পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন, আব্বাস এবং বামপন্থীরা

ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্টের নেতা আব্বাস সিদ্দিকী জনসভায় বক্তৃতা করছেন
ছবি প্রথম আলো

ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকীর অতীত কারও অজানা নয়। ভবিষ্যতে কী করবেন, বলবে ভবিষ্যৎ। তবে এই মুহূর্তের আব্বাস, কেন জানি না মনে করিয়ে দিচ্ছেন মাওলানা ভাসানীকে। ‘ভাসানী—দ্য রেড মাওলানা’!

যদিও এখনই তুলনা টানার সময় মোটেই আসেনি, তবু এ-ও ঠিক, আব্বাস মনে করাচ্ছেন ভাসানীকে।

বাংলাদেশের কিংবদন্তি নেতা ভাসানী একদা ছিলেন মুসলিম লীগের নেতা। কিন্তু পাকিস্তান-পরবর্তীকালে তিনিই হয়ে উঠেছিলেন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এবং শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের সমর্থক ও প্রচারক। কমিউনিস্টদের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। ১৯৪৮ সালে ভাসানীই প্রথম পূর্ব পাকিস্তানের আইন পরিষদে প্রদেশের জন্য অধিকতর ক্ষমতার দাবি উত্থাপন করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘ব্রিটিশের শাসন মানি নাই, এবারও কেন্দ্রের হুকুমদারি মানব না।’ পরের বছর তাঁর নেতৃত্বে যে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিল, সেই দলের সেই সময়ের কর্মসূচিতেও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি গুরুত্বসহকারে স্থান পেয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ভাসানীর উদ্যোগেই দলের নাম থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল ‘মুসলিম’ শব্দটি। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং জনগণের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উত্তরণের ক্ষেত্রে এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

আব্বাস সিদ্দিকীর দলের নাম অবশ্য ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ)। এটা শুধু মুসলমানদের সংগঠন নয়। এতে রয়েছে নানা ধরনের প্রান্তিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব। দলের সভাপতি শিমুল সোরেন মুসলমান নন, আদিবাসী সমাজের প্রতিনিধি। প্রার্থী তালিকায়ও থাকছে অনগ্রসর, জনজাতির প্রতিনিধিত্ব। আব্বাসেরা ঘোষণা করেছেন, দলের লড়াই সামাজিকভাবে অনগ্রসর মানুষের জন্য। আদিবাসী, তফসিলি, নিম্নবর্ণের হিন্দু—যাদের কাছে এখনো উন্নয়নের ছিটেফোঁটাও পৌঁছায়নি। ব্রিগেডেও তাঁর ভাষণে ছিল না কোনো সাম্প্রদায়িক উপাদান। মুখ্যমন্ত্রীর মতো আব্বাস সিদ্দিকী কথায় কথায় ‘ইনশা আল্লাহ’ বলেননি। ইমাম ভাতা বা হজ যাত্রায় ভাতার দাবি তোলেননি। বলেছেন কর্মসংস্থানের কথা। প্রশ্ন করেছেন কেন চাকরি চাইতে আসা ছাত্র-যুবকদের লাঠি মারল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের পুলিশ। কেন পঞ্চায়েত-পৌরসভা-সরকারের টাকা লুট হচ্ছে?

এই প্রশ্নগুলো কি সাম্প্রদায়িক? কেউ তা বলতে পারছে না। তাই বলছে, কেন ফেজ টুপি? মুখ্যমন্ত্রী হিজাব টেনে ভাষণ দিতে পারেন, অসুবিধা নেই। কিন্তু একজন মুসলমান কেন ধর্মীয় প্রথা মেনে ফেজ টুপি পরেছেন, সেই প্রশ্ন তুলছেন এরা—কী উদ্দেশ্যে, সেটা স্পষ্ট। আব্বাস একবারও বলেননি ‘আল্লাহু আকবর’, কিংবা ‘ইসলাম খতরে মে হ্যায়’। ভিক্ষা নয়। চেয়েছেন অধিকার। বলেছেন মানুষের হক বুঝে নেওয়ার কথা। ‘আমরা ভাগ চাইতে এসেছি, তোষণ করতে নয়! বাবাসাহেব বলেছিলেন, “ভিক্ষে করে কিছু মেলে না। হক বুঝে নিতে হয়।”’

তৃণমূলের মঞ্চে দাঁড়িয়ে টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করলে অসুবিধা নেই। যোগী আদিত্যনাথ ঘৃণা ও খুনের রাজনীতির কথা প্রকাশ্যে বলেও বিজেপির নেতা হওয়ায় তা জায়েজ। গুজরাট দাঙ্গার নায়ক নরেন্দ্র মোদিকে ভোট দেওয়া যায়! কিন্তু সব বেকারের চাকরির দাবি জানানো আব্বাস সাম্প্রদায়িক?

ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্টের ঘোষণাপত্রে রয়েছে আদিবাসী, তফসিলি জাতি, অন্যান্য অনগ্রসর অংশ, সংখ্যালঘু এবং বর্ণহিন্দুসহ সবার কথা। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত সুফি ঐতিহ্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেলবন্ধনের কথা বলেছে ওরা। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ তো ধর্মাচরণের বিরোধিতা নয়। যে যার বিশ্বাসমতো ধর্মাচরণের অধিকার সংবিধান দিয়েছে, তাকে রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

বামপন্থীরা দুই মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধেই অবিরাম সংগ্রামে ছিলেন এবং আছেন। সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে যেকোনো দেশেই সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতা বেশি বিপজ্জনক। যেমন ভারতে হিন্দুত্ববাদী শক্তি, বাংলাদেশে ইসলামিক সাম্প্রদায়িক শক্তি। কিন্তু এই দুয়ের মধ্যে যোগসূত্রও থাকে। যেমন স্বাধীনতার আগে মুসলিম লীগ এবং হিন্দু মহাসভার মধ্যে ছিল। তারা একসঙ্গে বাংলাসহ কিছু প্রদেশে মন্ত্রিসভাও চালিয়েছিল। কে না জানে অবিভক্ত বাংলা প্রদেশে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার (১৯৪১-৪৩) ডেপুটি ও অর্থমন্ত্রী ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ২৩ মার্চ, ১৯৪০- লাহোরে হক সাহেব ‘পাকিস্তান’ প্রস্তাব করার পরও দস্তুরমতো ছিল লীগ-মহাসভার এই জোট। একসঙ্গে দেশভাগও চেয়েছিল তারা।

মানুষের জীবন-জীবিকা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের ওপর আক্রমণের মোকাবিলা—শুধু নির্বাচনী সংগ্রামই নয়, এই লড়াই সুদূরপ্রসারী। সে কারণে এই সংযুক্ত মোর্চাকে কেবল নির্বাচনী সংগ্রামের মধ্যে সীমিত করে না রেখে সুদূরপ্রসারী হাতিয়ার করতে চাইছেন বামপন্থীরা।

এখন আবার এই দুই সাম্প্রদায়িক শক্তির মেরুকরণের বিপদ দেখা যাচ্ছে। এই মেরুকরণ না হলে বিহারের নির্বাচনে আরও অনেক ভালো ফলাফল হতে পারত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে যদি এমন মেরুকরণ সফল হয়, তাহলে আমাদের প্রাক্‌-স্বাধীনতা যুগের দেশভাগ ও দাঙ্গার পরিস্থিতিতে ফিরে যেতে হবে। অন্ধকার ফিরে আসবে। তাই বিজেপি এবং তৃণমূলবিরোধী সব ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর ব্যাপকতম ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন বামপন্থীরা।

এই পর্যন্ত বামপন্থার সঙ্গে বিরোধ কোথায়? শোষণমুক্তির দাবির সঙ্গেই বা বিরোধ কোথায়? এখন কেউ বলতেই পারেন, এ তো ‘আইডেন্টিটি পলিটিকস’! বামপন্থীদের কাজ তো ‘ক্লাস পলিটিকস’! ঠিক। তবে সম্পূর্ণ ঠিক নয়। আসলে, পরিচিতিসত্তার রাজনীতিতে পুরোপুরি গা ভাসানো যেমন ঠিক নয়, তেমনই একে অবজ্ঞা করাও হবে একটি যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি—যা শুধুই শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি ও শ্রেণি আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলে। সামাজিক নিপীড়ন বৈষম্যের বাস্তবতাকে বিবেচনায় আনে না। দলিত, আদিবাসী, মহিলা, মুসলিম—তাদের বিচ্ছিন্নতা কেবল শ্রেণি শোষণের কারণেই নয়। সামাজিক নিপীড়ন ও বৈষম্যেরও শিকার তারা।সে কারণে জরুরি হলো সামাজিক নিপীড়নের নির্দিষ্ট বিষয়কে তুলে ধরা এবং শ্রেণি শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাকে যুক্ত করা।

নিপীড়িত শ্রেণি, সামাজিক অংশের মেলবন্ধন ঘটানোই বামপন্থীদের লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্যেই সংযুক্ত মোর্চা। মানুষের জীবন-জীবিকা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের ওপর আক্রমণের মোকাবিলা—শুধু নির্বাচনী সংগ্রামই নয়, এই লড়াই সুদূরপ্রসারী। সে কারণে এই সংযুক্ত মোর্চাকে কেবল নির্বাচনী সংগ্রামের মধ্যে সীমিত করে না রেখে সুদূরপ্রসারী হাতিয়ার করতে চাইছেন বামপন্থীরা।

শান্তনু দে পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক