পুতিনের গম-ভুট্টার খাদ্যাস্ত্র মোকাবিলার পথ কী

কৃষ্ণসাগরে অবরোধ যত দীর্ঘায়িত হবে, খাদ্যনিরাপত্তা ও রাজনৈতিক সংকট ততই বাড়বে
ছবি: রয়টার্স

কৃষ্ণসাগর দিয়ে খাদ্যশস্য রপ্তানির ওপর রাশিয়া অবৈধভাবে যে অবরোধ দিয়েছে, তা ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পশ্চিমা বিশ্ব আর কত দেরি করবে? এই বেপরোয়া অবরোধ পঞ্চম মাসে এসে পড়েছে। জাতিসংঘ সতর্ক করে দিয়েছে, ইউক্রেনের খাদ্যশস্যের ওপর নির্ভরশীল বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জন্য মহাবিপর্যয় আসন্ন। অথচ ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা এখনো কথা চালাচালি ও বিভক্তির মধ্যেই নিজেদের আটকে রেখেছেন।

রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের পদক্ষেপ (কী ধরনের অস্ত্র পাঠানো হবে, ন্যাটোর কতটা জোরালো ভূমিকা পালন করা উচিত) অবশ্যই বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখতে হবে। জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যবস্থা ৭৫ বছর ধরে যে মৌলিক মানবাধিকারের ওপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, সেটা রক্ষা করাটাই হবে এখনকার মূল করণীয়। মানবসৃষ্ট নিষ্ঠুরতার শিকার নির্দোষ মানুষকে রক্ষার প্রশ্ন এটি, শিষ্টাচার ও নেতৃত্বের প্রশ্নও।

ভ্লাদিমির পুতিন এখন কী করছেন? গম–ভুট্টার মতো প্রধান খাদ্যশস্যকে তিনি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন। কৃত্রিম ঘাটতি সৃষ্টি করে আফ্রিকা ও মধ্য আমেরিকার কোটি কোটি মানুষকে ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে একটা রাষ্ট্র তাদের পদ্ধতিগত নীতির প্রয়োগ করছে। এটা দুর্বৃত্তপনা। পুতিনকে থামাতেই হবে।

পুতিনকে থামানোর কাজটা রাশিয়ার জনগণ নিজেরা করলেই সেটা আদর্শ হতো। ভয়, সাহসহীনতা কিংবা উদাসীনতা—এসব কারণে রাশিয়ার জনগণের মধ্যে একটা নৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু জো বাইডেন, বরিস জনসন, এমানুয়েল মাখোঁ, ওলাফ শলৎজ কিংবা অন্য সব গণতান্ত্রিক নেতা কী জন্য অপেক্ষা করছেন? পুতিন ওদেসা বন্দরের পানিতে মাইন রেখেছেন, খাদ্যগুদামে বোমা ফেলছেন এবং খাদ্যশস্য চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন। কত শিশু মারা গেলে গণতান্ত্রিক বিশ্বের নেতারা কৃষ্ণসাগরকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেবেন?

পুতিনের খাদ্যযুদ্ধের কারণে বিশ্ব এখন নতুন এক মহাদুর্ভিক্ষের মুখে। ন্যাটো ও জি-৭ সম্মেলনে নেতাদের অবশ্যই পুতিনের অবরোধকে ডুবিয়ে দেওয়া যায়, সে রকম বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। তাঁরা যদি সত্যি সত্যি চান, সেটা তাঁরা পারবেন।

প্রচণ্ড মূল্যস্ফীতির কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর জাতীয় স্বার্থ এখন ব্যাপকভাবে বিপন্ন। তা সত্ত্বেও তারা পদক্ষেপ নিতে পারছে না। রাশিয়ার অবরোধ শুরুর পর ক্ষুদ্র শক্তির লিথুয়ানিয়া খুব ওজনদার একটা প্রস্তাব দিয়েছে। সেটা হলো ওদেসা থেকে বসফরাস পর্যন্ত খাদ্যশস্যবাহী জাহাজ পাহারা দিয়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের অধীনে একটা নৌজোট গড়ে তোলা। এটি সম্পূর্ণ যৌক্তিক একটা প্রস্তাব।

এটা বাস্তবায়ন করা যায়নি। কারণ, বাইডেন ভয় পাচ্ছেন রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটোর সংঘাত বেধে যায় কি না। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ অথর্ব ভূমিকা পালন করছে এবং মাখোঁ ও শলৎজ এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন। ইউক্রেনের শস্য রপ্তানির বিকল্প পথ খোলা হয়েছে। ট্রেন ও লরিতে করে শস্য রপ্তানি হচ্ছে। ইউক্রেনের গুদামগুলোতে যে ২০ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য আটকে আছে, তার সামান্যই এভাবে রপ্তানি করা সম্ভব হয়েছে। এরই মধ্যে আবার নতুন করে শস্য পাকা শুরু হয়েছে। সেই শস্য রাখার কোনো জায়গা নেই।

কৃষ্ণসাগরে অবরোধ যত দীর্ঘায়িত হবে, ততই খাদ্যনিরাপত্তা ও রাজনৈতিক সংকট বাড়বে। আমদানিনির্ভর মিসর ও লেবাননে রুটির কারণে তীব্র জন-অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেন, যেখানে ১ কোটি ৯০ লাখ মানুষ এরই মধ্যে খাদ্যের অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে, সেখানে মানবিক বিপর্যয় হতে পারে। ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, কেনিয়া, সুদানের মতো দেশগুলোয় এ বছর খরা চলছে।

গত শুক্রবার ইউরোপীয় সম্মেলন ও বিশেষ খাদ্য সম্মেলনে রাশিয়ার এ খাদ্য অবরোধ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ সপ্তাহে ন্যাটো ও জি-৭ বৈঠকের একটি প্রধান আলোচ্য বিষয় এটি। এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা ও কথাবার্তা হচ্ছে, সেটা অবশ্যই ভালো। কিন্তু রাশিয়ার এ তাণ্ডব ঠেকাতে হলে বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। অপমানজনক কোনো সুবিধা না দিয়েই পশ্চিমাদের পক্ষে কি এখন রাশিয়ার এ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করা সম্ভব? ওয়াশিংটনের হাডসন ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক ব্রায়ান ক্লার্ক ও বিল স্নাইডার মনে করেন, সেটা সম্ভব নয়। বাইডেন ও তাঁর মিত্র নেতারা (বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের বরিস জনসন) যদি আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারেন, তাহলেই কেবল খাদ্যশস্য অবরোধের হঠকারী সিদ্ধান্ত থেকে পুতিনকে নিবৃত্ত করা সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি কিয়েভকে সর্বাধুনিক ‘গ্রে ইগল ড্রোন’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ ধরনের ড্রোন দিয়ে রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজের অবস্থান শনাক্ত ও প্রয়োজনে ডুবিয়ে দেওয়াও সম্ভব। এ ধরনের সর্বাধুনিক ড্রোন কিয়েভের হাতে থাকা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন

ক্লার্ক ও স্নাইডারের মতে, অত্যাধুনিক মনুষ্যবিহীন বিমান ও ড্রোনের উপস্থিতি কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজের অবরোধকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য যথেষ্ট। কিন্তু এ ধরনের গতিশীল সমাধানের জন্য রাজনৈতিক সাহস থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে হোয়াইট হাউস কিংবা অন্যান্য পশ্চিমা দেশের দূরদৃষ্টি ও সংকল্পের ঘাটতি রয়েছে। একেবারে শেষ মুহূর্তে গিয়ে ‘গ্রে ইগল ড্রোন’ কিয়েভের কাছে হস্তান্তর আটকে দেয় পেন্টাগন। এ ধরনের আচরণ বদলানো প্রয়োজন।

পুতিনের খাদ্যযুদ্ধের কারণে বিশ্ব এখন নতুন এক মহাদুর্ভিক্ষের মুখে। ন্যাটো ও জি-৭ সম্মেলনে নেতাদের অবশ্যই পুতিনের অবরোধকে ডুবিয়ে দেওয়া যায়, সে রকম বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। তাঁরা যদি সত্যি সত্যি চান, সেটা তাঁরা পারবেন।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ

  • সাইমন টিসডাল দ্য গার্ডিয়ান–এর কলামিস্ট ও পররাষ্ট্রবিষয়ক ভাষ্যকার