পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি কি সত্যিই হেরেছে?

নরেন্দ্র মোদি ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
ফাইল ছবি

বিজেপির সরকার গড়ার স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পর এ রাজ্যে মুসলমানেরা আলোচনার কেন্দ্রে এসে পড়েছে। কারণ, দেশভাগের পর থেকে এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানেরা কোনো একটি দলের পক্ষে প্রায় উজাড় করে ভোট দিয়েছে।

রাজ্যের ভোটারদের নজিরহীন মেরুকরণের ফলে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা এবার কার্যত দুটি দলের দখলে—তৃণমূল আর বিজেপি। একটা আসন পেয়েছে নবজাতক দল ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এবার বিধানসভায় মুসলমান বিধায়কের সংখ্যা কমেছে।

কারণ, পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে এই প্রথম রাজ্য বিধানসভায় কংগ্রেস বা সিপিএমের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। এমনকি মালদহ বা মুর্শিদাবাদের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা থেকেও ওই দুই দল কোনো প্রার্থীকে জেতাতে পারেনি—অথচ ৭০ বছর ধরে ওই দুই জেলা ছিল কংগ্রেস আর সিপিএমের শক্ত ঘাঁটি। গত বিধানসভায় মুসলমান বিধায়কের সংখ্যা ছিল ৫৯ (তৃণমূল ৩২, কংগ্রেস ১৮ আর সিপিএম ৯)। এবারের বিধানসভায় মুসলমান বিধায়কের সংখ্যা ৪৪ (একজন আইএসএফের)।

কেন এমন হলো? ২০১৯ সালে রাজ্যে লোকসভা ভোটের পর থেকে বিজেপির উত্থান এবং এবারের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর রাজ্যজুড়ে ধুন্ধুমার প্রচার মুসলমানদের সন্ত্রস্ত করে তোলে।

তারই পরিণামে ভীত-সন্ত্রস্ত পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানের প্রায় একচেটিয়া ভোট গিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে। তাদের মনে হয়েছে, এ রাজ্যে মমতা ছাড়া বিজেপিকে আটকানোর ক্ষমতা আর কারও নেই।

এমনকি বাম-কংগ্রেসের অনেক নিশ্চিত ভোটও গেছে তৃণমূলের দিকে। ভোটের এই ফলাফলের পরে রাজ্যের গড় মুসলমানের প্রতিক্রিয়া মোটামুটি এই রকম: ‘বিজেপির মতো আদ্যন্ত একটা সাম্প্রদায়িক দলকে তো আটকানো গেল। আপাতত কিছুকাল নির্ভয়ে বাঁচা যাবে।

আজকে কে জিতল, তৃণমূল ভালো না খারাপ—এসব তর্ক অবান্তর। বাকি তর্ক, লড়াই সব তোলা থাক, পরে বুঝে নেওয়া যাবে। আপাতত বিজেপিকে হারানো গেছে।’

কিন্তু বিজেপি কি সত্যিই হেরেছে? সরকার গঠন করতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু বিজেপির মতো একটা সাম্প্রদায়িক, হিন্দুত্ববাদী, ফ্যাসিস্ট মতাদর্শের রাজনৈতিক দল রাজ্য বিধানসভায় ৭৭টি আসন (গত বিধানসভায় ছিল ৩ জন বিধায়ক) নিয়ে প্রবল বিরোধী হিসেবে জেঁকে বসেছে। তৃণমূল পেয়েছে ৪৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ ভোট। আর বিজেপি পেয়েছে ৩৮ দশমিক ১৩ শতাংশ।

অর্থাৎ রাজ্যের হিন্দু ভোটের অর্ধেকেরও বেশি ভোটারের সমর্থন তারা পেয়েছে। ‘আপাতত কিছুকাল নির্ভয়ে বাঁচা’র মতো স্বস্তির জায়গা কিন্তু নেই। রাজ্যের মোট ২৭ শতাংশ মুসলমান ভোটের ২৬ শতাংশও যদি তৃণমূল পেয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে মাত্র ২১ শতাংশ হিন্দু ভোট তৃণমূলের পক্ষে গেছে।

আসলে গত ১০ বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসন আমলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বা আরএসএস এ রাজ্যে তার প্রভাব বাড়িয়েছে ঝড়ের গতিতে। মনে রাখতে হবে, ফ্যাসিবাদ একটি মতাদর্শ। বিজেপি সাম্প্রদায়িক, কিন্তু তার আসল চালিকা শক্তি রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ ফ্যাসিস্ট শক্তি। যেনতেন প্রকারে সংসদীয় ক্ষমতা দখল করা বিজেপির লক্ষ্য। আরএসএস এবং সংঘ পরিবারের লক্ষ্য বৃহৎ এক হিন্দুরাষ্ট্রের নির্মাণ।

ফলে বিজেপি হেরে গেল আর পশ্চিমবঙ্গ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির আগ্রাসন থেকে মুক্ত হলো—এ রকম যাঁরা ভাবছেন, তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। গত ১০ বছরে আরএসএস তাদের বিভিন্ন শাখা সংগঠনের মাধ্যমে সামাজিক কাজকর্মের স্থায়ী প্রকল্পগুলোকে বাড়িয়েছে দুরন্ত গতিতে।

২০১১ সালে এই ধরনের সংগঠনের সংখ্যা ছিল ২০০–এর কম, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৪৫০–এর বেশি। আরএসএস তার প্রচারের কাজটা চালায় মূলত ‘শাখা’র মাধ্যমে। তারা পাড়ায় পাড়ায় গড়ে তোলে শাখা এবং ‘প্রচারক’দের মাধ্যমে মতাদর্শের বিস্তার ঘটায়। বামফ্রন্ট আমলে রাজ্যে শাখার সংখ্যা ছিল নিতান্তই হাতে গোনা।

রাজ্যে এখন ১ হাজার ৬০০–এরও বেশি শাখা সক্রিয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরএসএসকে তাঁর শত্রু মনে করেন না, তাঁর শত্রু বিজেপি। আরএসএস তার লক্ষ্য পূরণে কতটা সফল, বোঝা যায় বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজেকে খাঁটি হিন্দু প্রমাণ করার আপ্রাণ চেষ্টায়।

পশ্চিমবঙ্গের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ মুখ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভরা জনসভায় চণ্ডীমন্ত্র মুখস্থ আউরে তাঁকে ভক্তিমতী ব্রাহ্মণকন্যা প্রমাণ করতে হয়েছে। ভোটের প্রচারে যেখানেই গেছেন, আগেই তাঁকে মন্দিরে গিয়ে পূজা দিতে হয়েছে। ভোটে বিজেপি হারলেও হিন্দুত্ববাদী দর্শন পিছু হটেনি, বরং তা ক্রমেই সংগঠিত চেহারা নিচ্ছে। প্রতিপক্ষকে হিন্দুত্বের পথে হাঁটতে বাধ্য করছে।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটার ভোট দেয় সাধারণত দুটি বিষয়কে মাথায় রেখে। কোনো দল বা সরকার—
এক. সেই সম্প্রদায়ের পরিচিতি রক্ষা করতে কতটা আন্তরিক, আর
দুই. সংখ্যালঘু উন্নয়নে তাদের ভূমিকা কী।
প্রথমটি অবশ্যই সাধ্যের মধ্যে। কিন্তু দ্বিতীয়টি খুবই কঠিন।

প্রতীচী ইনস্টিটিউটের ন্যাশনাল রিসার্চ কো-অর্ডিনেটর সাবির আহমেদ তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানের উন্নয়ন যে গতিতে হচ্ছে, তা মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। ২০০৮ সালে রাজ্য সরকারি চাকরিতে মুসলমান ছিল ৫ শতাংশ ১৯ শতাংশ, ২০১৫-১৬ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৬ দশমিক ০৮ শতাংশ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল মতিনের অভিযোগ, ‘তিনি (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) একদিকে হিন্দুত্ব পলিটিকসও করছেন, আবার প্রগতিশীল যুক্তিবাদী মুসলমান সম্প্রদায়কে না দেখে একটি রক্ষণশীল মুসলমান গ্রুপকে প্রণোদনা দিচ্ছেন। যার ফলে মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রগতিশীল অংশটি, যারা গণতান্ত্রিক ভাষায় কথা বলতে পারবে, সম–অধিকারের পক্ষে কথা বলতে পারবে, সেই কথাগুলো সামনে আসছে না।’

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে বিজেপির সবচেয়ে বড় অভিযোগ ‘সংখ্যালঘু তোষণ’। এই প্রচারে কিন্তু খোদ মুখ্যমন্ত্রীর প্রচ্ছন্ন ভূমিকা আছে। তিনি রেড রোডে ঈদের নামাজে নিয়মিত হাজিরা দেন। বিভিন্ন সরকারি এবং দলীয় বিজ্ঞাপনে মুসলমানদের ঈদের শুভেচ্ছা জানান হিজাব মাথায়। যখন-তখন যেখানে–সেখানে ‘ইনশা আল্লাহ’ বলে বোঝাতে চান, তিনি তাঁদেরই লোক।

ইমাম, মুয়াজ্জিনদের ভাতা দেন। মসজিদ–কবরস্থান ঢেলে সাজানোর জন্য অর্থ বরাদ্দ করেন। পরিচিতির রাজনীতিকে মদদ দেওয়ার মধ্যে দিয়ে তিনি প্রমাণ করতে চান যে তিনি মুসলমানদের কাছের মানুষ।

বাস্তবে এর কতটা সত্যি বা কতটা লোকদেখানো, মুসলমানদের অনেকেই তা বুঝলেও নানা কারণেই চুপ করে থাকেন। এই সুযোগে হিন্দু বাঙালির কাছে মমতাকে ‘মুমতাজ বেগম’ হিসেবে দেগে দেওয়া গেছে।এভাবেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ফাটল ক্রমেই চওড়া হতে থাকে।

হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি যত বাড়বে, মুসলমানরা ততই কোণঠাসা হবে, আতঙ্কিত হবে। এবার বিধানসভায় বিজেপি তার আসন বাড়িয়েছে গতবারের চেয়ে ২০ গুণের বেশি। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি তার নখ–দাঁত ক্রমেই ভয়ংকরভাবে বের করবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তাই বিজেপি হারলেও ফ্যাসিবাদ পরাজিত হয়নি। বামশূন্য বিধানসভায় সে প্রবল শক্তি নিয়ে নিজেকে সংহত করবে। মতাদর্শের লড়াইয়ে দক্ষিণপন্থা জিতেছে। তৃণমূলও আদতে একটি দক্ষিণপন্থী দল। বিজেপির মতোই তারা কমিউনিস্টদের শত্রু। তাদের আসল শত্রু বামেরা এবারের ভোটে পিছু হটেছে। কয়টা আসন পেল, তা বড় কথা নয়। আগামী দিনের রাজনীতিতে দ্বন্দ্ব কিন্তু দুই মতাদর্শের—দক্ষিণ বনাম বাম।

মিলন দত্ত পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক ও সমাজকর্মী