পুরুষ কেন ধর্ষণ করে

ফাইল ছবি।

চারপাশের নারীদের চোখে-মুখে ভয়, আতঙ্ক। তাঁদের শঙ্কা নিজের নিরাপত্তা নিয়ে, নিজেদের সন্তান-স্বজনদের নিরাপত্তা নিয়ে। এই সমাজে নারী নিরাপদ কোথায়, কখন? স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন নারী। নিজের বাড়িতে লাঞ্ছিত হয়েছেন নারী। চার বছরের শিশুকে ছাড়ে না ধর্ষকেরা! একের পর এক গণধর্ষণ!

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরব। রাস্তায় নেমেছেন প্রতিবাদকারীরা। প্রতিবাদের দরকার আছে। প্রতিবাদ থেকে সচেতনতা তৈরি হয়। জনমত সংগঠিত হয়। নীতিনির্ধারকেরা তৎপর হন। অন্তত একটা ক্ষেত্রে আমরা দেখছি, সচেতনতা তৈরির সুফল মিলেছে। দেশে কুড়ি বছর আগে অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার নারীর সংখ্যা ছিল ৫০০-এর মতো, ২০১৯ সালে অ্যাসিড–সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে ১৮টা (সূত্র: প্রথম আলো ট্রাস্ট)। অ্যাসিড–সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বড় সামাজিক আন্দোলনের ভূমিকা এই সাফল্যের পেছনে নিশ্চয়ই আছে।

ধর্ষণের বিরুদ্ধে সচেতনতা, প্রতিবাদ, আওয়াজ তাই জোরেশোরেই হোক। রাষ্ট্র ধর্ষণ রোধে করণীয় স্থির করুক, সক্রিয় হোক। অপরাধীদের বিচার হোক, বিচারের মধ্য দিয়ে দৃষ্টান্তমূলক সাজা হোক। তবে ধর্ষণের সমস্যা কেবল আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নয়। এটি বেশ জটিল। এর পেছনে আছে ক্ষমতা-সম্পর্ক। এর পেছনে আছে পিতৃতন্ত্র।

নিউইয়র্ক একাডেমি অব সায়েন্সেস জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারি ২০০০ সংখ্যায় প্রকাশিত রান্ডি থর্নহিল এবং ক্রেইগ টি পালমারের লেখা ‘মানুষ কেন ধর্ষণ করে’ প্রবন্ধের কিছু কথা আমার নিজের ভাষায় পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি।

‘আমাদের এক বন্ধু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তিনি তাঁর বন্ধুর সঙ্গে সিনেমা দেখে ফিরছিলেন। বন্ধুটি গাড়ির দরজা বন্ধ করে তাঁকে রেপ করেন। আমাদের বন্ধুটি এরপর থেকে মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে আছেন। তিনি বাইরে যেতে ভয় পান। ঘুমাতে পারেন না, খেতে পারেন না, নিজের কাজে মন বসাতে পারেন না। প্রকৃতপক্ষে রেপ ভিকটিমদের অনেকেই পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে ভোগেন। এর লক্ষণ হলো উদ্বেগ, স্মৃতিভ্রষ্টতা, এক বিষয় নিয়ে সারাক্ষণই ভাবা, আবেগীয় অসারতা। ১৯৯২ সালে ১৮ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সের নারীদের মধ্যে পরিচালিত জরিপ অনুসারে, শতকরা ১৩ ভাগ নারী অন্তত একবার ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। পুরুষ কেন ধর্ষণ করে? এটা একটা ভয়ংকর অপরাধ। এবং এটা হলো একটা সেই অসুস্থ সমাজের লক্ষণ, যে সমাজে পুরুষেরা নারীকে ভয় পায় এবং অসম্মান করে। ১৯৭৫ সালে নারীবাদী লেখক সুসান ব্রাউন মিলার বলেন, ধর্ষণের সঙ্গে যৌন লালসার সম্পর্ক নেই, যা আছে তা হলো নিয়ন্ত্রণ করা এবং দাবিয়ে রাখা, ডমিনেট করা। ব্রাউন মিলারের মতে, ধর্ষণের কারণ যৌন কামনা নয়, সব পুরুষেরই কামনা আছে, কিন্তু সব পুরুষ ধর্ষণ করে না। একেকজন ধর্ষণকারী একেক কারণে এই ঘৃণ্য অপরাধ করে।’

রেপ ক্রাইসিস (ইংল্যান্ড, ওয়েলস) তাদের প্রকাশনায় ধর্ষণবিষয়ক কতগুলো ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে বলেছে। যেমন একজন নারীর একা রাতের বেলা বাইরে যাওয়া উচিত নয়, তাহলে ধর্ষণ কমবে...আসলে ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। প্রতি ১০ জনের ৯ জন ধর্ষণের শিকার হন তাঁর পরিচিতদের দ্বারা।

বাংলাদেশেও দেখা গেছে, ৭৭ ভাগ নারী নির্যাতন ঘটে পরিবারের মধ্যে। (প্রথম আলো, ১ জানুয়ারি ২০১৮)। যেমন এটা প্রায়ই পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার মানুষেরা বলে থাকেন, মেয়েটি উত্তেজক পোশাক পরেছিল, তা-ই সে রেইপড হয়েছে। এটা একেবারেই একটা ভুল এবং অন্যায় কথা। আমরা দেখেছি, নিজেকে পুরো ঢেকে রাখেন, এমন অনেক নারী ধর্ষণের শিকার হন এই বাংলাদেশে।

আমেরিকার মতো দেশেও ধর্ষণ একটা বড় সমস্যা। বাংলাদেশে এ–সংক্রান্ত পরিসংখ্যানের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাবে, কারণ বহু ধর্ষণের ঘটনা আসলে থানা–পুলিশ পর্যন্ত আসে না। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে এপ্রিল থেকে আগস্ট—পাঁচ মাসে দেশে ৬৩২ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ বিশ্বের ধর্ষণের মানচিত্র প্রকাশ করেছে ইন্টারনেটে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ৪১, প্রতিবছর এই দেশে ধর্ষণের ঘটনা থানা পর্যন্ত যায় ১১ হাজার ৬৮২টি।

যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেও ভয় লাগে। আমেরিকায় প্রতি ছয়জন নারীর একজন ধর্ষণের শিকার হন বা ধর্ষণের আক্রমণের মুখে পড়েন। ৪৩ সেকেন্ডে একজন আমেরিকান যৌন সন্ত্রাসের শিকার হন। প্রতিদিন ৭০ জন আমেরিকান নারী যৌন সন্ত্রাসের শিকার হওয়ার কারণে আত্মহত্যা করেন। ধর্ষণ বা যৌন আক্রমণের শিকার হন প্রতিবছর ৬ লাখ ৫২ হাজার আমেরিকান। ছেলেরাও ধর্ষণের শিকার হয়। সেটা যেমন বাংলাদেশে, তেমনি সারা পৃথিবীতেই। শিশুরা সারা পৃথিবীতেই যৌন হয়রানি এবং ধর্ষণের শিকার। বাংলাদেশে বা বিদেশে শিশুরা যে যৌন হয়রানির শিকার হয়, তার বেশির ভাগই ঘটে ঘরের মধ্যে, পরিচিত বা আত্মীয়স্বজনের দ্বারা।

ইউএন উইমেন নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করতে সুপারিশ করে:

১. রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং নেতৃত্ব।

২. নারী-পুরুষের সমতা আনে এমন আইন ও নীতি প্রণয়ন করা এবং কার্যকর করা।

৩. নারীদের সংগঠনে বিনিয়োগ করা।

৪. নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করতে তহবিল বরাদ্দ করা।

৫. প্রতিদিন নারীরা যেসব বিচিত্র বৈষম্যের মুখোমুখি হন, তা সমাধানে সচেষ্ট হওয়া।

ধর্ষণ পুরুষেরা করে থাকে। কাজেই ধর্ষণ যদি বন্ধ করতে হয়, পুরুষদের বদলে যেতে হবে। নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যে যে পিতৃতন্ত্র বসবাস করে, সেটাকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে। কথাটা যত সহজে বলে ফেলা গেল, করে ফেলাটা তার চেয়ে লক্ষ গুণে কঠিন। পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাড়ির ছোট্ট ছেলেটাকে ছোটবেলা থেকেই নারীকে সম্মান করতে শেখাতে হবে। এখন বাড়ির বড় পুরুষটি যদি বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে, স্বামী যদি স্ত্রীর সঙ্গে বৈষম্যমূলক বা অসম্মানজনক বা সহিংস আচরণ করেন, শিশুটা কী শিখবে? ছেলেবেলা থেকেই আমরা দেখেছি, আমাদের সমাজ আমাদের শিখিয়েছে, ব্যাটা ছেলে হবে পুরুষালি, মেয়েরা হবে মেয়েলি। ছেলেরা কোনো ‘না’ শুনবে না, তাদের শোনার আছে একটা মাত্র উত্তর: হ্যাঁ। এই মনোভাব বদলাতে হবে। পুরুষ হবে মানবিক। ছেলেরা ধর্ষণ বন্ধ করতে পারে (ম্যান ক্যান স্টপ রেপ) নামের একটা আন্দোলনে ছেলেদের এই ধরনের ১০টা পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ১. নিজের পুরুষত্বকে সংজ্ঞায়িত করুন। পুরুষ মানে বেপরোয়া, সে ‘না’ শুনতে জানে না, এই মনোভাব পাল্টান। মানুষ হোন, ভালো পুরুষ হোন। ২. সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারীদের মত পরিষ্কারভাবে বুঝুন, তাদের ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’কে সম্মান দিন। ৩. আপনার কাছের নারীদের জিজ্ঞেস করুন, একটা রেপ ভিকটিমের কষ্ট কী, তাঁরা কী রকমভাবে ধর্ষণের আতঙ্কে আছেন। ৪. একজন পুরুষকেও জিজ্ঞেস করুন, আপনাকে যদি বলা হয় আপনি ধর্ষক, আপনি কী রকম বোধ করবেন। আপনার নিকটজন যদি রেপ ভিকটিম হন, আপনার কেমন লাগবে? ৫. টেলিভিশন, সিনেমা, ভিডিও গেমস ইত্যাদিতে যে পেশিবহুল পুরুষকে দেখানো হয়, তার দ্বারা প্রভাবিত হবেন না। ৬. নারীদের সম্পর্কে কথা বলার সময় সতর্কতার সঙ্গে শব্দ ব্যবহার করুন। কিছুতেই যেন তাঁদের খাটো করে দেখানো না হয়। ৭. কেউ যদি নারীকে হেয় করে কথা বলে, তার প্রতিবাদ করুন। ৮. ধর্ষণ নিয়ে কেউ কৌতুক করলে প্রতিবাদ করুন, বলুন, এটা রসিকতার বিষয় নয়। ৯. ধর্ষণের বিরুদ্ধে নারীর অবমাননার বিরুদ্ধে সংগঠন, আন্দোলন, গ্রুপে যোগ দিন। ১০. অঙ্গীকার করুন, অনিচ্ছুক কারও সঙ্গে সম্পর্ক নয়! সেটাই হলো শক্তিশালী পুরুষের লক্ষণ।

এই দেশে মানবাধিকার, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া সুদূরপরাহত, ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় দুর্বৃত্তরা বেপরোয়া, বিচারহীনতার উদাহরণ সর্বত্র, বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে ক্রন্দনরত, পিতৃতন্ত্র আকাশ–পাতাল ছেয়ে রেখেছে, বাক্‌স্বাধীনতা পিঞ্জরে বাঁধা পাখি।

এখানে নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করার সংগ্রাম কিংবা ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন ঘরে-বাইরে, স্কুলে-অফিসে, হাটে-বাজারে, রাস্তায়-রাজপথে, মনে-মুখে এবং নিজের জীবনে ব্যাপকভাবে করতে হবে। একটা পোস্টারও এখন ভীষণ মূল্যবান। ফেসবুকের একটা স্ট্যাটাস কিংবা প্রোফাইল পিকচারে পিতৃতন্ত্র টলবে না, কিন্তু তাই বলে পিতৃতন্ত্রকে আঘাত করা বন্ধ করা যাবে না। হোক প্রতিবাদ। ভীষণ। যেন এই পিতৃতন্ত্রের বটগাছটা হুড়মুড় করে যদি না–ও পড়ে, ধীরে ধীরে যেন ক্ষয়ে যায়, তারপর একদিন তা ঠিকই ভেঙে পড়বে, আকাশ থেকে তার অপচ্ছায়া সরে যাবে, সমতার আলো আসবে মাটির পৃথিবীতে।

আনিসুল হক : প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক