পাঁচ আঘাতে বিপর্যস্ত জনপদ

বন্যাকবলিত অনেক এলাকায় অগভীর নলকূপ তলিয়ে গেছে। এর ফলে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। মঙ্গলবার গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের বালাসি গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো
বন্যাকবলিত অনেক এলাকায় অগভীর নলকূপ তলিয়ে গেছে। এর ফলে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। মঙ্গলবার গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের বালাসি গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

‘হামার বাড়ি ১২ বার ভাঙছে তিস্তায়। এবারও তলে গেছলো। আল্লাহ জানে কী হইবে। হামার তো আল্লাহ ছাড়া আর কাঁইয়ো নাই।’ রংপুর জেলার কাউনিয়া উপজেলার দ্বীপচর হাবু হয়বত খাঁতে শাহ আলী নামের এক বৃদ্ধ করুণ স্বরে এ কথাগুলো বলছিলেন। কথা না বাড়িয়ে তিনি ছাগল নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা করেন। শাহ আলী কোনো ত্রাণ পাননি। একজীবনে ১২ বার বাড়িভাঙা মানুষের কষ্ট কি আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব? বুঝতে পারবেন কি আমাদের নীতিনির্ধারকেরা? 

বন্যা পরিস্থিতি দেখতে তিস্তা তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় গিয়েছিলাম। কাউনিয়া উপজেলার নদীসংলগ্ন গাজীর বাজারে কথা হয় স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে। তাঁরা বন্যায় কোনো সহায়তা পাননি উল্লেখ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। গাজীর বাজারের পাশে নদী ঘেঁষে কয়েকটি বাড়ি। তঁারা খুব ভয়ে আছেন। যেকোনো সময় ভাঙতে পারে তাঁদের বাড়ি। কিন্তু বাড়ি ভাঙার আগে তঁারা কোথাও যাবেন না। একজন মাঝবয়সী নারী বলেছিলেন ‘কোনঠে যামো? হামাক কাঁয় থাইকপার দেবে? যতক্ষণ না ভাঙে ততক্ষণ এঠে থাকমো।’ সত্যি তো, তঁাদের ভরসা কে? সরকার কি তাঁদের ভরসা? আমাদের বড় বড় উন্নয়নের ফিরিস্তি আছে। কিন্তু সহায়হীন এসব মানুষের বঞ্চনার কোনো ফিরিস্তি কেউ সামনে আনেন না। এককথায় বানভাসি মানুষের নিরাপদ আশ্রয় আজও আমাদের দেশ দিতে পারেনি। 

বন্যার সময় পানি বাড়িতে ঢুকে পড়লেও দুর্গত ব্যক্তিরা সহজে বাড়ি ছাড়তে চান না। বাড়ি পানির নিচে ডুবে যেতে শুরু করলে প্রথমে তাঁরা বিছানার ওপর আশ্রয় নেন। পানি আরও বেড়ে গেলে দুটি চৌকি জোড়া দেন। এতেও কাজ না হলে উঁচু সড়কে প্লাস্টিকের ছাউনি তৈরি করে অস্থায়ী নিবাস গড়েন। প্লাস্টিকের নিচে গরু, ছাগল, হাঁস–মুরগি নিয়ে পরিবারের সব সদস্য কোনোরকম বসে-শুয়ে থাকেন। রাষ্ট্রের প্রতি তাঁদের কোনো অধিকার আছে কি ন, তঁাদের অনেকেই হয়তো জানেনও না। অপেক্ষায় থাকেন কোনো সহায়তা পাওয়া যায় কি না। সেটি সরকারি হলেই কী, বেসরকারি হলেই কী। 

বন্যার সময় স্থানীয় মহাজনেরা ভয়ংকর নিয়তি হিসেবে আবির্ভূত হন। উচ্চ সুদে বানভাসিরা ঋণ নেন। বন্যা শেষ হতে না–হতেই শুরু হয় সেই কিস্তি দেওয়া। বন্যা যেন সুদারুদের জন্য আশীর্বাদ। অনেক বানভাসির সারা বছরের উপার্জন সুদের টাকা পরিশোধ করতেই চলে যায়। বানভাসি মানুষের জন্য বিনা সুদে এ সংকটে যদি ঋণও দেওয়া যেত, তাহলেও তাঁরা স্বস্তি পেতেন। সেই চেষ্টা সরকার করে না।

এ বছর ধারাবাহিকভাবে পাঁচবারের ক্ষতির মধ্যে পড়েছে এ অঞ্চলের অনেক মানুষ। এ বছর ধান ঘরে ওঠার আগেই একবার ঘনবৃষ্টি নেমেছিল। সেই বৃষ্টির পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি বলে সেটি বন্যা বলে বিবেচিত হয়নি। কিন্তু ওই বৃষ্টিতে লাখ লাখ হেক্টর জমির সোনালি ধান ডুবে গেছে পানিতে। এরপর এল বন্যা। এই বন্যায় ডুবে গেছে বীজতলা এবং সবজিখেত। প্রথম বন্যায় অনেকেই বাড়ি ছেড়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন নদী রক্ষা বাঁধে কিংবা অন্য কোনো উঁচু স্থানে। প্রথমবারের বন্যা যখন শেষ হচ্ছিল, তখনই দ্বিতীয়বারের মতো বন্যা দেখা দিয়েছে। সেই পানি কমতে ন–কমতেই তৃতীয়বারের মতো বন্যায় ডুবে আছে নদীতীরবর্তী জনপদ। ঘন বর্ষণে অনেক স্থানেই সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। তিনবার বন্যা, বন্যা শুরুর আগে বৃষ্টির পানিতে ফসলহানি। সেই সঙ্গে কোভিড-১৯ আক্রান্ত জনজীবন। সরকার এগিয়ে না এলে এ অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের পক্ষে এ চাপ সামাল দেওয়া অসম্ভব। 

বলার অপেক্ষা রাখে না, এ বন্যার প্রধানত দায় মানুষের। জলাবদ্ধতারও প্রধানতম কারণ মানুষ। উন্নয়নের চাপে পড়ে নদী হাঁসফাঁস করতে থাকলে বন্যা কিংবা জলাবদ্ধতা অনিবার্য ফল হিসেবে দেখা দেবে, এটাই স্বাভাবিক। নদীমাতৃক বাংলাদেশে কোথাও কোনো জলাবদ্ধতা দেখা দেওয়ার কথা নয়। সুষ্ঠু নদী ব্যবস্থাপনা থাকলে ভয়াবহ পাহাড়ি ঢল এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত ছাড়া বন্যার আশঙ্কাও থাকার কথা নয়। কিন্তু আমাদের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সেদিকে মনোযোগ নেই বললেই চলে।

পানি কমতে থাকলে ভাঙন তীব্র হয়। পানিবাহিত রোগের সংক্রমণ বাড়তে থাকে। সাপের কামড়ে অনেকেই মারা যায়। পানিতে ডুবে থাকা ঘরের আনাচে-কানাচে সাপ লুকিয়ে থাকে। এসব বিষয়ে সরকারের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা কোনোকালেই ছিল না। সরকারের উন্নয়নের তলানিতে যে কত গাদ জমে আছে, বন্যার সময় এলেই বানভাসিদের জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনা দেখলেই বোঝা যায়। দু–চার–দশজন মানুষ নয়, লাখ লাখ মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

সরকার প্রতিবছর দেশের সব জেলায় যে ত্রাণ দিয়ে থাকে, সেই ত্রাণ দিয়েছে এ বছরও। জেলাবিশেষে এক শ থেকে দুই শ মেট্রিক টন চাল। যে জেলায় বন্যা হয়নি সেই জেলায় যা বরাদ্দ, যে জেলায় তিনবার বন্যা হয়েছে, সেই জেলার জন্যও একই বরাদ্দ। সরকার প্রথমবারের বন্যায় কিছু শুকনো খাবার দিয়েছে। গোখাদ্য ক্রয়ের জন্য সামান্য কিছু টাকা দিয়েছে। কোনো কোনো জেলায় আরও কিছু চাল দিয়েছে। ঈদ উপলক্ষে প্রতিবছরের মতো এ বছরও কিছু পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল দিচ্ছে সরকার। তবে সেটি বন্যার্তদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ নয়। বন্যার্তদের জন্য সরকারি যে সহায়তা, তা খুবই অপ্রতুল।

জমির ফসল খায় নদী। জমিও খায়। ঘরবাড়ি ভেঙে নেয় আপন গর্ভে, আপন গর্ভে নেয় অযুত লোকের স্মৃতিবিজড়িত ঠিকানা। বন্ধু-স্বজনবিচ্ছিন্ন হয়ে একেক পরিবার একেক স্থানে চলে যায়। অনেকেই এত দূরে চলে যায় যে আর কোনো দিন দেখাও হয় না। শুধু সম্পদের ক্ষতি নয়, মানবিক জীবনের এক চরম অবনমন হয়। দেশে উন্নয়ন হয়েছে অনেক। এ কথা তো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তেমনি এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে নদীতীরবর্তী মানুষের জীবনে নেমে এসেছে আগের চেয়ে বড় বিপর্যয়। 

বন্যার্তদের সমস্যা স্থায়ীভাবে সমাধান করার কোনো বিকল্প নেই। শুষ্ক মৌসুমে নদী ব্যবস্থাপনায় মনোযোগ দিতে হবে। নয়তো পরবর্তী বছরেও ভয়াবহ বন্যার অপেক্ষায় থাকতে হবে।

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপলের পরিচালক