পূজা সরকার প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন

স্ত্রী পূজা সরকারের সঙ্গে চিকিৎসক তন্ময় মজুমদারের এই ছবি এখন কেবলই স্মৃতি

বিজ্ঞানী পূজা সরকার প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানের মাস্টার্সের ফল যেদিন বেরোল, তখন ছয় বছর বয়সে মাকে হারানো পূজা সরকারের আত্মীয়স্বজন কত খুশিই না হয়েছিলেন! পূজার মা ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন। মা মারা গেলেন। ছয় বছরের পূজা সেদিন অনেক কেঁদেছিলেন। মা আর আসবেন না? মা কি আর কোনো দিন আসবেন না?

‘ফিজিকসে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট’ পূজা পরমাণু শক্তি কমিশনে চাকরিতে যোগ দিলেন। সে–ও তো আরেক গৌরবের ঘটনা। তাঁর সাফল্যের মুকুটে আরেকটা পালক। দুই বছর আগে, কোভিডের আগে আগে, পূজার বিয়ে হয় চিকিৎসক তন্ময় মজুমদারের সঙ্গে। পূজার সঙ্গে তন্ময়ের ভালোবাসার সম্পর্ক বিয়ের আগে সাত বছর। বিয়ের পর নতুন সমস্যা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা স্বামী তন্ময় মজুমদার পোস্টিং পেয়েছেন পিরোজপুরে। আর পূজা থাকেন সাভারের পরমাণু শক্তি কমিশনের সরকারি কোয়ার্টারে। বহু চেষ্টা-তদবির করে শেষে মানিকগঞ্জের কর্নেল মালেক হাসপাতালে বদলি হতে পারলেন ডা. তন্ময় মজুমদার। পূজা সরকারের মেসো সুব্রত নন্দী, যিনি কানাডার টরন্টোতে থাকেন এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ‌্যালয় থেকে বেরোনো কৃষিবিজ্ঞানী, তাঁর ফেসবুক থেকে এসব তথ্য আমরা জানতে পারছি।

দুজনে একই বাসায়। এবার নিরবচ্ছিন্ন সুখ। পূজা সরকার আর তন্ময় মজুমদার দম্পতির চোখে আরেক স্বপ্ন। পূজা মা হতে যাচ্ছেন। ছয় মাসের শিশুটি পেটের মধ্যে নড়ে-চড়ে। পূজা সন্তানের নড়াচড়া টের পান। তন্ময়ের চোখ মায়ার জলে ভরে যায়। তাঁদের সন্তান আসছে।

৫ জুন ২০২২, রোববার। সাত দিন পর পূজা অফিসে যাচ্ছেন। ডাক্তার দেখাতে সাত দিনের ছুটি নিয়েছিলেন পূজা। এই সাত দিন তিনি ছিলেন ঢাকার ওয়ারীতে। ঢাকা থেকে সাভার—অফিসের সুন্দর বাসটা যায়। সাভারের রাস্তা ভালো। মাঝখানে সড়ক ডিভাইডার আছে, ফলে আসা-যাওয়ার লেন আলাদা। প্রত্যেকটা লেন একমুখী। দুইমুখী চলাচলের রাস্তায় দুর্ঘটনার শঙ্কা বেশি থাকে। বিপরীত দিক থেকে গাড়ি ছুটে আসে। ওভারটেক করার সময় বিপদ ঘটতেই পারে। কিন্তু সাভারের রাস্তায় সে সমস্যা নেই।

পরমাণু শক্তি কমিশনের বাসটা ভালো। আর চালক চালান সাবধানে। ড্রাইভার মামাকে বলা আছে, পূজা বলে রেখেছেন, ‘মামা, আমি কিন্তু প্রেগন্যান্ট, বাচ্চা হবে, আমাকে খুব সাবধানে চলাচল করতে হয়, আপনি কিন্তু সাবধানে চালাবেন।’ ড্রাইভার মামা হেসে বলেছেন, ‘মামা, আপনে একদম চিন্তা করবেন না। আমি মাখনের মতন চালাই। একটুও ঝাঁকি লাগবে না।’

কিন্তু আপনি গাড়ি সাবধানে চালালেই যে আপনার গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হবে না, তা তো নয়।

ঝিনাইদহ থেকে আসছিল একটা নাইটকোচ। গাড়ি চালাচ্ছিলেন মুন্না (২৬)। তিনি আবার ছিলেন পিকআপের ড্রাইভার। তাঁকে নাকি বাসটির মালিক ইকবাল ঘর থেকে ডেকে বাস চালানোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আগের দিন বাস নিয়ে ঝিনাইদহে যান মুন্না। সে রাতেই আবার রওনা দেন ঝিনাইদহ থেকে ঢাকার উদ্দেশে। দিবা বাস নৈশ বাস হয়ে ফেরে। সারা দিন বাস চালিয়ে ক্লান্ত ড্রাইভার মুন্না ঘুমিয়ে পড়ছিলেন ফেরার সময়। হেলপার তানভির (২৫) তাঁকে সাবধান করে দিচ্ছিলেন, ‘ওস্তাদ, আপনে তো ঘুমায়া পড়তাছেন। অ্যাকসিডেন্ট না কইরা ফেলান। থামেন। চোখে পানি দেন। চা-চু খান।’ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমনটাই পাই আমরা।

কোনো প্রাণই কারও চেয়ে কম মূল্যবান নয়। ফায়ারফাইটাররা সমাজের প্রান্তিক মানুষ বলে দেশ নড়ে ওঠেনি, জাতীয় পতাকা নমিত হয়নি। নইলে এতগুলো প্রাণের অবসানে আমরা কি সবাই মিলে একটু কাঁদতে বসতে পারতাম না! সাভার থেকে সীতাকুণ্ড। আমরা দুর্ঘটনার মধ্যে আছি। অপঘাতের মধ্যে আছি। সব বিপদ-আপদ-নৈরাজ্যের সমাধান তো মাত্র দুটো শব্দে বলে দেওয়া যায়—আইনের শাসন। তা যে নেই, সেই কথাটা নিজের বিবেকের কাছ থেকে তো লুকাতে পারি না।

সাভারের কাছে এসে বাসচালক পুরোই ঘুমিয়ে পড়লেন। বাসটা যাচ্ছে গাবতলীর দিকে। আর ঢাকা থেকে পরমাণু শক্তি কমিশনের দিকে, বিপরীত লেনে যাচ্ছে পূজা সরকারসহ বিজ্ঞানীদের বহনকারী স্টাফ বাসটি। মাঝখানে অন্তত ৪০ হাত ফারাক। ঝিনাইদহের বাসটি প্রথমে তার বাঁ দিকে চলতে লাগল। ভূতে পাওয়া তার আচরণ। প্রথম আলো ডট কমে প্রকাশিত সিসি ক্যামেরার ভিডিওচিত্র যদি আপনি দেখেন, সম্মানিত পাঠক, আপনি আঁতকে উঠবেন। ঝিনাইদহ থেকে ঢাকাগামী বাসটা প্রথমে রাস্তা ছেড়ে বাঁ দিকে যেতে লাগল। একটা ট্রাককে ধাক্কা দিয়ে আচমকা সে উল্টো দিকের লেনের দিকে রওনা দিল। মনে হচ্ছে তা যেন ইউটার্ন নিচ্ছে। সামনে উঁচু সড়ক বিভাজক। বাসটা সেটা অতিক্রম করল আরেকটা গাড়ির সামনে ধাক্কা মেরে। তারপর সড়ক বিভাজক পার হয়ে প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে ধাক্কা দিল পরমাণু শক্তি কমিশনের বাসটাকে।

তারপর?

প্রথম আলোর খবর: ‘ঢাকার অদূরে সাভারের বলিয়ারপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানী, প্রকৌশলীসহ চারজন নিহত হয়েছেন। আজ রোববার সকাল ৯টার দিকে বলিয়ারপুর বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। নিহত চারজন হলেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আরিফুজ্জামান, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পূজা সরকার, প্রকৌশলী কাউসার আহম্মেদ ও পরমাণু শক্তি কমিশন স্টাফ বাসের চালক রাজিব হোসেন।’

পরে ঝিনাইদহ থেকে আসা বাসটির চালক মারুফ হোসেন মুন্নাও মারা যান। কিন্তু কোনো কাগজে লেখা হলো না আরেকজন মারা গেছে। পূজার গর্ভের ছয় মাসের সন্তানটাও। জানি না, তন্ময় সরকারকে আমরা কীভাবে সান্ত্বনা দেব! জুন মাসের ১১ তারিখে মানে আগামীকাল পূজার জন্মদিন। তন্ময়ের আগামীকাল কী করে কাটবে!

এ লেখা যখন লিখছি, তখন আরও একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মারা গেলেন। ফারহানা ইসলাম। পূজার আরেক সহকর্মী। ছিলেন একই বাসে। গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখান থেকে আর ফিরে আসা হলো না ফারহানার। তাঁর আড়াই বছরের একটি সন্তান আছে।

আরও পড়ুন

জীবনের কী বিপুল অপচয়! ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বুয়েট থেকে পাস করা প্রকৌশলীরা এভাবে মারা গেলেন। এবং আমরা মাছের মা, আমরা শোকও করতে পারছি না। অধিক শোকে আমাদের পাথর হওয়ার অবস্থা। সীতাকুণ্ডে ডিপোতে আগুন লেগেছে। অগ্নিনির্বাপণকর্মীরা মারা গেছেন হঠাৎ বিস্ফোরণে। আগুন নেভানো যাচ্ছে না। সেই শোক-বিপদ-বিহ্বলতায় আমাদের নির্ঘুম রাত কাটছে। বিজ্ঞানী আরিফ, বিজ্ঞানী পূজা, বিজ্ঞানী ফারহানা, প্রকৌশলী কাউসারের জন্য যে কাঁদব, উপায় তো নেই।

কোনো প্রাণই কারও চেয়ে কম মূল্যবান নয়। ফায়ারফাইটাররা সমাজের প্রান্তিক মানুষ বলে দেশ নড়ে ওঠেনি, জাতীয় পতাকা নমিত হয়নি। নইলে এতগুলো প্রাণের অবসানে আমরা কি সবাই মিলে একটু কাঁদতে বসতে পারতাম না!

সাভার থেকে সীতাকুণ্ড। আমরা দুর্ঘটনার মধ্যে আছি। অপঘাতের মধ্যে আছি। সব বিপদ-আপদ-নৈরাজ্যের সমাধান তো মাত্র দুটো শব্দে বলে দেওয়া যায়—আইনের শাসন।

তা যে নেই, সেই কথাটা নিজের বিবেকের কাছ থেকে তো লুকাতে পারি না।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক