পুঁজির বহির্গমন বন্ধ করতে হবে

উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার এ বছর অনেকটাই কমে যাবে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক সিচুয়েশন অ্যান্ড প্রসপেক্টাস ২০১৬ অনুসারে, ২০১৫ সালে এই উন্নয়নশীল দেশগুলোর গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০০৯ সালে সৃষ্ট আর্থিক সংকটের পর এটাই প্রবৃদ্ধির সর্বনিম্ন হার, যার আগে ২০০১ সালের সংকটের সময়ও প্রবৃদ্ধির হার এ পর্যায়ে নেমে এসেছিল। আর যে বিষয়টা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো, চীনের প্রবৃদ্ধির নিম্নগতি এবং রুশ ফেডারেশন ও ব্রাজিলে চলমান গভীর মন্দা কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির হার ব্যাপক হারে নেমে যাওয়ার আংশিক কারণ মাত্র।
এটা ঠিক যে চীনের (বিশ্বের নিম্নমানের ধাতুর চাহিদার অর্ধেকই হচ্ছে চীেন) প্রাকৃতিক সম্পদের চাহিদা কমার সঙ্গে এসব পণ্যের দাম অনেকটা পড়ে যাওয়ার সম্পর্ক আছে, যার কারণে আবার আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশই মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। চীনের প্রবৃদ্ধির এই শ্লথগতির কারণে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হবে, জাতিসংঘ এমন ২৯টি দেশের তালিকা করেছে। ওদিকে ২০১৪ সালের জুলাইয়ের পর তেলের দাম ৬০ শতাংশ পড়ে যাওয়ায় তেল রপ্তানিকারকেরাও বিপাকে পড়েছে।
তবে কপালে ভাঁজ পড়ার কারণটা কিন্তু শুধু পণ্যের পড়তি দাম নয়, বিপুল পরিমাণে পুঁজি পাচার হওয়াটাও তার অন্যতম কারণ। ২০০৯-১৪ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সর্বমোট ২ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার ঢুকেছে, যার আংশিক কারণ হচ্ছে, উন্নত দেশগুলোর অনুসৃত কোয়ান্টিটেটিভ ইজিংয়ের (বিশেষ ধরনের মুদ্রানীতি, যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারি সিকিউরিটিসহ অন্যান্য সিকিউরিটি কেনে) নীতি, এতে সেখানকার সুদের হার প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।
বেশি মুনাফার আশায় বিনিয়োগকারী ও ফাটকাবাজরা উন্নয়নশীল দেশের দিকে ঝুঁকছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, সেই দেশগুলোতে বিভিন্ন কোম্পানির লিভারেজ (বিনিয়োগ থেকে মুনাফা বাড়ানোর আর্থিক হাতিয়ার) ও ইকু্যইটি (শেয়ারের মূল্য) বেড়ে যাচ্ছে, আবার কোনো কোনো দেশে পণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে। আর্থিক মন্দার পর মুম্বাই, জোহানেসবার্গ, সাও পাওলো ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন (শেয়ারের সর্বমোট মূল্য) প্রায় তিন গুণ বেড়ে গেছে। অন্যান্য দেশের ইকু্যইটি বাজারেরও একই রকম নাটকীয় উত্থান দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু পুঁজির এই চলাচলের গতিপথ এবার পাল্টে যেতে শুরু করেছে, ২০০৬ সালের পর ২০১৫ সালেই প্রথম দেখা গেল, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পুঁজি গমনের হারের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক। উল্টো এ বছর উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে পুঁজি চলে যাওয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬০০ বিলিয়ন ডলার, যেটা আগের ছয় বছরে এই দেশগুলোতে যে পরিমাণ পুঁজি ঢুকেছে তার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি। সবচেয়ে বেশি টাকা গেছে ব্যাংকিং খাত হয়ে, যেখানে আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো এ বছর উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ৮০০ বিলিয়ন ডলার কম ঋণ দিয়েছে। এই পরিমাণে পুঁজি বের হওয়ার নানা প্রভাব রয়েছে: তারল্য কমে যাওয়া, ঋণ দেওয়া-নেওয়ার সেবার মূল্য বেড়ে যাওয়া, মুদ্রার মান কমে যাওয়া, রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাওয়া, যার ফলে ইকু্যইটি ও অন্যান্য সম্পদের দাম পড়ে যাওয়া। ফলে প্রকৃত অর্থনীতির ওপর পরোক্ষ প্রভাব পড়বে, যার মধ্যে রয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যে আগে বিপুল পরিমাণ বিদেশি পুঁজি যায়নি, তা নয়। কিন্তু এবার যে পরিমাণে তা আসছে সেটা বিস্ময়কর। এই পুঁজি বিনিয়োগ হচ্ছে মূলত স্বল্পমেয়াদি খাতে, যেখান থেকে দ্রুত মুনাফা তুলে নেওয়া যায়। ১৯৯৭ সালে এশীয় আর্থিক সংকটের সময় পূর্ব এশীয় দেশগুলো থেকে মোট ১২ বিলিয়ন ডলার বেরিয়ে গিয়েছিল।
১৯৯৭ সালের সংকটের পর পূর্ব এশীয় দেশগুলো যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ করেছে, তার ফলে সেখান থেকে এখন এ পরিমাণ পুঁজি বেরিয়ে গেলেও তার ধকল সহ্য করার মতো ক্ষমতা তার আছে, সেটা সত্য। বস্তুত, এশীয় আর্থিক সংকটের পর পৃথিবীতে রিজার্ভের পরিমাণ তিন গুণ বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চীন পুঁজির বহির্গমনের ফলে রেনমিনবির খাঁড়া পতন ঠেকাতে ২০১৫ সালে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ ব্যবহার করেছে, যদিও তার হাতে এখন ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি রিজার্ভ আছে।

>পুঁজির বহির্গমনের প্রভাব ঠেকাতে রিজার্ভ কিছুটা সহায়ক হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা যথেষ্ট নয়। তবে এই বহির্গমন ঠেকাতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সুদের হার বাড়ানো চলবে না, এই টোপ তার গেলা চলবে না

এই রিজার্ভের কারণেই উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে পুঁজির বহির্গমন সত্ত্বেও সেখানে পূর্ণাঙ্গ আর্থিক সংকট সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু সব দেশের হাতে এই অস্ত্র নেই। অনেক উদীয়মান দেশই এই বিপদ আঁচ করতে পেরে পুঁজির আগমন কমানোর চেষ্টা করছে। যেমন, দক্ষিণ কোরিয়া ২০১০ সালের পর সামষ্টিক অর্থনীতি-সংক্রান্ত বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে উল্লিখিত তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, এসব পদক্ষেপে তেমন কোনো কাজ হয়নি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কী করতে পারে?
বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের করপোরেট খাত ২০০৮ সালের সংকটের পর পুঁজির আগমনের সঙ্গে লিভারেজ বাড়িয়েছে, ফলে এই কারণে তারা খুব নাজুক অবস্থায় আছে। এখন পুঁজির বহির্গমনের কারণে তাদের ইকু্যইটির দাম কমে যাবে, একই সঙ্গে তাদের ঋণ-ইকু্যইটির অনুপাতও বেড়ে যাবে। এর ফলে তাদের খেলাপি হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যাবে। বিশেষ করে পণ্য রপ্তানিকারক দেশগুলোতে এই সমস্যা অত্যন্ত প্রকট হয়ে উঠেছে। কারণ, পণ্যের দাম বেশি থাকবে এই আশায় উৎপাদকেরা বিপুল পরিমাণে ঋণ করেছেন।
অনেক উন্নয়নশীল দেশই আগের সংকট থেকে শিক্ষা নেয়নি, সেটা নিলে বিদেশি মুদ্রা গ্রহণের ক্ষেত্রে তারা বিধিনিষেধ ও কর আরোপ করত। এবার সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যাতে এই টাকা নিয়ে তার দায় কাঁধে নিতে না হয়। দেউলিয়া আইনের প্রক্রিয়া দ্রুততর ও ঋণগ্রহীতা-বান্ধব করা হলে দ্রুত ঋণ পুনর্গঠন ও ঋণ নিয়ে আলোচনার কাঠামো তৈরি করা যেতে পারে।
উন্নয়নশীল দেশের সরকারকে উৎসাহ দিতে হবে, যাতে তারা এসব ঋণকে জিডিপির সঙ্গে যুক্ত ও অন্যান্য ইনডেক্সকৃত বন্ডে রূপান্তরিত করে। যেসব দেশের বিদেশি ঋণ ও রিজার্ভ দুটোই বেশি, তারা বন্ডের পড়তি দামের সুযোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজার থেকে নিজেদের সার্বভৌম ঋণ পুনরায় কেনার (বাই ব্যাক) কথা চিন্তা করতে পারে।
পুঁজির বহির্গমনের প্রভাব ঠেকাতে রিজার্ভ কিছুটা সহায়ক হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা যথেষ্ট নয়। তবে এই বহির্গমন ঠেকাতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সুদের হার বাড়ানো চলবে না, এই টোপ তার গেলা চলবে না। ইতিহাসে দেখা যায়, সুদের হার বাড়ানোর প্রভাব একেবারেই নগণ্য। বস্তুত, সুদের হার বাড়ানো হলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এতে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সুযোগও কমে যায়, ফলে এটা বুমেরাং হতে পারে। সামষ্টিক অর্থনীতি-সংক্রান্ত বিজ্ঞোচিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তা পুঁজির বহির্গমন ঠেকাতে পারে, কিন্তু এই পদক্ষেপও অপর্যাপ্ত প্রমাণিত হতে পারে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংকিং মাধ্যমে পুঁজির বহির্গমন ঠেকাতে কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক ব্যাংকের উন্নয়নশীল দেশের শাখা থেকে মূল শাখায় টাকা হস্তান্তরের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করার প্রয়োজন হতে পারে। ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ার সফল উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, উন্নয়নশীল দেশগুলো সাময়িকভাবে পুঁজি প্রত্যাহারের সুযোগ স্থগিত করে পুঁজির প্রবাহ ও বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে পারে। বিপর্যয়কর আর্থিক সংকট এড়ানোর এটাই সম্ভবত একমাত্র উপায়। ফলে তাদের দ্রুত কাজ করা উচিত।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জোসেফ ই স্টিগলিৎস: নোবেল বিজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ।
হামিদ রশিদ: জাতিসংঘের ডিপার্টমেন্ট অব ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্সের গ্লোবাল ইকোনমিক মনিটরিংয়ের প্রধান।