পাকিস্তান নিজেকেই ধোঁকা দিয়ে চলেছে

১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ভূখণ্ডে যা ঘটেছিল, তা সম্পর্কে মিথ্যাচারের বেলায় পাকিস্তানের সেই সময়ের সামরিক স্বৈরাচার সরকার ও এখনকার নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের মধ্যে যে কোনো পার্থক্য নেই, তা আমরা লক্ষ করলাম সম্প্রতি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর। আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ওই দুই অতিপরিচিত যুদ্ধাপরাধীর প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ১৯৭১ সালে এ দেশে কোনো গণহত্যা ঘটেনি। পাকিস্তানের সরকারগুলোর তরফে এ ধরনের কথা আমরা শুনে আসছি
চার দশক ধরেই। ১৯৭১ সম্পর্কে মিথ্যাচার তাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। মিথ্যাচারের মতো অনৈতিক ও গ্লানিকর প্রবণতা যখন সংস্কৃতির মধ্যে মিশে যায়, তখন সেই সংস্কৃতির মানুষের কাছে এটাকে আর গ্লানিকর বলে মনে হয় না। তারা বুঝতে পারে না যে এটা তাদের নিজেদের জন্যই লজ্জা ও গ্লানির বিষয়।
একাত্তরের কৃতকর্মের কথা স্মরণ করে পাকিস্তানের শাসক ও সেনামহলে লজ্জা বা গ্লানি জাগবে এবং সেই গ্লানিবোধ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ও আন্তরিকভাবে আমাদের কাছে ক্ষমা চাইবে—এমন প্রত্যাশা আমরা করতে পারি না। কারণ, তাদের সরকারগুলোর পূর্বাপর আচরণ তেমন ইঙ্গিত দেয় না। অবশ্য আমরা দাবি জানাতে পারি, তোমরা আমাদের কাছে ক্ষমা চাও। কিন্তু তারা যত দিন পর্যন্ত না আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করছে যে তারা আমাদের প্রতি যা করেছে তা অতি নিষ্ঠুর প্রকৃতির অন্যায়, তত দিন পর্যন্ত তাদের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়া বা না-চাওয়ায় কিছু এসে যায় না।

তেমন উপলব্ধি পাকিস্তানের শাসক ও সেনামহলে কবে জাগবে, বা আদৌ জাগবে কি না, তা আমরা বলতে পারি না। এ ব্যাপারে আমরা তাদের সহযোগিতাও করতে পারি না, কারণ আমাদের প্রতি তাদের ঘৃণা ও অবিশ্বাস এখনো অটুট বলে মনে হয়। তাদের আত্মোপলব্ধির জন্য সহায়ক হতে পারে তাদের নিজেদেরই অকপট ও আন্তরিক স্মৃতিচারণা। নিজেদের কৃতকর্মের কথা যদি তারা ভুলে গিয়ে থাকে, তবে সেই সব স্মৃতি ফিরিয়ে আনার অনেক লিখিত উপকরণ খোদ পাকিস্তানেই আছে। আর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ও বইপত্রে তো আছেই। এ লেখায় আমরা পাকিস্তানে লিখিত কিছু উপকরণের আশ্রয় নেব।
যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরেই পাকিস্তান সরকার বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে যে তদন্ত কমিশন গঠন করেছিল, তার প্রতিবেদনে যুদ্ধকালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত অপরাধগুলোর উল্লেখ আছে। ‘হামুদুর রহমান কমিশন’ নামে পরিচিত ওই কমিশন তাদের প্রতিবেদনে সেগুলো উল্লেখ করেছে অভিযোগ হিসেবে। কমিশনের প্রতিবেদনের ভাষায় সেগুলো এ রকম:

ক. ১৯৭১ সালের ২৫/২৬ মার্চ রাতে ঢাকায় যে সামরিক অভিযান শুরু করা হয়, তাতে অত্যধিক ‘ফোর্স অ্যান্ড ফায়ার পাওয়ার’ ব্যবহার করা হয়েছে।
খ. ওই সামরিক পদক্ষেপের পর থেকে গ্রামাঞ্চলে পরিচালিত ব্যাপক মাত্রার অভিযানগুলোতে (‘সুইপিং অপারেশনস)’ নিরর্থক/অকারণ ও কাণ্ডজ্ঞানহীন অগ্নিসংযোগ ও হত্যাযজ্ঞ (সেন্সলেস অ্যান্ড ওয়ান্টন অ্যারসন অ্যান্ড কিলিংস) চালানো হয়েছে।
গ. বুদ্ধিজীবী ও চিকিৎসক, প্রকৌশলী প্রভৃতি পেশাজীবীকে হত্যা করে গণকবর দেওয়া হয়েছে, শুধু (যুদ্ধের) শুরুর পর্যায়েই নয়, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের চূড়ান্ত দিনগুলোতেও।
ঘ. (সেনাবাহিনীর) ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ ফোর্সের অফিসার ও সৈনিকদের নিরস্ত্র করার প্রক্রিয়ায় অথবা তাদের বিদ্রোহ দমনের অজুহাতে হত্যা করা হয়েছে।
ঙ. পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের হত্যা করা হয়েছে, অথবা তাঁরা নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে রহস্যজনকভাবে নিরুদ্দেশ হয়েছেন, অথবা নিরুদ্দেশ হয়েছেন সেনা অফিসারদের সামরিক আইনের দায়িত্ব পালনের ঘটনার মধ্য দিয়ে।
চ. ইচ্ছাকৃত/সুচিন্তিত প্রতিশোধ, পাল্টা আঘাত ও নির্যাতনের একটা উপায় হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার ও সৈনিকেরা পূর্ব পাকিস্তানের একটা বড় অংশের নারীকে ধর্ষণ করেছেন।
ছ. সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের ইচ্ছাকৃত/সুচিন্তিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
হামুদুর রহমান কমিশনের প্রতিবেদনের কোনো বাক্যে ‘জেনোসাইড’ বা গণহত্যা শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু হত্যার যেসব তথ্য সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোতে গণহত্যার উপাদান নিশ্চিতভাবেই আছে। যেমন প্রথমে ৮ বালুচ ব্যাটালিয়ন এবং পরে ৮৬ মুজাহিদ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব পালনকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজিজ আহমেদ খান (সাক্ষী নম্বর ২৭৬) কমিশনে সাক্ষ্য দিয়েছেন: ‘ব্রিগেডিয়ার আরবাব আমাকে জয়দেবপুরের সব ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দিতে বলেন। আমি বহুলাংশে এই নির্দেশ পালন করেছি। জেনারেল নিয়াজি ঠাকুরগাঁও ও বগুড়ায় আমার ইউনিট পরিদর্শন করেন। তিনি আমাদের জিজ্ঞাসা করেন, আমরা কতজন হিন্দুকে হত্যা করেছি। হিন্দুদের হত্যা করার জন্য একটা লিখিত নির্দেশ এসেছিল মে মাসে। ওই নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন ২৩ নম্বর ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার আবদুল্লাহ মালিক।’

এখানে উল্লেখ করা জরুরি যে জাতিগত, নৃগোষ্ঠীগত, ভাষাগত, বর্ণগত, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীগত পরিচয়ের কারণে কোনো জনগোষ্ঠীর সদস্যদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা আন্তর্জাতিক ও দেশীয় আইনে ‘জেনোসাইড’ বা গণহত্যা হিসেবে বিবেচিত হয়। সুতরাং হামুদুর রহমান কমিশনের প্রতিবেদন থেকে ওপরে উল্লেখিত উদ্ধৃতি সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করছে, ‘হিন্দুদের হত্যা করার জন্য লিখিত নির্দেশ’ প্রদান এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় সেসব নির্দেশ পালনের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যা চালিয়েছে।
‘গণহত্যা’ বা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ শুধু হিন্দুদের ওপরই চালানো হয়েছে এমন নয়। ‘পাকিস্তান-পসন্দ’ রাজাকার, আলবদর, আল-শামসের সদস্যরা ছাড়া আর সব বাঙালিই ছিল তাদের বিবেচনায় হত্যাযোগ্য। সে জন্য কোনো তদন্ত বা কর্তৃপক্ষীয় নির্দেশের প্রয়োজন ছিল না। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪ ডিভিশনের জেনারেল স্টাফ অফিসার-১ লেফটেন্যান্ট কর্নেল মনসুরুল হক (সাক্ষী নম্বর ২৬০) হামুদুর রহমান কমিশনের কাছে সাক্ষ্য দিয়েছেন: ‘মুক্তিযোদ্ধা বা আওয়ামী লীগের সদস্য—এমন অভিযোগে এক বাঙালিকে বিশদ তদন্ত ছাড়াই, কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছাড়াই বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’ (‘বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া’ ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহৃত সাংকেতিক শব্দবন্ধ, এর মানে ছিল হত্যা করা।) ওই সাক্ষীর আরও ভাষ্য: ‘নির্বিচার হত্যা ও লুটতরাজের ফলে শুধু পাকিস্তানের শত্রুদেরই লাভ হয়েছে। এই কঠোরতার ফলে আমরা পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নীরব জনগণের সমর্থন হারিয়েছি...একটা উদাহরণই যথেষ্ট: ৫৩ ফিল্ড রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লে. জেনারেল ইয়াকুব মালিকের নির্দেশে কুমিল্লা সেনানিবাসের ম্যাসাকার (২৭/২৮ মার্চ, ১৯৭১), যেখানে একজন সেনা কর্মকর্তার অঙ্গুলি হেলনে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় বাঙালি ১৭ জন সেনা কর্মকর্তা ও ৯১৫ জন সৈনিককে।’ লে. কর্নেল মনসুরুল হক কমিশনকে আরও বলেন, ‘(পাকিস্তান সেনাবাহিনীর) জেনারেলসহ অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে সাধারণ অনুভূতি ছিল ঘৃণার। হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করার মৌখিক নির্দেশ ছিল অনেক।’
২৭৯ নম্বর সাক্ষী ব্রিগেডিয়ার ইকবালুর রেহমান শরিফ হামুদুর রহমান কমিশনের কাছে অভিযোগ করেন, জেনারেল গুল হাসান, যিনি সে সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) ছিলেন, তিনি ‘পূর্ব পাকিস্তানের সেনা ফরমেশনগুলো পরিদর্শনকালে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কতজন বাঙালিকে আপনারা গুলি করে হত্যা করেছেন?’ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যতম শীর্ষ কর্মকর্তা যখন তাঁর অধস্তন কর্মকর্তাদের এহেন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন, তখনই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ২৫ মার্চের মধ্যরাত থেকে পাকিস্তানি বাহিনী ‘পূর্ব পাকিস্তানে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার’ কাজে নেমেছিল—পাকিস্তানের পূর্বাপর সরকারগুলোর এই ব্যাখ্যা তাদের বাঙালি-বিদ্বেষ ও নিধনযজ্ঞ ধামাচাপা দেওয়ার দানবীয় অপপ্রয়াস।

এই কয়েকটি দৃষ্টান্ত একাত্তরে এ দেশে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার পুরো চিত্র তুলে ধরে না। কিন্তু এগুলো হিমশৈলের উপরিভাগের মতো, পানির নিচে অদৃশ্য অংশটি যে অতি বিশাল, তার আভাস এগুলো থেকেই পাওয়া যায়। আমাদের জন্য অবশ্য আভাসের প্রয়োজন নেই, কারণ গণহত্যার অজস্র দালিলিক প্রমাণ আমাদের কাছে আছে, এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আছে অনেক গণকবর, আর আছে অজস্র মানুষের জ্বলজ্বলে স্মৃতি। সুতরাং একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী এ দেশে কী করেছিল, তা জানার জন্য আমাদের পাকিস্তানিদের সাক্ষ্য–প্রমাণের আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই।
পাকিস্তানি শাসক ও সেনামহল যখন নিজেদের সাক্ষ্য ও দলিলগুলোই অস্বীকার করতে চায়, তখন লজ্জা পায় না, গ্লানি বোধ করে না। এতে আমাদের অবাক হওয়ার কিংবা নতুন করে ক্রুদ্ধ হওয়ার কিছু নেই। আসলে একাত্তরের গণহত্যাসহ অন্যান্য গুরুতর অপরাধ বারবার অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে তারা নির্লজ্জভাবে নিজেদেরই ধোঁকা দিয়ে চলেছে। তাদের এই প্রতারণার সবচেয়ে বড় শিকার পাকিস্তানের জনসাধারণ, যাদের কোনো দিন জানতে দেওয়া হয়নি, একাত্তরে তাদের সেনাবাহিনী বাংলাদেশে কী নৃশংস বর্বরতা চালিয়েছে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
[email protected]