পাকিস্তান যে কারণে বাবা জানকে মুক্তি দিল

বাবা জান


পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান হুনজার প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি দিয়ে প্রায়ই টুইট করেন। হুনজা যে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা, তা–ও বলেন।  হুনজার সৌন্দর্য অতুলনীয়। হুনজা ভ্যালি যেকোনো প্রকৃতিপ্রেমীর কাছে লোভনীয়। কেবল পাকিস্তান নয়—হুনজা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে চোখজোড়ানো এলাকাগুলোর একটি।
পাকিস্তানের সর্বউত্তরে হুনজার একদিকে চীনের জিনজিয়াং, অন্যদিকে আফগানিস্তান। ব্রিটিশ শাসনামলে প্রিন্সলি স্টেট ছিল এটা। ব্রিটিশরা হুনজা দখল করার সময় শেষ রাজা (‘মীর’) সাফদার খান চীনে চলে যান। সেই সূত্রে এই পাহাড়ি জনপদের ওপর চীনেরও দাবি ছিল বহুকাল। কথিত আছে হুনজার শাসকেরা আলেক্সান্ডারের সৈনিক দলের বংশধর।
ভারত ভাগের সময় তিন মাস হুনজা সিদ্ধান্তহীনতায় ছিল কোন দিকে যাবে। সর্বশেষ ১৯৪৭-এর নভেম্বরে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়। পরে পাকিস্তান এটা জুড়ে দেয় গিলগিট-বালতিস্তানের সঙ্গে। গিলগিট বালতিস্তান আবার একদা ছিল জম্মু-কাশ্মীরের অংশ। উপনিবেশ-উত্তর দক্ষিণ এশিয়ার নানান প্রান্তিক অঞ্চল যেভাবে ২-৩টি ‘রাষ্ট্র’-এর কাছে হাতবদল হচ্ছে, হুনজার ইতিহাস তেমনই।

ইমরানের মতো হুনজার সৌন্দর্য পাকিস্তানের কাছেও গর্ব। এই গর্বের আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে হুনজার দুঃখগাথাও। সেই দুঃখেরই রাজনৈতিক প্রতীক বাবা জান। স্থানীয় এই পরিবেশ সংগ্রামী প্রায় ১০ বছর কারাগারে থেকে দুসপ্তাহ হলো মুক্তি পেলেন। বাবা জানের কারাবাস ও মুক্তি দক্ষিণ এশিয়ার প্রান্তিক অঞ্চলগুলোর পরিবেশ-সংগ্রামের এমন এক অধ্যায়, যা বাড়তি মনোযোগ চাইছে সবার।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আড়ালে দক্ষিণ এশিয়ার প্রান্তিক অঞ্চলগুলোর অন্য রূপ বরফে আচ্ছাদিত সুউচ্চ পাহাড়ের সারি, অজস্র বর্ণের ফুল, বিশাল সব লেক, সুন্দরভাবে সুরক্ষিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আর অতিথিপরায়ণ জনসমাজ মিলে হুনজা পর্যটনের অনন্য জায়গা। বেড়াতে আসা মানুষকে সেবা দিতে যথেষ্ট অবকাঠামোও আছে। ইমরান খানের টুইট সেই বাণিজ্যেরই পরোক্ষ আহ্বান। হুনজা নিয়ে তাঁর একটা টুইট দেখছি ১২ হাজার শেয়ার হয়েছে। হাজার হাজার লাইক তাতে। এরা অনেকে হুনজা যেতে চাইবে বা যায়। দক্ষিণ এশিয়ার সুন্দর প্রান্তিক অঞ্চলগুলো এখন এভাবেই ‘জাতীয়’ পর্যটন ব্যবসা প্রসারের ভরকেন্দ্র। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়।
হুনজার মানুষের পর্যটনে আপত্তি নেই। কিন্তু বাণিজ্য ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এসব জনপদ পরিবেশ বিপর্যয়ের যে বিপদে আছে­—তার প্রতিকার কী? জলবায়ুর মতিগতি পাল্টে পাহাড়ি প্রকৃতি আমূল বদলে যাচ্ছে। এ রকম প্রকৃতির চাই এখন বাড়তি সুরক্ষা। পর্যটকদের সেসবে আগ্রহ থাকার কথা নয়। বিনিয়োগকারীদেরও নয়। কিন্তু স্থানীয়দের এখানেই থাকতে হবে। তাদের এই প্রকৃতি রক্ষার বিকল্প নেই। বাবা জানরা ঠিক এ কথাগুলোই বলছিলেন। কিন্তু জীবন থেকে হারাল তাঁদের এক দশক। সম্প্রতি পাকিস্তানে সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের রাজবন্দী তাঁরা।

পরিবেশ-সংগ্রামীরা যখন ‘সন্ত্রাসী’
গত ২৮ নভেম্বর বাবা জান ও তাঁর সহকর্মীদের কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। সমর্থকেরা তাঁকে ভালোবেসে বলে গিলগিট-বালতিস্তানের চে গুয়েভারা। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার প্রচারমাধ্যমে বাবা জানের বন্দিত্ব ও মুক্তি সামান্যই মনোযোগ পেয়েছে। এ রকম ঘটনা কেবল হুনজাবাসীর কপালের লিখন নয়—উপমহাদেশের অনেক অঞ্চলের ক্ষেত্রে সত্য তা।
২০১১ থেকে বাবা জান কারাগারে। আগের বছর জানুয়ারিতে হুনজার আত্তাবাদে বড় এক ভূমিধস ঘটে। গত কয়েক দশকে হুনজা প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হয়ে উঠেছে। ভূমিকম্প, বরফধস, পানি জমে বরফ হয়ে থাকা এসবই নিয়মিত সমস্যা। এখানকার আত্তাবাদ লেকটি পর্যটকদের বড় এক আকর্ষণ এখন। অথচ এই লেকটি তৈরি হয় ভূমিধসে পুরো গ্রাম তলিয়ে গিয়ে। কয়েক ডজন মানুষ মারা যায় সেই দুর্যোগে। হুনজা নদীর গতিপথ রুদ্ধ হয় তাতে। ভাটি পুরোই শুকিয়ে যায়। কয়েকটি পাহাড়ি গ্রামের হাজার হাজার মানুষ পরিবেশ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয় এ ঘটনায়। ঘটনার পর সরকারের সহায়তা কর্মসূচি ছিল। তবে পর্যাপ্ত নয়। তারা হুনজার পরিবেশ সৌন্দর্যের বিপণনে যতটা সক্রিয়—ওখানকার পরিবেশে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে ততটা সতর্ক ছিল না।

নোয়াম চমস্কি থেকে তারিক আলী পর্যন্ত আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত অনেক পণ্ডিত ও মানবাধিকার সংগ্রামী দীর্ঘদিন হুনজার পরিবেশ-সংগ্রামীদের মুক্তির দাবিতে নানাভাবে পাকিস্তানের কাছে ধরনা দিয়েছেন। হুনজাজুড়েও আন্দোলন চলেছে। তারই ফল ২৮ নভেম্বর বাবা জানদের মুক্তি।

বাবা জানদের প্রতিবাদ এখান থেকেই শুরু। পরিবেশ উদ্বাস্তুদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও তাদের পুনর্বাসন চাইছিল তারা। হুনজার বাণিজ্যিকীকরণেও তাদের আপত্তি। এই প্রতিবাদ আন্দোলনে ২০১১-এর আগস্টে গুলি হয়। তাতে দুই ব্যক্তি মারা যান। এরই ফল হিসেবে হুনজার মানুষ পরে কিছু সরকারি স্থাপনায় আগুন দেয়। তাতে মামলা হয়। কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন বাবা জানসহ বহু প্রতিবাদী। সন্ত্রাস আদালতের বিচারে ২০১৪ সালে ১১ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। অর্থাৎ দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের স্বার্থে যে আন্দোলন, তার সংগঠকদের সরকার চিহ্নিত করে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে। বন্দিত্বের কালে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতিতও হন তাঁরা। আটককৃত এই প্রতিবাদীরা প্রগতিবাদী স্থানীয় আওয়ামী ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় পাকিস্তানের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এই রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে তেমন উচ্চবাচ্য করেনি।
হুনজাবাসীর সঙ্গে ইসলামাবাদের রাজনৈতিক দূরত্ব বাড়ে এভাবেই। ইমরানের টুইট সেই দূরত্বের খবর দেয় না। তবে নোয়াম চমস্কি থেকে তারিক আলী পর্যন্ত আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত অনেক পণ্ডিত ও মানবাধিকার সংগ্রামী দীর্ঘদিন হুনজার পরিবেশ-সংগ্রামীদের মুক্তির দাবিতে নানাভাবে পাকিস্তানের কাছে ধরনা দিয়েছেন। হুনজাজুড়েও আন্দোলন চলেছে। তারই ফল ২৮ নভেম্বর বাবা জানদের মুক্তি।
পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার সংগ্রাম কীভাবে শেষ বিচারে রাজনৈতিক হয়ে ওঠে, হুনজার এই কাহিনি তার বড় নজির। গুজরাটের নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন কিংবা বাংলাদেশের সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনের অভিজ্ঞতাও হয়তো ওরকম ছিল।

ভুলের পুনরাবৃত্তি চায় না পাকিস্তান
বহুদূরের প্রান্তিক অঞ্চল হলেও হুনজার অদ্ভুত কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। ধর্মে ইসমাইলী শিয়া এখানকার মানুষের সাক্ষরতার হার ৯৭ ভাগ। অর্থনৈতিক উদ্যোক্তাদের মাঝে নারী অনেক। প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার মিছিল-মিটিংয়েও নারীদের থাকে বিপুল অংশগ্রহণ। ভ্যালিজুড়ে তাঁদের ভয়হীন ভঙ্গিতে চলাফেরা।
এসবই সুন্দর প্রকৃতির মাঝে এক অগ্রসর সমাজের স্মারক। এ কারণেই বাবা জানদের আটক হুনজার স্বাতন্ত্র্য চেতনাকে বাড়তি শক্তি জুগিয়েছে কেবল। সেই শক্তি ইসলামাবাদের নীতিনির্ধারকদের শেষ পর্যন্ত বাধ্য করেছে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিতে। তার আগে হুনজাজুড়ে বন্দী মুক্তির দাবিতে ১৪ দিনের অভূতপূর্ব এক অবস্থান ধর্মঘটও পালিত হয় এ বছর। পাকিস্তান সরকার বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ক্ষোভ আর বাড়তে দিতে চায়নি। বাংলাদেশ কিংবা বেলুচিস্তানের মতো ভুল হয়তো আজকের নীতিনির্ধারকেরা আর করতে চাইছেন না।
তবে হুনজা এবং সেই সঙ্গে গিলগিটের বঞ্চনার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। পাকিস্তান এই অঞ্চলের সৌন্দর্যের কথা বলতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়। অথচ দেশটির নীতিনির্ধারণে এই এলাকার প্রতিনিধিত্ব ছিল না দীর্ঘকাল। হুনজাবাসীর উন্নয়ন-বঞ্চনা কিছুটা সামাল দিয়েছে আগা খান ফাউন্ডেশনের সমাজসেবামূলক নানা কাজ। এটা পাকিস্তানের কোনো প্রদেশ নাকি স্বশাসিত এলাকা, সেটাও পুরোপুরি ফয়সালা ছিল না গত সাত দশক। ১১ বছর ধরে এখানে স্থানীয় একটা প্রাদেশিক সভা থাকলেও তার প্রশাসনিক ক্ষমতা ছিল অতি সীমিত। কেবল গত নভেম্বরে ইমরান সরকার বলছে, তারা গিলগিট-বালতিস্তানকে প্রদেশের মর্যাদা দিতে চলেছে। সেটা হতে পারে আবার কাশ্মীরের সংগ্রামীদের জন্য এক বড় আঘাত।

পাকিস্তান যদি কাশ্মীরের এই অংশকে নিজের প্রদেশ ঘোষণা করে, তাহলে ভারতও তার নিয়ন্ত্রণে থাকা বাকি অংশকে নিজস্ব ভূমি হিসেবে দেখানোর বাড়তি ন্যায্যতা পায়। ভারত-পাকিস্তান যদি এভাবে পরস্পর নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর নিজেদের করে নিতে পারে, তাহলে কাশ্মীরিদের গণভোট বা স্বাধিকারের আন্দোলনের প্রতি পাকিস্তানের কথিত সংহতিরও কোনো নৈতিক শক্তি থাকে না। ফলে আপাতত প্রদেশ ঘোষণা হলেও গিলগিট-বালতিস্তানের স্বাতন্ত্র্য ও তার ঐতিহাসিক মর্যাদার ব্যাপারটি অনেকখানি ফয়সালাহীনই থাকছে। যেকোনো সময় যেকোনো উপলক্ষে স্থানীয় সেই জাতীয়তাবাদ চাঙা হতে পারে।

বাবা জানদের মুক্ত করার সংগ্রামে হুনজাবাসী তারই ইঙ্গিত দিয়েছিল। প্রকৃতি, পরিবেশ এবং দুর্যোগেÿক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন প্রশ্নে আন্দোলন চললেও তার ভেতর অঙ্কুরিত হচ্ছিল স্থানীয় স্বাতন্ত্র্য চেতনার রাজনীতি। এ যেন পাকিস্তানের শাসকদের দ্বারা ১৯৬২ সালে রাঙামাটির কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির পরিণতিই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল।

আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক