পাহাড়ে শান্তির শ্বেত কপোত উড়বে কবে

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতির মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল ঐতিহাসিক এই চুক্তি। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন সরকার গঠিত জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ও তৎকালীন জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা।

আমরা  মনে করি,  এই চুক্তি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য এক অনন্য অর্জন। এর মাধ্যমে পাহাড়ে দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সময় ধরে চলা যুদ্ধের অবসান হয়েছিল। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের সূচনাকালে সংবিধান প্রণয়নের প্রাক্কালে গণপরিষদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জাতীয় সংসদে জুম পাহাড়ের স্বশাসনের বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন। লারমার দাবি সেদিন রাষ্ট্র গ্রাহ্য করেনি। বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো জনগোষ্ঠীর স্বীকৃতি ছিল না সংবিধানে। এই প্রেক্ষাপটে গঠিত হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। তখনো পাহাড়ি জনগোষ্ঠী গণতান্ত্রিক উপায়ে দাবি আদায়ের চেষ্টা করেছিল।

২৩ বছর আগে যে আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে চুক্তি সই হয়েছিল, সেটি আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। তার ব্যত্যয় হলে আবার উল্টো পথে হাঁটবে বাংলাদেশ, যা শান্তিকামী পাহাড়ি-বাঙালি কারওরই কাম্য নয়।

পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি আরও বদলে যায়। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান সমতল থেকে কয়েক লাখ মানুষকে পাহাড়ে নিয়ে যান পুনর্বাসনের জন্য। এ অবস্থায় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে জুম্ম জনগণ প্রতিরোধের পথ বেছে নেয়। এটি ছিল পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ওপর সামরিক শাসকের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ।

তবে পূর্বাপর শাসকগোষ্ঠী এ-ও উপলব্ধি করেন, শক্তি দিয়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষাকে স্তব্ধ করা যাবে না। এ কারণে জুম পাহাড়ের সবুজ ভূমিতে সামরিক অভিযানের পাশাপাশি সংলাপও চলতে থাকে। জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়ার সরকার জনসংহতি সমিতির নেতাদের সঙ্গে সমস্যা সমাধানে সংলাপ চালু রাখে। শেখ হাসিনার সরকারের আমলে এই সংলাপ যৌক্তিক পরিণতি লাভ করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সই হয়।

এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের সঙ্গে জুম্ম জনগণের আস্থার নতুন সম্পর্ক তৈরি হলো, যা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র বিরাজিত জাতিগত সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পথ খুঁজে নিল। অতীতের ভুল শুধরে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকারকে স্বীকৃতি দিল রাষ্ট্র।

এখানে মনে রাখা দরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার ধরন রাজনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবেই এর সমাধান হতে হবে। কিন্তু চুক্তির সময়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মনে যে আশা জেগেছিল, তা কি পূরণ হয়েছে? ২৩ বছর পরও চুক্তির মূল ধারাগুলো অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। চুক্তিতে বলা হয়েছিল, পার্বত্য চট্টগ্রাম হবে জুম্ম মানুষের বিশেষায়িত অঞ্চল হিসেবে জনমিতি সুনিশ্চিত থাকবে। সেই সঙ্গে নিরাপত্তার চশমায় পার্বত্য জনপদকে দেখার অবসান হবে।

বাস্তবে সেখানে নানা কৌশলে বাঙালিদের পুনর্বাসন ও দখলদারি চলছে। পাহাড়ে জুম্ম জনগণ সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। পাহাড়ের সবগুলো পৌরসভায় বাঙালি মেয়র। এমনকি ক্ষমতাসীন দলও সেখানে কোনো পাহাড়িকে মেয়র পড়ে মনোনয়ন দিতে সাহস পাচ্ছে না।

মোটাদাগে বলা যায়, চুক্তির মাধ্যমে জুম পাহাড়ের মানুষের সঙ্গে এই রাষ্ট্রের নয়া সেতুবন্ধ রচিত হয়েছিল, তা এখন অনেকটাই ধূসর। ভূমি সমস্যার সমাধান ভূমি কমিশন গঠিত হলেও কাজ শুরু করতে পারেনি। সরকার বর্ণিত উন্নয়নের মহাসড়কে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে। দখল হয়ে যাচ্ছে একের পর এক জুম্ম জনপদ, পাহাড়, বন। জুম পাহাড়ের এই আত্মঘাতী প্রবণতা আমাদের প্রিয় দেশের জন্য শুভ বার্তা বহন করে না।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি দেশের মানুষ তো বটেই, আন্তর্জাতিক মহলও ব্যাপকভাবে স্বাগত জানিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউনেসকো পুরস্কার পেয়েছেন। পার্বত্য চুক্তির লক্ষ্য ছিল পাহাড়ে শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জন এবং সেখানকার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন। এখন চুক্তি যদি বাস্তবায়িত না-ই হয়, তাহলে সেখানে শান্তির কপোত উড়বে কীভাবে?

২৩ বছর আগে যে আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে চুক্তি সই হয়েছিল, সেটি আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। তার ব্যত্যয় হলে আবার উল্টো পথে হাঁটবে বাংলাদেশ, যা শান্তিকামী পাহাড়ি-বাঙালি কারওরই কাম্য নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নই সেখানে টেকসই শান্তি ও সমৃদ্ধি আনতে পারে।

দীপায়ন খীসা পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক ছোট কাগজ মাওরুম–এর সম্পাদক