পরিস্থানের গল্প

এক সময় যাত্রাপালা ছিল বাঙালির বিনোদনের অন্যতম অনুসঙ্গ।
ছবি: সংগৃহীত

জিন-পরি, দেও-দানবের গল্প না শুনে ঘুমোতে গিয়েছি, এমন দিন খুব কমই ছিল ছোটবেলায়। মা-খালা-নানি-দাদিরা একই গল্প যে কত শতবার শোনাত, তার ইয়ত্তা নেই। যুগ যুগ ধরে চলা সেসব গল্পে নানি-দাদিদের বলার ঢঙের কারণে কখনোই মরচে ধরত না। বরং আমরা দিন দিন আরও বেশি শিহরিত ও রোমাঞ্চিত বোধ করতাম সেসব গল্প শুনে। কল্পনায় সাজানো সাত সমুদ্দুর তেপান্তরের সেই গল্প শুনতে শুনতে আমরা ছেলেমেয়েরা, নাকি গল্প বলিয়ে নানি-দাদিরা, কে বা কারা যে আগে ঘুমাত, সে হিসাব অবশ্য রাখা হয়নি। তবে এটা ঠিক, গল্প না শুনে ঘুম আসত না।

কালক্রমে বয়স বাড়লে নানি-দাদিদের কোল ছেড়ে সমবয়সী বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সকাল থেকে সন্ধ্যা কাটিয়ে নানা দস্যিপনা করে আমরা নিজেরাই রূপকথার নায়ক-নায়িকা বনে যেতাম। এই যেমন মৌচাক থেকে লম্বা পাটখড়ি দিয়ে মৌমাছিদের ফাঁকি দিয়ে মধু খেয়ে ফেলা, জেদাজেদি করে তালপুকুরের তলদেশ থেকে কাদা তুলতে গিয়ে নোংরা পানি খেয়ে হাবুডুবু খাওয়া, ঝিলে-বিলে শাপলা তুলে মধ্যাহ্নভোজন সারা—সেসব আজ ডালিম কুমারের গল্পের চেয়ে কম রোমাঞ্চের মনে হয় না। স্কুল শেষে খাল-বিলে সাঁতার কেটে চোখ লাল করে বাড়ি ফিরে মায়ের বকুনি আজও অমৃত মনে হয়। সেসব বাল্যকালে কোনটা বাস্তব জীবন আর কোনটা কল্পজগতের কার্যকলাপ ছিল, তা ভাবতে গেলে খেই হারিয়ে ফেলি।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবতা বুঝতে বেগ পেতে হয়নি। মনে পড়ে, মাধ্যমিকের শেষ দিকে স্কুলমাঠে বসেছিল যাত্রাপালার আসর। শীতকালে মাসব্যাপী সে যাত্রাপালা শুরু হতো মধ্যরাতে। সে সময় গ্রামবাংলায় অভাব-অনটন যেমন ছিল সত্যি, কিন্তু তার চেয়ে ঢের বেশি ছিল মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, এপাড়া-ওপাড়ায় কত মিল আর মহব্বত। আজকাল তো নানামুখী ঝামেলায় গ্রামেগঞ্জে যাত্রাপালা তেমন হয়ই না। তো মনে পড়ে, সেই যাত্রাপালায় যে তরুণী মূল নায়িকা ছিল, তার বাহারি নাচ, গান আর অভিনয়ের কথা। ৫০ থেকে ৬০ জনের এসব যাত্রাদলে নানা বয়সের ছেলেমেয়ে, অধিকারী, সহকারী—কতজন কত কাজে নিয়োজিত থাকত। ‘সিরাজউদ্দৌলা’, ‘আনারকলি’, ‘সূর্য সাক্ষী’, ‘দস্যুরানি ফুলন দেবী’ ইত্যাদি যাত্রাপালায় সুনিপুণ অভিনয়কারী সেসব কলাকুশলীকে দেখতাম সকালে লাবড়া আর ঘন্ট দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতে। সারা দিনে বাদ আসর তারা সবাই একটু ভরপেট খেত।

মনে পড়ে, একবার উপযাচক হয়ে যাত্রাদলের অধিকারীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে তাঁদের এত কষ্ট কেন? উত্তর অনুমিতই ছিল। যেমনটি বলছিলেন, ‘এর চেয়ে বেশি আর কিছু জোটাতে যে পারি না।’

অভিনয় আর বাস্তব জীবনের আকাশ-পাতাল ফারাক আজও মনে পড়ে যখন ‘আয়নামতীর কিচ্ছা’ পালাগান দেখতে গিয়েছিলাম অন্য গ্রামে। যে যুবক মেয়ে সেজে অনবদ্য অভিনয় করে গেল প্রায় সারা রাত, সেই আয়নামতীবেশী যুবক পালার শেষ দিকে সবার কাছে হাত পাতছিল আর্থিক সাহায্যের জন্য। এমন করতে দেখেছি যাত্রাদলে ‘বিবেক’ সেজে গান গেয়ে বেড়ানো মোক্তার আলীকে। তাঁর শেষ দিনগুলো কেটেছে নিতান্তই অনাহারে-অর্ধাহারে। অথচ ‘ভালো ছাত্র’ মোক্তার আলী স্কুল পালিয়ে বাড়ি ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিল যাত্রাদলে ‘বিবেক বেশে’।

যাঁরা নাটক, সিনেমা, যাত্রাপালা ইত্যাদিতে অভিনয় করেন, তাঁদের অনেকেই অভিনয়কে ভালোবেসেই করেন। এটাও ঠিক যে অনেকে অভিনয়সহ সহযোগী অনেক কাজে ব্যস্ত থাকেন জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্যও। স্রেফ বিনোদনের জন্য অথবা সুনাম-সুখ্যাতির জন্য অভিনয় করতেন—এমন মানুষও কম নয়। স্কুল-কলেজ বা গ্রামগঞ্জে ক্লাবে নাটক-থিয়েটারে কতজনকে দেখেছি কোনো একটা বিশেষ পাঠ নেওয়ার জন্য কতজন যে প্রতিযোগিতা করতেন। কিন্তু হোক সে পেশাদার অথবা ‘অ্যামেচার’ অভিনয়শিল্পী, তাঁরা কখনোই বাস্তবতা আর অভিনয়জীবনকে এক করে ফেলেছেন, এমনটি শোনা যায়নি। অথবা শোনা গেলেও তা ঠিক বলে প্রতীয়মান হয় না।

এ সম্পর্কে একটি বাস্তব ঘটনা স্মরণে এল। আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ছিলেন প্রয়াত নায়করাজ রাজ্জাকের ভীষণ ভক্ত। নায়করাজের কোনো সিনেমা তিনি পারতপক্ষে মিস করতেন না। সেসব ছবির শিক্ষণীয় বিষয়গুলো ক্লাসে এসে তিনি আমাদের বোঝাতেন। শোনা যায়, একবার তিনি নায়করাজকে দেখার জন্যই রাজধানীতে এসেছিলেন। পেয়েছিলেনও কাঙ্ক্ষিত দেখা। সবচেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন নায়করাজ রাজ্জাকের অতি সাধারণ জীবনপ্রণালি এবং কথা বলার ধরন দেখে। এত এত সিনেমায় রাজা-মহারাজাসহ নানা ভূমিকায় অভিনয় করা নায়ক রাজ্জাকও যে সাধারণ জীবন যাপন করতেন, তাই দেখে তিনি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন।

হালের নাটক-সিনেমায় অভিনয়ের প্রয়োজনে নানা ঘটনা, রটনা বা দৃশ্যের অবতারণা করা হয়। সিনেমায় যেমন নায়ক থাকেন, তেমনি ভিলেন, নায়িকা আছেন। তাঁদের সঙ্গী-সাথি নানাজন নানা ভূমিকায় অভিনয় করেন। ঘটনার প্রয়োজনে সিনেমায় মারপিট, দুর্ঘটনা, হাসি-তামাশা, রঞ্জিত বা অতিরঞ্জিত খানাপিনা বা মদের আসর—নানা কিছুই দেখানো হয়। সামাজিক, বাণিজ্যিক ইত্যাদি নানা ধরনের সিনেমা তৈরি হয় বলে শোনা গেলেও সিনেমার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু দর্শকের হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছানো। সে অতিমানবিক কিছু দৃশ্য বা অপদৃশ্যের অবতারণা করে হলেও।

ছোটবেলার জিন-পরি, দেও-দানবের গল্পগুলো যেন আধুনিক সিনেমার মূল বিষয় চরিত্র হয়ে দেখা যায়। আমাদের বাংলাদেশ বা উপমহাদেশের সিনেমার কথায় পরে আসি। কিন্তু উন্নত দেশ যেমন যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডা, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হালে কথিত ‘ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট’ বা ভিএফএক্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেসব সিনেমা তৈরি হয়, তা রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। ‘অ্যানিমেল লজিক’, ‘পিক্সার’, ‘ওয়াল্ট ডিজনি’, ‘ড্রিম ওয়ার্কস’, ‘ইউনিভার্সাল’ ইত্যাদি খ্যাতনামা স্টুডিওতে বর্তমানে যেসব সিনেমা এডিটিং এবং অ্যানিমেশন করা হয়, তা শুধু অতি কাল্পনিকই নয়, অতিমানবিকও বটে। নিকট অতীত থেকে শুরু করে বর্তমানের অনেক সিনেমা, যেমন: ‘দ্য লর্ড অব দ্য রিংস’, ‘ট্রান্সফরমার’ সিরিজ, ‘কার্স’, ‘ওয়্যার ফর দ্য প্ল্যানেট অব দ্য অ্যাপস’, ‘গডজিলা’, ‘অ্যাভাটার’, ‘দ্য গার্ডিয়ান অব দ্য গ্যালাক্সি’, ‘৫ পার্সেন্ট পার সেকেন্ড’, ‘কিং কং’, ‘এলিটা ব্যাটল অ্যাঞ্জেল’, ‘দ্য পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ানস’ ইত্যাদি সিনেমায় যেসব উন্নত ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে, তা ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ, সবার কাছেই বিস্ময় বটে। হলিউড থেকে শুরু করে চীন-জাপানের অনেক সিনেমার বাজেট অবশ্য কয়েক শ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে। যেমনটি বলা, এখনকার ছেলেমেয়েরা নানি-দাদিদের কাছে আর পরিস্থানের গল্প শুনতে চায় না। তারা দেশ-বিদেশের এরূপ রূপকথার সিনেমা দেখে এখন ঘুমাতে যায়।

সে যা-ই হোক, এসব সিনেমায় শিল্পীরা যেসব ভূমিকায় অভিনয় করেন, বাস্তবে তা কোনোভাবেই করে দেখানো সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ সবার অপার বিনোদন ‘মি. বিন’খ্যাত রওয়ান অ্যাটকিনসনের কথাই ধরা যাক। কয়েক দশক ধরে বিশ্বখ্যাত এই অভিনেতা নিশ্চয়ই তাঁর পরিবার-পরিজনের সঙ্গে এরূপ হাস্যকরভাবে কথা বলেন না। বলিউড খ্যাত সিনেমা ‘রোবট’-এ নায়িকা ঐশ্বরিয়া রাই ‘রোবট’ রজনীকান্তের প্রেমে পড়লেও বাস্তবে এমনটা কখনো দেখা যায়নি। মুঘল সম্রাট আকবরের চরিত্রে অভিনয়কারী হৃতিক রোশন, অথবা চিরসবুজ অভিনেতা শাহরুখ খান অভিনয়ে দশ দিক মাতালেও ব্যক্তিজীবনে ‘বাদশাহি’ দেখান না বলেই জনশ্রুতি আছে।

ইউরোপ-আমেরিকার অতিমানবিক অতি রূপকথার উপজীব্যের তুলনায় উপমহাদেশের সিনেমায় মানবিক ভাব-ভালোবাসা ইত্যাদির প্রাধান্যই বেশি দেখা যায়। তরুণ মজুমদার পরিচালিত ‘আগমন’ সিনেমার কথাই ধরা যাক। অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায় আত্মহত্যা করতে যান এবং ভাগ্যক্রমে এক যাত্রাদলের লোকজনের মাধ্যমে বেঁচে গিয়ে পরম মাতৃস্নেহে ‘বিনু’খ্যাত তাপস পালকে লালন-পালন করেন। উপমহাদেশের প্রখ্যাত বাঙালি সিনেমা পরিচালক সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রতিটি সিনেমায় জীবন ও জাগতিক বিভিন্ন বার্তার পাশাপাশি নিরঙ্কুশ বিনোদন উপহার দিয়েছেন। এ যুগের ছেলেমেয়েরা ‘পথের পাঁচালী’-র অপু দুর্গা হতে চায় কি না, তা জানা না গেলেও ‘আগন্তুক’-এর উৎপল দত্তের মতো তুখোড় জ্ঞানী তার্কিক হতে চাওয়া মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়।

নাটক, সিনেমা, যাত্রাপালা, থিয়েটার—এসবের গল্পগুলো যেন অতীতের পরিস্থানেরই গল্প। বাস্তব জীবন আর গল্প-সিনেমার জীবন সত্যি আলাদা ব্যাপার। অনেকে অবশ্য বাস্তব জীবনটাকেও অভিনয়জীবনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। তখনই দেখা যায় আসল বিপত্তি। অভিনয়জীবনে কেউ মারপিট করেন, রাজা-উজির সাজেন, এলিয়েনদের সঙ্গে যুদ্ধ করেন, মি. বিনের মতো হাঁটেন, হাসেন এবং হাসান, সমাজ-সংস্কৃতি, ধর্ম-রাজনীতির নানা চরিত্রে অভিনয় করেন, কেউ চোর, ডাকাত খুনি, সাধু সেজে মানুষকে বিনোদন দেন। যাঁরা অভিনয়কে ভালোবেসে অভিনয় করেন, তাঁদের কথা আলাদা হলেও বর্তমানে দেখা যাচ্ছে অনেকেই কেন যে অভিনয়জগতে এসেছেন, তা তাঁরা নিজেরাও জানেন না।

অনেকে ব্যক্তি ও সমাজজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও কিসের মোহে যে ভুলভাল অভিনয় করে হাসির খোরাক হন, তা অনেকের অজানা। আবার কেউ কেউ অভিনয়ে ভালো করলেও বাস্তবতার সঙ্গে তালগোল পাকিয়ে ফেলে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। সিনেমায় অভিনয়কালে নায়িকা যেমন ভিলেনের দ্বারা লাঞ্ছিত হন, বাস্তবেও যে তা ঘটতে পারে, সে কথা হয়তো তাঁরা বেমালুম ভুলে যান। সিনেমার কল্পজগতে অধিকারী বা পরিচালক সময়মতো নায়কের উপস্থিতি ঘটিয়ে নায়িকাকে ভিলেনের হাত থেকে উদ্ধার করেন। এসব অভিনেতা-অভিনেত্রী কি বাস্তব জীবনেও এরূপ অধিকারী খোঁজেন, যিনি বা যাঁরা সময়মতো তাঁদের বিপদমুক্ত করবেন?

সিনেমার জগতে অভিনয়দক্ষতায় উদ্ধার পাওয়ার ঘটনা আছে বৈকি। ১৯৯২ সালের বিখ্যাত হলিউড মুভি ‘বেসিক ইন্সটিঙ্ক’-এ অভিনেত্রী শ্যারন স্টোন তাঁর রূপ আর যৌবনের ফাঁদে ফেলে একের পর এক শহরের ছেলেদের খুন করতে থাকেন। ডিটেকটিভরা তেমন কিছুই করতে পারছিলেন না। একবার জুরিবোর্ডে জিজ্ঞাসাবাদে প্রায় ধরা পড়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু প্রচণ্ড বুদ্ধিমতী এবং চতুর শ্যারন স্টোন তাঁর সুবিখ্যাত ‘লেগ ক্রসিং’-এর মাধ্যমে জুরিবোর্ডকে ভ্যাবাচেকা খাইয়ে দিয়ে রেহাই পেয়ে যান।

অতীতের পরিস্থান আর বর্তমানের সিনেজগতের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সামনেও ডিটেকটিভ আর জুরিবোর্ড উপস্থিত। দেখা যাক গল্প আর বাস্তবতার মিল কোথায়।

ড. শহীদুল জাহীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষক