গৃহীত সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমেই ২০৩০ সালের মধ্যে জেন্ডার পরিস্থিতি বদলের যে লক্ষ্য, তা পূরণ করা সম্ভব। আর এভাবেই শিশু, কিশোর-কিশোরী ও তরুণীদের নেতৃত্ব স্বীকৃতি পাবে, উন্নততর হবে তাদের জীবনের মান।

অরলা মার্ফি প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেকটর