পাহাড়ে কি সমতলে প্রতারিত প্রতিদিন

ম্রো সম্প্রদায়ের লোকজন এখন নিজেদের ভূমি রক্ষার জন্য মাঠে নেমেছে

সমতলে ও পাহাড়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী প্রতিদিন পদে পদে যে প্রতারণার শিকার হচ্ছে, তা এখন আর কোনো খবর নয়। এটাই যেন তাদের নিয়তি। পাহাড়ের সবচেয়ে কম কথা বলা, মাথা নিচু করে চলা লাজুক জনগোষ্ঠী ম্রো। পাহাড়ের সবচেয়ে নিভৃত অংশে তাঁদের বসবাস। কম কাপড় পরা, চুল না কামানো এই জনগোষ্ঠী তথাকথিত সভ্যতার আলো থেকে নিজেদের যতটা পেরেছে দূরে রেখেছে।

ধর্মান্তরের ঢেউ তাদের তেমনভাবে গ্রাস করতে পারেনি। ফলে তাদের কোনো মুরব্বি পক্ষ গড়ে ওঠেনি। ২০১৬ সালে পাহাড়ে খাদ্যাভাব দেখা দিলে বান্দরবানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দেখেছি গ্রামের পর গ্রাম, সেখানকার মানুষের কোনো নিবন্ধন হয়নি। জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। থানচি সদরে আসতে তাঁদের যে টাকা লাগে, সে টাকা দিয়ে তাঁদের এক মাসের খোরাকি হয়। তাই পরিচয়পত্র নিয়ে তাঁদের কোনো আগ্রহ নেই।

পাহাড়ের আন্দোলন-বিদ্রোহ, সশস্ত্র সংগ্রাম কোনো কিছুই তাঁদের তেমন টানেনি। তাঁদের এই নির্লিপ্ততা বা হুকুমতের পক্ষে থাকাকে একসময় প্রধান পাহাড়ি মানুষেরা ‘রাজাকারি’ বলে অভিহিত করতেন বলে জানা যায়। পাহাড়ের প্রধান দুই জনগোষ্ঠীর বাইরে থাকা অবহেলিত অবশিষ্ট পাহাড়ি শিশুদের জন্য বান্দরবানের সোয়ালক আবাসিক বিদ্যালয়ের বাঙালি শিক্ষকদের অবহেলা-অযত্ন নিয়েও তাঁদের কেউ কোনো দিন টুঁ শব্দটি করেননি। মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে দু-তিনটা পাহাড় ডিঙিয়ে ছেলেমেয়েদের দেখতে আসা পিতা-মাতা, দাদু-দিদাদের ফিরিয়ে দিতে দেখেছি। তাঁরা দেরি করে ফেলেছেন, তাই দেখা হবে না। সঙ্গে আনা পিঠা, বাঁশকরুয়ের সালুন নিয়ে তাঁদের চোখ মুছতে মুছতে ফিরে যেতে দেখেছি। বিনা প্রতিবাদে সবকিছু মেনে চলাই যেন ছিল ম্রোদের ব্রত।

সেই ম্রোরা প্রকাশ্যে নিজেদের ভূমি রক্ষার জন্য মাঠে নেমেছে। মানববন্ধন করছে। এটি ভাবতে যেমন ভালো লাগে, আবার ভয়ও করে। ভয় লাগে এই ভেবে যে দেয়ালে পিঠ কতটা ঠেকে গেলে এ রকম একটা নীরবে চলা সবকিছু মেনে নেওয়া জাতিগোষ্ঠী ঘুরে দাঁড়ায়।

নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে ম্রোদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের সূত্রে দেখেছিলাম নাইতং পাহাড়সহ চিম্বুক ভ্যালি ম্রো জনগোষ্ঠীর প্রথাগত জুম ভূমি এবং মৌজা ভূমি। এসব ভূমি ওই এলাকার ম্রো জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার একমাত্র অবলম্বন।

এখন বান্দরবান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা বলছেন, লিজকৃত নাইতং পাহাড়ে বর্তমানে ম্রোদের জনবসতি নেই এবং আগেও ছিল না।...প্রত্যক্ষভাবে ম্রোদের চারটি গ্রাম ও ৭০ থেকে ১১৬টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা পুরোপুরি সঠিক নয়। তাঁর দাবি, স্থানীয় ম্রো নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পরিষদের নামে বন্দোবস্ত নেওয়া হয়। তাঁর কথা অনুযায়ী, বিতর্কিত জমিটি (নাইতং পাহাড়) লামা উপজেলার ৩০২ নম্বর লুলেইন মৌজায় অন্তর্ভুক্ত। ওই জমিতে পরিষদের তত্ত্বাবধানে কৃষিপ্রযুক্তি ও উন্নত চাষাবাদপদ্ধতি প্রদর্শনীর মাধ্যমে সেখানকার স্থানীয় জনগণের কৃষিভিত্তিক জীবিকা নির্বাহের পথ সুগম করার লক্ষ্যে স্থানীয় ম্রো নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পরিষদের নামে বন্দোবস্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়। যদি তা-ই হয়, তবে পাঁচ তারা হোটেল কি সেই উদ্দেশ্য পূরণ করবে?

সম্প্রতি বান্দরবানের দুর্গম এলাকায় যে কথিত পাঁচতারা রিসোর্ট নির্মাণের পাঁয়তারা চলছে, তাতে উদ্বেগ জানিয়ে বাংলাদেশের সরকারকে চিঠি পাঠিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। তারা তাদের চিঠিতে ম্রো জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগত স্বার্থ সুরক্ষার আহ্বান জানিয়েছে।

তবে ম্রোরা বলছে অন্য কথা। তারা বলেছে, জেলা পরিষদ ম্রোদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। পরিষদ চেয়ারম্যানের বক্তব্য সম্পূর্ণভাবে বাস্তববিবর্জিত ও সত্যের অপলাপ।

চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লার কথার সঙ্গে কথিত রিসোর্ট নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষের কথা হুবহু মিলে যায়। তাঁদের দাবি, বান্দরবান জেলা পরিষদের কাছ থেকে ইজারা নেওয়া ২০ একর জমির কাছাকাছি কোনো জনবসতি নেই, ফলে সেখানকার অধিবাসীদের উচ্ছেদের কোনো আশঙ্কা নেই। চাষের জমি কেড়ে নেওয়াটাকে উচ্ছেদ বলছেন না তাঁরা।

স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম সরকার ১৯৭২ সালে আইএলও ইনডিজেনাস ও ট্রাইবাল পপুলেশন কনভেনশন ১০৭, র‌্যাটিফাই করেছে। এই কনভেনশনের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এসব জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ঐতিহ্যগতভাবে অধিকৃত ভূমির ওপর যৌথ কিংবা ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার স্বীকার করতে হবে।

বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে বলা হয়েছে জাতিসংঘের আদিবাসীবিষয়ক (ইনডিজেনাস পিপলস) ঘোষণাপত্রে। এই ঘোষণাপত্রের ১০ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে, আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে তাদের ভূমি থেকে জবরদস্তিমূলকভাবে উৎখাত করা যাবে না। অনুচ্ছেদ ২৫ বলছে, আদিবাসীদের ঐতিহ্যগতভাবে মালিকানাধীন কিংবা অন্যথায় দখলীয় ও ব্যবহার্য ভূমি, ভূখণ্ড, জল, সমুদ্র উপকূল ও অন্যান্য সম্পদের সঙ্গে তাদের স্বতন্ত্র আধ্যাত্মিক সম্পর্ক বজায় রাখা ও সুদৃঢ়করণের অধিকার এবং এ ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট তাদের এসবের দায়িত্বগুলো সমুন্নত রাখার অধিকার রয়েছে। ঘোষণাপত্রের ২৬ ধারা বলছে, যেসব ভূমি, অঞ্চল ও প্রাকৃতিক সম্পদ তারা বংশপরম্পরায় ঐতিহ্যগতভাবে ভোগদখল করে আসছে বা কোনো রকমে ব্যবহার করে আসছে, তার ওপর তাদের অধিকার রয়েছে।

সম্প্রতি বান্দরবানের দুর্গম এলাকায় যে কথিত পাঁচতারা রিসোর্ট নির্মাণের পাঁয়তারা চলছে, তাতে উদ্বেগ জানিয়ে বাংলাদেশের সরকারকে চিঠি পাঠিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। তারা তাদের চিঠিতে ম্রো জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগত স্বার্থ সুরক্ষার আহ্বান জানিয়েছে।

এ দেশের পাহাড়ের ত্রিপুরা, মুরং, মারমা, চাকমা, ত্যংচঙ্ঘ্যা আর সমতলের বুনো, বাগদ, মুন্ডা, ভগবেনে, চন্ডাল, কৈবর্ত, হাজং, মান্দি, সাঁওতাল, ওরাও, মণিপুরি, খাসিয়াদের তাদের পছন্দের নামে ডাকা যাবে না। বলতে হবে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’। তাতে নাকি ব্যাকরণ রক্ষা হয়।

একের পর এক খাসিয়াদের পুঞ্জি হাতছাড়া হচ্ছে। চার বছর পেরিয়ে গেলেও গোবিন্দগঞ্জের নভেম্বর হত্যার কোনো বিচার দূরে থাক, সাঁওতাল হত্যার কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। হত্যার সঙ্গে সঙ্গে সেই দিন সাঁওতালদের ঘরবাড়িতে আগুন দিয়ে তাদের উচ্ছেদ করা হয়। তারা এখনো ঠিকানাহীন। এখন সাত দফা দাবি নিয়ে কর্তৃপক্ষের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

ভূমি উচ্ছেদের প্রতিবাদে খাসিয়ারা ২০১৫ সালে পাঁচ দফা দাবি পেশ করেছিল। দাবিগুলো ছিল খাসিয়াদের ওপর হামলা বন্ধ, ভূমি সমস্যার সমাধান, গাছ কাটার অনুমতি বাতিল, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার তদন্ত ও আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন। এর প্রতিটি দাবিই ন্যায্য দাবি। স্বাধীনতার ৫০ বছর আর কত লজ্জা নিয়ে আমরা চোখ ঢাকব?

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক