পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা হবে কীভাবে?

গেল কয়েক দিন ধরে পত্রপত্রিকায় বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহের অনেক খবরাখবর জানতে পারলাম। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেছে। এসব অনুষ্ঠানে পুঁজিবাজারের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এতে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা, সচেতনতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন, টেকসই অর্থায়নে পুঁজিবাজারকে কাজে লাগানোর কথা উঠে এসেছে। এসেছে নানা সুপারিশ।

বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের প্রত্যাশা। তবে এগুলোর বেশির ভাগ মোটেই নতুন নয়। অনেক দিন ধরেই আমাদের সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এমনকি বাজার বিশ্লেষকেরা জেনেবুঝে বিনিয়োগ করা এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার কথা বলে আসছেন।

দেশের পুঁজিবাজারের যাত্রা ছয় দশকের বেশি। কিন্তু অপরাপর দেশ কিংবা আমাদের অর্থনীতির অগ্রগতির সঙ্গেও তাল মিলিয়ে দেশের পুঁজিবাজার এগোতে পারেনি। আমাদের জিডিপির আকার কম-বেশি ৩৫০ বিলিয়ন ডলার। অথচ এখনো পুঁজিবাজারের মূলধন জিডিপির ২০ শতাংশেই সীমিত। এর পেছনে অবশ্য বেশ কিছু কারণ রয়েছে। আমাদের পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বেশি, ৮০ শতাংশের ওপরে। বিশেষজ্ঞরা একে বড় কাঠামোগত দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করছেন। বাজারে ভালো কোম্পানির সংখ্যাও কম। খারাপ কোম্পানির জাঙ্ক বা প্রায় অচল শেয়ারই বেশি। আছে সুশাসনের সংকটও। প্রায়ই এজিএম অনুষ্ঠান বা ডিভিডেন্ড প্রদানে বিলম্বের অভিযোগ আসে।

ইতিমধ্যে দুই দফায় শেয়ারবাজারে বড় ধরনের দরপতনে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাঁদের স্বার্থের সুরক্ষা দিতে পারেনি। ফলে শেয়ারবাজারকে ঘিরে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ছিল অনেক কম। বর্তমানে ধীরে ধীরে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ছে। অন্যদিকে দেশের বাজারে পণ্যবৈচিত্র্যের বেশ ঘাটতিও রয়েছে। মিউচুয়াল ফান্ড বাজারে এলেও ডেরিভেটিভসহ অন্য নতুন কোনো পণ্য নেই। এ ছাড়া অটোমেশন ও আধুনিকায়নে ঘাটতি আছে স্টক এক্সচেঞ্জ দুটির। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সাংহাই এবং শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ এলেও প্রয়োজনীয় সংস্কারের ফল এখনো দৃশ্যমান নয়। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ প্রথম দিকে কিছুটা এগিয়ে থাকলেও এখন অনেক পিছিয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে দেশে পুঁজিবাজারের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি এখনো দুর্বল বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিশ্বের প্রতিটি দেশের অর্থনীতিতে পুঁজিবাজার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বাজার পর্যালোচনা অনুসারে দেখা যাচ্ছে, জিডিপিতে পুঁজিবাজারের অবদান ভারতে ৬২ দশমিক ৭৫ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৮৯ দশমিক ২৯, হংকংয়ে ১ হাজার ৩১১ দশমিক ১৪ ও চীনে ৩৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। এটা রাতারাতি অর্জন সম্ভব হয়নি। এর জন্য অব্যাহত প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে। পুঁজিবাজারের কাঠামোগত সংস্কার করা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। দেশি-বিদেশি ভালো ভালো কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তথ্যগত স্বচ্ছতা ও প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়েছে। স্টক এক্সচেঞ্জগুলো অটোমেশন ও আধুনিকায়ন করা হয়েছে। অন্যায্য কারসাজি রোধে কঠোর আইন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সার্বক্ষণিক নজরদারি নিশ্চিত করা হয়েছে। একটি পরিপূরক সেকেন্ডারি মার্কেটও গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে দেশগুলোয় শেয়ারবাজার পরিণত হওয়ার পাশাপাশি হয়ে উঠেছে উন্নয়ন-অর্থায়নের বিকল্প উৎস। উল্লেখিত দেশগুলোর কর্মপ্রক্রিয়া ও অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য অনুসরণীয়।

আমাদের অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর ঘটছে। অর্থনীতিতে শিল্প খাতের অবদান ক্রমেই বাড়ছে। এখন এ খাতের অবদান বেড়ে ৩৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। কিন্তু এ খাতের উন্নয়নে খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারছে না পুঁজিবাজার। সব দেশে শিল্প মূলধনের বড় অংশের জোগান শেয়ারবাজার থেকে এলেও বাংলাদেশে এর উল্টো চিত্র দেখা যায়।

আমাদের অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর ঘটছে। অর্থনীতিতে শিল্প খাতের অবদান ক্রমেই বাড়ছে। এখন এ খাতের অবদান বেড়ে ৩৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। কিন্তু এ খাতের উন্নয়নে খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারছে না পুঁজিবাজার। সব দেশে শিল্প মূলধনের বড় অংশের জোগান শেয়ারবাজার থেকে এলেও বাংলাদেশে এর উল্টো চিত্র দেখা যায়। উদ্যোক্তারা এখানে নিজেরা ব্রোকারেজ হাউসের মালিক হলেও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জন্য ব্যাংকে ছোটেন। এ প্রবণতা বদলাতে পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করতে হবে। আমাদের পুঁজিবাজারকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে। বাড়াতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী।

পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা আনতে অডিটর বা নিরীক্ষকদের কাজে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বিএসইসির সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। বিশেষ করে দক্ষ জনবলের সন্নিবেশ ঘটানো, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, আইনের সংস্কার ও সাংগঠনিক কাঠামোগত রূপান্তরের মাধ্যমে উন্নয়নশীল বিশ্বের সফল পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার আদলে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। প্রাথমিক শেয়ারের মূল্য নির্ধারণে কার্যকর নিয়মাবলি অনুসরণে অডিট ফার্ম, ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির ভূমিকা নির্ধারণ এবং তা তদারকির জন্য যথাযথ ব্যবস্থা রাখতে নিয়মকানুনের সংস্কার প্রয়োজন। স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতাও বাড়িয়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে সেকেন্ডারি বাজারকেও শক্তিশালী করতে হবে। সংস্কারের পথে কোনো দুষ্টু বা অনভিজ্ঞ অথচ আপাত শক্তিশালী পক্ষ যাতে প্রভাব বিস্তার না করতে পারে, সেটাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

আমরা প্রায়ই শুনি, পুঁজিবাজার উন্নয়নে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণে কয়েকটি দেশে বিনিয়োগ সম্মেলন ও রোড শো আয়োজন করা হয়েছে (যদিও আমরা দেখেছি, গতানুগতিক রোড শো বিনিয়োগ আকর্ষণে ইতিমধ্যে তেমন একটা কাজে লাগেনি)। আইন ও নীতিকাঠামোয় কিছুটা সংস্কার আনা হয়েছে। এতে অবশ্য খুব কমই সুফল মিলেছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসছেন না, বরং আগের কিছু বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে চলে যাওয়ার খবর মিলছে। এদের ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দিতে হবে। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন খাতের ভালো ভালো কোম্পানিকে বাজারে কীভাবে তালিকাভুক্ত করা যায়, তার উপায় সন্ধান করতে হবে। অন্যদিকে শুধু বিনিয়োগকারীদের উদ্বুদ্ধ করলেই হবে না, বাজারে ভালো শেয়ারের জোগানও নিশ্চিত করতে হবে। অন্যান্য দেশে পুঁজিবাজারে মিউচুয়াল ফান্ডের অবদান ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। এখানে এর আকার ছোট।

মিউচুয়াল ফান্ড আরও কীভাবে বাড়ানো যায়, মিউচুয়াল ফান্ডের ব্যবস্থাপকেরা যাতে দায়িত্বহীন আচরণ না করতে পারেন, তার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি মিউচুয়াল ফান্ডে যাঁরা বিনিয়োগ করছেন, তাঁদের স্বার্থ ও মুনাফাও নিশ্চিত করতে হবে। সারা বিশ্বে নিরাপদ বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে মিউচুয়াল ফান্ডকে বিবেচনা করা হলেও বাংলাদেশে কিন্তু প্রায় ভিন্ন অবস্থা বিদ্যমান। অন্যদিকে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষায়ও সচেষ্ট হতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি স্থায়ী তহবিলের প্রস্তাব বিএসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এসেছে। এটা আমলে নেওয়া যায় কি না, তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। সর্বোপরি বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ দক্ষতা বাড়াতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

রচনার মতো শোনালেও নির্মম সত্য হচ্ছে, দেশের অর্থনীতির ভিত্তি টেকসই ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিতে দেশে একটি শক্তিশালী পুঁজিবাজার প্রয়োজন। অন্য অনেক দেশের মতো ব্যাংকের পাশাপাশি পুঁজিবাজারকে স্বল্প ব্যয়ে মূলধন সংগ্রহের বাজারে পরিণত করা না গেলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো কঠিন হবে। উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া, মানুষের আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি প্রভৃতি লক্ষ্য অর্জন করতে হলেও স্থিতিশীল পুঁজিবাজারের বিকল্প নেই।

মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক