পুতিনের আজীবন গদিতে থাকার ইচ্ছা ক্ষোভ বাড়াচ্ছে

রয়টার্স ফাইল ছবি।
রয়টার্স ফাইল ছবি।

বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ও ক্ষমতাশালী দেশগুলোর যে নেতারা দেশবাসীর কাছে অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, তাঁদের অনেকের কাছেই করোনা মহামারি আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। এই মহামারি মোকাবিলা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তাঁদের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে ফেলেছেন।

ইতালির প্রধানমন্ত্রী গুসেপ্পে কোন্তি, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ, জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল—এমন অনেক নেতার জনপ্রিয়তা বছরখানেক আগে যেভাবে পড়ে গিয়েছিল, নতুন সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে তা আবার তাঁরা পুনরুদ্ধার করে ফেলেছেন।

তবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। দুই বছর ধরে তাঁর জনপ্রিয়তা ধারাবাহিকভাবে কমছিল। করোনা পরিস্থিতিতে সেই অবনমনের গতি আরও বেড়েছে। পুতিনের অতি অজনপ্রিয় পেনশনব্যবস্থার সংস্কার সাধারণ নাগরিকদের, এমনকি তাঁর সমর্থকদেরও খেপিয়ে তুলেছে। তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে আর্থিক সংকটে পড়েছে রাশিয়া।

পুতিন সংবিধানে একটি সংশোধনী আনতে চান, যার মাধ্যমে তিনি ২০৩৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। তত দিন পর্যন্ত তিনি বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স দাঁড়াবে ৮৪ বছরে। এত দিন পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার এই ইচ্ছাকে রুশ নাগরিকেরা মোটেও ভালোভাবে নেয়নি। করোনাকালে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ থাকায় ক্রেমলিন এই সময়টাকেই সংবিধান সংশোধনের মোক্ষম সময় মনে করছে। কিন্তু এতে মানুষের ক্ষোভ আরও বেড়ে যাবে। পুতিনের এই আজীবন ক্ষমতায় থাকার অভিলাষকে তাঁর কট্টর সমর্থকদেরও কেউ কেউ ঘৃণার চোখে দেখছেন।

লেভাদা নামের একটি নিরপেক্ষ গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের গত ফেব্রুয়ারির জরিপে দেখা গিয়েছিল, ৬৯ শতাংশ রুশ নাগরিক পুতিনকে সমর্থন করেন। কিন্তু সেই একই প্রতিষ্ঠানের মে মাসের জরিপে দেখা গেছে, পুতিনের জনপ্রিয়তা ৫৯ শতাংশে নেমে এসেছে। মাত্র পাঁচ বছর আগে পুতিন যখন ইউক্রেন সংকটে হস্তক্ষেপ করেন এবং ক্রিমিয়া দখল করে নেন, তখন তাঁর জনসমর্থন ছিল ৮৫ শতাংশ। কিন্তু বর্তমানের চেয়ে পুতিন এর আগে কখনো এত অজনপ্রিয় ছিলেন না।

তরুণদের কাছে এখন পুতিন সবচেয়ে বেশি অজনপ্রিয়। ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মাত্র ১০ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা পুতিনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চান। এ ছাড়া অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত, গরিব এবং ছোট শহর বা গ্রামে বাস করা লোকজনের মধ্যেও তিনি অজনপ্রিয় নেতা। 

নতুন পেনশন নীতি এবং জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি বেড়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে মানুষ বিক্ষোভ করতে রাস্তায় পারছে না। কিন্তু করোনা কেটে যাওয়ার পর লোকেরা যদি রাজপথে নেমে আসে, তাহলে তা সামাল দেওয়া পুতিনের জন্য কঠিন হয়ে পড়তে পারে।

মনে হচ্ছে পুতিনের সামনে দুটি বড় সমস্যা অপেক্ষা করছে। প্রথমত, করোনাভাইরাসের মহামারি কেটে যাওয়ার পরও রাতারাতি তেল ও গ্যাসের দাম আগের জায়গায় যাবে না। অর্থনীতি আগের জায়গায় আসবে না। এতে মানুষ বিক্ষুব্ধ হবে। আরেকটি হলো, পুতিনের ক্ষমতার মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে পার্লামেন্টে সংবিধান সংশোধন করা হবে কি না, সে বিষয়ে আগামী ১ জুলাই ‘পপুলার ভোট’ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এটি পুতিনবিরোধী বিক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালতে পারে।

নিরপেক্ষ আইনজ্ঞরা বলছেন, আইনি গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য রাশিয়ার সরকার এটিকে ‘পপুলার ভোট’ বলছে; অর্থাৎ তারা বোঝাতে চাইছে এটি গণভোট নয় এবং এতে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন থাকবে। কিন্তু গণভোট হতে হলে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ ভোট পড়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। গণভোট দিলে এত ভোটার ভোট দেবে কি না, তা নিয়ে সরকারের সংশয় রয়েছে। বিশেষ আইনে করা ‘পপুলার ভোট’ পদ্ধতিতে কত শতাংশ ভোট পড়তেই হবে, সে ধরনের কোনো বিধিনিষেধ রাখা হয়নি। এই ভোট পর্যবেক্ষণে খুবই সীমিত পর্যবেক্ষক রাখা হয়েছে।

লেভাদা একটি জরিপ চালিয়ে বলেছে, যদি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়, তাহলে এই সাংবিধানিক সংশোধনের প্রতি সর্বোচ্চ ৪৪ শতাংশ লোক ভোট দেবে। তবে বোঝা যাচ্ছে, এই ভোটে পুতিনই পাস করবেন এবং পাস করলেও পুতিনের আজীবন ক্ষমতায় থাকার খায়েশ অনিবার্যভাবেই রাশিয়ায় জনবিক্ষোভের সৃষ্টি করবে।

ক্রেমলিন এটা জানে এবং সে জন্যই সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। দেশটির সাংবিধানিক আদালত সম্প্রতি একটি রুল জারি করে বলেছে, কেউ কোনো বিষয়ে বিক্ষোভ করতে চাইলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তা করতে পারবে। বোঝাই যাচ্ছে, ভবিষ্যতে সরকারবিরোধীরা বিক্ষোভ করতে চাইলে তাদের প্রবল বাধার মুখে পড়তে হবে। তবে বাধা যত কঠিন হবে, বিরোধিতাও তত প্রবল হতে পারে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
রোমান দোবরাখোতভ: মস্কোভিত্তিক সাংবাদিক ও নাগরিক অধিকারকর্মী