পরীক্ষা ও মুখস্থনির্ভর শিক্ষা থেকে বের হতেই হবে

শিক্ষাক্ষেত্রে সরকার একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিতে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এ বিষয়ে ঘোষণা দিয়েছেন। দুই শতাধিক বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে নানা সংস্কার সত্ত্বেও আমাদের দেশে মূলত ব্রিটিশ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থাই চালু রয়েছে। এতে মৌলিক পরিবর্তন আনা যায়নি। এ শিক্ষা ছিল পাঠ্যবইনির্ভর, শিক্ষার্থীর মান যাচাইয়ের একমাত্র মাধ্যম পরীক্ষা। একসময় যখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা সীমিত ছিল, শিক্ষকতা পেশা ছিল একটি আদর্শিক ব্রত এবং শিক্ষকদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মধ্যেও প্রকৃত জ্ঞানান্বেষী অনেকেই থাকতেন, তখন এই ব্যবস্থা থেকেও অনেক উন্নত চরিত্রের জ্ঞানী সৃষ্টি হয়েছেন।

কিন্তু কালের পরিক্রমায় মানবজীবনের মূল উদ্দেশ্য ও তাৎপর্যের বিবর্তন হয়েছে এবং জীবনে আদর্শের গুরুত্বও একসময় কমেছে। জীবন গঠন এবং সেই সূত্রে জীবনের নীতি-আদর্শ অন্বেষণ ও নির্মাণের লক্ষ্য ছাপিয়ে জীবিকা ও পেশার গুরুত্ব প্রবলভাবে বেড়েছে। অন্তত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এই পরিবর্তনের প্রভাব পড়ার কথা নয়, কিন্তু আমাদের দেশে পড়েছে। খুব সংগত কারণেই দেশে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে, কিন্তু সেভাবে শ্রেণিকক্ষসহ অবকাঠামো, শিক্ষকের সংখ্যা বাড়েনি। স্বভাবতই অপ্রতুল আয়োজন নিয়ে বিপুল ছাত্রের সুশিক্ষা অসাধ্য হয়ে পড়েছিল। ফলে সামগ্রিকভাবে যেন আমাদের অজান্তেই শিক্ষার গুণগত রূপান্তর ঘটে গেল। ৬০-৮০-১০০ বা শতাধিক শিক্ষার্থীর বিশাল শ্রেণিকক্ষে প্রকৃত পাঠদান বা জ্ঞানচর্চা ছিল অসম্ভব।

এ বাস্তবতায় ধীরে ধীরে একসময় পরীক্ষা ছাড়া শিক্ষার আর কিছুই বাকি থাকল না। এ ব্যবস্থায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক—সবার একটিই লক্ষ্য থাকল উচ্চমান ও ভালো ফল। ক্রমে শিক্ষা বা জ্ঞান নয়, ডিগ্রি সনদই শিক্ষার মোক্ষ হয়ে দাঁড়াল। পরিবর্তনটা এভাবে ঘটেছে। পাঠ্যবই হটিয়ে নোট-গাইড বই সে স্থান নিল, শিক্ষকের চেয়ে টিউটরের ভূমিকা ও গুরুত্ব বাড়ল, শ্রেণিকক্ষের চেয়ে কোচিং সেন্টার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, শিক্ষা-সহশিক্ষা কার্যক্রম ছাপিয়ে অনবরত মডেল টেস্ট দিয়ে ভালো ফল আদায়ই শিক্ষার্থীর কাজ হয়ে পড়ল এবং সব ছাপিয়ে শিক্ষার স্থান নিল পরীক্ষা।

এ বাস্তবতায় এইচএসসিতে সোনালি তারকা পাওয়া শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়, ভালো ফল করা ছাত্র ইংরেজি বা বাংলা কোনো ভাষাতেই শুদ্ধ বাক্য লিখতে অক্ষম। গুরুতর সংকট হলো, পরীক্ষার চাপে নির্বাচিত এবং খণ্ডিতভাবে মুখস্থ করা বিদ্যা কিছুদিন পর আর মনে-মননে অবশিষ্ট থাকে না। ভাসা–ভাসা ঝাপসা কিছু স্মৃতি নিয়ে ছেলেমেয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করছে। ফলে উচ্চ ডিগ্রিধারী ব্যক্তিতে দেশ ছেয়ে গেলেও প্রকৃত জ্ঞানী ও সুদক্ষ উন্নত মানুষের আকাল পড়েছে। মানুষের এই দুর্ভিক্ষ যদি চলতে দেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যতে আমাদের সব উন্নয়ন ও জাগতিক সাফল্য বৃথা হয়ে যাবে।

শিক্ষা বা জ্ঞান কোনো শিক্ষার্থীর জন্যই তৈরি করা সামগ্রী বা রেডিমেড ফিনিশড প্রোডাক্ট হিসেবে মেলে না। এটি কেবল একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই অর্জন সম্ভব। পঠনপাঠন, অনুসন্ধান, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, ভাবনা-গবেষণা, অনুমান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদি বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করতে পারে। এসব ধাপ এড়িয়ে যে মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভর করে আমরা চলে আসছি, তাতে কোনো বিদ্যাই আর আত্মস্থ করা সম্ভব হয় না। কারণ জ্ঞানের রাজ্যে তার কোনো শিকড় ছড়ায়নি, সে বিস্তীর্ণ জ্ঞানভূমি থেকে তেমন কোনো রসদও আহরণ করেনি। ফলে কোনো বিষয়ে তার ব্যক্তিগত ধারণা, সংস্কার, বিশ্বাস ইত্যাদির সঙ্গে সে তার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত ধারণা মিলিয়ে বড়জোর কোনো মন্তব্য করতে পারে। কিন্তু আলোচনা বা বিতর্কের জন্য যে রসদ লাগে, তার ঘাটতি থেকেই যায়।

এত দিন শিক্ষকই ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়ে গেছেন, উত্তরের সন্ধান দিয়েছেন, লিখিয়েছেন এবং এভাবে পরীক্ষার ঘাট পেরোনোর জন্য তৈরি করে দিয়েছেন, শিক্ষার্থীরা তাঁদের কাছে তৈরি-উত্তর পেয়েছে, অভিভাবকও তাই চেয়েছেন। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী কারোরই (ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে) না হলো বই পড়ার অভ্যাস, না কিছু পড়ে নিজে নিজে বোঝার ক্ষমতা, তৈরি হলো না নিজের মতামত গঠনের ইচ্ছা ও সামর্থ্য। এভাবে সমাজ যেন জ্ঞানের চাহিদাই হারিয়ে ফেলল।

আবারও বলি, জ্ঞান বা বিদ্যা কারও জন্যই তৈরি পোশাকের মতো সামগ্রী নয়, এটি প্রত্যেক শিক্ষার্থীকেই নিজের চেষ্টায়-চর্চায় আয়ত্ত ও আত্মস্থ করতে হয়। এর বিপরীত পথে চলে আজ আমাদের শিক্ষা, শিক্ষক, এমনকি অভিভাবক, প্রায় সবাই জ্ঞানের বিচারে তামাদি মানুষে পরিণত হচ্ছেন। প্রযুক্তি ও ভোগ্যপণ্য ব্যবহারে আধুনিক, কিন্তু মননে ও চিন্তায় প্রাচীন—এটাই সাধারণ বাস্তবতা। একটি পিছিয়ে পড়া ব্যবস্থায় পড়ে থেকে বর্তমান বিশ্বের দায়িত্বশীল উপযুক্ত সক্ষম নাগরিক হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। তবে বরাবরই মানুষের মধ্যে ব্যতিক্রম থাকেন, সব প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁরা মৌলিক স্বকীয় মানুষ হিসেবে বেরিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু প্রতিভাবান বা ব্যতিক্রমদের জন্য ব্যবস্থা নয়, তাঁদের রক্ষা করেই সব শিক্ষার্থীর জন্য সার্বিক বিকাশের উপযোগী হতে হবে একে। আমরা হয়তো অবশেষে বহু বছরের দ্বিধা, পিছুটান কাটিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে শিক্ষায় বহু প্রত্যাশিত গুণগত পরিবর্তনের পথে এগোতে যাচ্ছি। সে জন্য সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে আশা করব, অদূর ভবিষ্যতে সমাজে বিশুদ্ধ জ্ঞানের চাহিদা তৈরি হতে দেখব আমরা।

বিশ্বায়ন নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক থাকলেও মানতেই হবে, আজ আমরা সবাই বিভিন্ন দেশের নাগরিক ও সংস্কৃতির প্রতিনিধি হয়েও একই বিশ্বের নাগরিক। জ্ঞান কখনোই খণ্ডিত বা আঞ্চলিক নয়, তা সর্বজনীন। তার কিছু পরিবর্তনশীল বা ক্রমাগ্রগতিশীল, কিছুবা চিরন্তন। ফলে প্রকৃত জ্ঞানচর্চার জন্য উদার ও মুক্ত মানসিকতা দরকার। তেমন আবহ ও চাহিদা তৈরি হলেই নতুন ব্যবস্থা সফল হবে। বর্তমান শিক্ষার্থীদের চ্যালেঞ্জটাও বুঝতে হবে—তাদের যুগপৎ নিজ দেশ ও বিশ্বনাগরিক হতে হবে, চিরকাল এবং একাল, ঐতিহ্য ও পরিবর্তনকে সঠিকভাবে মেলাতে হবে। এর প্রস্তুতিতে মুখস্থবিদ্যা কাজে আসবে না। তাকেই জ্ঞানার্জনের অভিযাত্রায় মূল উদ্যোক্তা হতে হবে, পরজীবী হলে চলবে না।

এত দিন শিক্ষকই ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়ে গেছেন, উত্তরের সন্ধান দিয়েছেন, লিখিয়েছেন এবং এভাবে পরীক্ষার ঘাট পেরোনোর জন্য তৈরি করে দিয়েছেন, শিক্ষার্থীরা তাঁদের কাছে তৈরি-উত্তর পেয়েছে, অভিভাবকও তাই চেয়েছেন। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী কারোরই (ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে) না হলো বই পড়ার অভ্যাস, না কিছু পড়ে নিজে নিজে বোঝার ক্ষমতা, তৈরি হলো না নিজের মতামত গঠনের ইচ্ছা ও সামর্থ্য। এভাবে সমাজ যেন জ্ঞানের চাহিদাই হারিয়ে ফেলল।

পুরোনো সেই অভ্যাস ছেড়ে এখন আমাদের ভবিষ্যতের সমাজ গড়ার কাজ শুরু করতে হবে। বিলম্বিত হলেও এ কাজে হাত দেওয়াই স্বস্তির বিষয়। এবার শিক্ষার্থীই বিষয় জানার, বোঝার এবং এ সম্পর্কে নিজের বক্তব্য বলার, লেখার ক্ষমতা অর্জন করবে। এই ব্যবস্থাকে সফল করার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি প্রয়োজন এবং তা বিপুল। অথচ উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে ভবিষ্যতের যোগ্য নাগরিক তৈরি জরুরি, আর তার জন্য এ পথ ছাড়া অন্য পথ নেই। তাই আমি বারবার বলেছি যে অবিলম্বে শিক্ষায় মেগা প্রকল্প প্রণয়ন ও চালু করা প্রয়োজন। যেহেতু এটি এক গুণগত পরিবর্তন, তাই রাতারাতি কিছু করা যাবে না, প্রস্তুতি নিয়ে ধাপে ধাপে এগোতে হবে। যত দূর বুঝি, সরকারও সেভাবেই চিন্তা করছে।

নতুন ব্যবস্থায় ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, শ্রেণিকক্ষের পরিসর, বিজ্ঞান ও কম্পিউটার ল্যাব, পাঠাগার এবং খেলার মাঠ ও সরঞ্জাম, টিফিন ও সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা রেখে স্কুল সময় বাড়াতে হবে। মেধাবী তরুণদের শিক্ষকতার পেশায় আকৃষ্ট করার জন্য বেতন স্কেল উন্নয়ন এবং তাদের অব্যাহত জ্ঞানার্জনের, আকর্ষণীয় ও আনন্দময় পাঠপরিকল্পনা তৈরি করে শ্রেণিকক্ষ প্রাণবন্ত করার প্রশিক্ষণের, প্রয়োজনীয় উপকরণ ও অবকাশের নিশ্চয়তা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীর ক্রমাগ্রগতি ও মূল্যায়নের জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনাসংবলিত বিস্তৃত পরিকল্পনা থাকতে হবে।

এ মেগা প্রকল্প সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়নে ধাপ অনুযায়ী বিস্তৃত পরিকল্পনা ও উপযুক্ত বাজেট বরাদ্দও নিশ্চিত করা চাই। দেশের মানুষকে প্রকৃত মানবসম্পদে রূপান্তর করার কাজে আর দেরি করা যাবে না। উন্নয়নের সাফল্য ধরে রাখতে এবং সবার কল্যাণে কাজে লাগাতে হলে এর বিকল্প নেই। নয়তো এত উন্নয়নের পরও সমাজে অনৈতিক-অমানবিক কর্মকাণ্ডের ঢল থামানো যাবে না। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রমাগত দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলে গেছেন, আক্ষেপ করেছেন, ক্ষোভ ও ক্রোধ প্রকাশ করছেন, কিন্তু সে কথায় কেউ কান দিয়েছেন বলে মনে হয় না।

আমি বলব, মুজিব বর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই মোহনায় দাঁড়িয়ে সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়ার যোগ্য নাগরিক তৈরির লক্ষ্যে প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নে এ বছরই একটি শিক্ষা দশক চালু করা হোক।

আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক