পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম উদ্বাস্তু

বিশ্বের মানুষ এখন আর রোহিঙ্গাদের নিয়ে মাথা ঘামায় না
বিশ্বের মানুষ এখন আর রোহিঙ্গাদের নিয়ে মাথা ঘামায় না

তারা নিজের দেশে অবাঞ্ছিত। তারা ডিঙিতে চেপে সাগর পাড়ি দিয়ে অন্য দেশে গিয়ে আশ্রয় ভিক্ষা করেছে। পুলিশি প্রহরা এড়িয়ে, ঘন অরণ্যপথ অতিক্রম করে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয়ের চেষ্টা করেছে। সেখানেও তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। হয় তাদের ঠেলে ফেরত পাঠানো হয়েছে, নয়তো ঢোকানো হয়েছে জেলখানায়। একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলাদেশ, একমাত্র সেখানেই তারা আশ্রয় পেয়েছে। কিন্তু সেখানেও তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। ১০ লাখ রোহিঙ্গা ইতিমধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, কিন্তু তাদের অনির্দিষ্টকাল রক্ষণাবেক্ষণ করার মতো সম্পদ দেশটির নেই।

মাইকেল কুগেলমানের কথায়, রোহিঙ্গারা হলো বিশ্বের বিষণ্নতম মানুষ। তাদের কথা এখন আমরা ভুলতে বসেছি। গত সপ্তাহে ওয়াশিংটনের উড্রো উইলসন সেন্টারে কুগেলমানের সভাপতিত্বে একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানেই তিনি এই মন্তব্য করেন। তিনি এই কেন্দ্রের উপপরিচালক, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে গোড়া থেকেই লিখে চলেছেন, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর ভূমিকার কঠোর সমালোচক তিনি। রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কী, এই বিষয়ে কথা বলার জন্য আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন ভারতের জিন্দাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাউথ ইস্ট এশিয়া স্টাডিজের পরিচালক নেহজিনপাও কিপজেন। তিনিও বললেন, খুব শিগগির যে এই সব উদ্বাস্তু নিজের দেশে ফিরে যাবে, তার সম্ভাবনা কম। আগামী ১০-২০ বছরেও হয়তো এই সমস্যার সমাধান হবে না।

রোহিঙ্গা সমস্যার দুটি দিক। একদিকে তাদের নিরাপত্তার প্রশ্ন, অন্যদিকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে তাদের স্বীকৃতি। মুখে যত কথাই বলুক মিয়ানমারের বর্তমান সরকার, বিশেষত তার নিরাপত্তা বাহিনী, তারা এই দুইয়ের একটিও পালন করবে না। আলোচনায় নেহজিনপাও কিপজেন তার কারণ ব্যাখ্যা করে বললেন, দেশের ভেতর অধিকাংশ মানুষ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনার বিপক্ষে। আন্তর্জাতিক চাপের ফলে ২ থেকে ১০ হাজার লোককে যদিবা ফিরিয়ে আনা হয়, অধিকাংশ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা কার্যত শূন্য। তারা যত দিন নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পাচ্ছে, তত দিন নিজেরাই ফিরে যাবে না। আমরা সবাই সে দেশের নেত্রী অং সান সু চিকে দোষ দিচ্ছি, কিন্তু তাঁর করার তেমন কিছু নেই। সামরিক বাহিনীর রক্তচক্ষু এড়িয়ে সামান্য কুটো সরানোর ক্ষমতাও তাঁর নেই। তার চেয়েও বড় কথা, অর্থপূর্ণ কিছু করার ইচ্ছাও তাঁর নেই।

কারণটা ভেঙে বললেন কিপজেন। সু চি একজন রাজনীতিক। তিনি চান ক্ষমতায় টিকে থাকতে, তাঁর নিজের রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসুক, এ মুহূর্তে এটাই তাঁর প্রধান অগ্রাধিকার। মিয়ানমারের অধিকাংশ মানুষের মতো তিনিও একজন বামার সম্প্রদায়ের সদস্য। তাঁর দলের অধিকাংশ সদস্য ও সমর্থক এই সম্প্রদায়ভুক্ত। নীতি বা আদর্শ নয়, সু চি যেকোনো মূল্যে নিজের দল ও সম্প্রদায়ের ক্ষমতা নিশ্চিত করতে চান। ফলে তিনি না পারবেন বামার সম্প্রদায়ের মতের বিপক্ষে যেতে, না পারবেন সেনাকর্তাদের নির্দেশ অমান্য করতে।

কিপজেনের ব্যাখ্যা অংশত ঠিক। পৃথিবীর কোনো দেশেই সংখ্যালঘুদের প্রতি উদারতার উদাহরণ নেই। যতটুকু অধিকার তারা পেয়েছে, তা অর্জন করতে হয়েছে ও হচ্ছে লড়াই করে। মিয়ানমারের সমস্যা বিশেষভাবে জটিল, কারণ সেখানে যে ১৩৫টির মতো জাতিগোষ্ঠী বা সম্প্রদায় রয়েছে, প্রধান সম্প্রদায় বামারের তুলনায় তারা সংখ্যায় নগণ্য। যেমন রোহিঙ্গাদের সংখ্যা লাখ বিশেক হবে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলো যৌথভাবে অধিকার আদায়ের লড়াই করবে, সে জন্য যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দরকার, তা নেই। সু চির বাবা জেনারেল অং সান, যাঁকে মিয়ানমারের জাতির জনক ভাবা হয়, তিনি বিবদমান সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেই অপরাধে তাঁকে জীবন দিতে হয়েছিল। এখনো ছোট-বড় ২৫টির মতো সম্প্রদায় মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৫ সালে সেনা নেতৃত্ব তাদের সঙ্গে সংলাপের একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু সেই সংলাপে কোনো অগ্রগতি নেই। মূল কারণ, ক্ষমতাসীন বামাররা কিছুতেই নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বিন্দুমাত্র শিথিল করতে রাজি নয়।

সু চি প্রথম দিকে জাতিগত বিভেদ ও সংঘর্ষ থামানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। একজন মুসলিমকে নিজের অন্যতম প্রধান পরামর্শদাতা হিসেবেও মনোনয়ন দিয়েছিলেন। কিন্তু দলের ভেতরে ও বাইরে এ জন্য তাঁকে সমালোচনার শিকার হতে হয়। কোনো কোনো বৌদ্ধ নেতা তাঁকে ‘মুসলিমদের বেশ্যা’ নামে ডাকতেও দ্বিধা করেননি। এই সমালোচনার ভয়েই সু চি গত নির্বাচনে একজন মুসলিমকেও নিজেদের দলের বিধায়ক পদে মনোনয়ন দেননি।

এটি বাস্তবতা। কিন্তু এ কথাও তো ঠিক যে সু চি এখনো মিয়ানমারের প্রধান রাজনৈতিক নেতা। তাঁর কথা অমান্য করে এমন রাজনৈতিক সাহস কারও নেই। সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারার ক্ষমতা একমাত্র তাঁরই রয়েছে। দেশের সম্প্রদায়গত বিভেদ, বিশেষত রোহিঙ্গাদের অধিকারের স্বীকৃতি দিতে হলে তাঁকে নিজের ‘রাজনৈতিক পুঁজি’ ব্যয় করতে হবে। কিন্তু সে কাজে তিনি নারাজ। ক্ষমতা ধরে রাখাতেই তাঁর আগ্রহ, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ক্ষমতা ব্যবহারে নয়। নেতা হিসেবে এখানেই তাঁর ব্যর্থতা।

বামার সম্প্রদায়ের রোহিঙ্গা–বিরোধিতা ও রোহিঙ্গাদের প্রতি কোনো ছাড় দিতে সেনাবাহিনীর আপত্তি—এই দুই অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতা চলতি সংকটকে জটিল করে ফেলেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য একমাত্র ভরসা আন্তর্জাতিক সমর্থন। কিন্তু সেখানেও দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী ক্রমে ঝিমিয়ে পড়ছে। ২ মিলিয়ন থেকে ১০ মিলিয়ন ডলার ত্রাণ দেওয়ার বাইরে কার্যকর কোনো হস্তক্ষেপের কোনো ইচ্ছাই তাদের নেই। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ আজ পর্যন্ত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ রোহিঙ্গা প্রশ্নে কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারেনি। আর পারেনি যে তার প্রধান কারণ চীন ও রাশিয়ার অনাগ্রহ।

চীন খোলামেলাভাবেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পাশে দাঁড়িয়ে। দীর্ঘকাল থেকেই তারা এই দেশ ও তার প্রকৃত শাসকদের সঙ্গে লাভজনক সম্পর্ক নির্মাণ করেছে। চীন মিয়ানমারের রাজনীতিতে নিজের জন্য সুবিধাজনক অবস্থা নিশ্চিত করতে দীর্ঘদিন থেকে দেশটির দুটি প্রধান বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। তাদের একটি কোকাং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স খোলামেলাভাবেই চীনা অস্ত্র ব্যবহার করে আসছে। এই গ্রুপের সদস্যরা প্রায় সবাই মান্দারিন বা চীনা ভাষায় কথা বলেন।

রাখাইন রাজ্যে, যেখানে রোহিঙ্গাদের বাস, তার ব্যাপারে চীনের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। চীন সেখানে তেল ও গ্যাস আহরণে ব্যস্ত। চীন মিয়ানমার থেকে সরাসরি তেল-গ্যাস আমদানি করার জন্য রাখাইন রাজ্যে পাইপলাইন নির্মাণ করেছে। একই লক্ষ্যে বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রবন্দরও নির্মাণ করছে। এই কাজে চীনের নিকট–অংশীদার মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। চীন মুখে যা–ই বলুক, সে এমন কিছুই করবে না, যাতে এই লাভজনক ব্যবসা কোনোভাবে বিঘ্নিত হয়।

এই যখন বাস্তবতা, তখন রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কী? অধ্যাপক কিপজেনের কাছে সরাসরি এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি স্পষ্টভাবে বললেন, নিকট–ভবিষ্যতে অবস্থা পরিবর্তনের কোনো আশা তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। একই কথা বললেন মাইকেল কুগেলমানও। তিনি রোহিঙ্গা প্রশ্নে যক্তরাষ্ট্রের সুপরিচিত ভাষ্যকার। তাঁর ধারণা, পৃথিবীর মানুষ এখন আর রোহিঙ্গাদের নিয়ে মাথা ঘামায় না।

বাইবেলে নরক ও স্বর্গের মাঝখানে যে জায়গাটুকু, তার নাম দেওয়া হয়েছে লিম্বো। রোহিঙ্গাদের অবস্থা এখন এই লিম্বোতে ঝুলে থাকার মতো। নিজের দেশে তাদের জায়গা নেই, দেশের বাইরেও তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তাদের জন্য আশার আলো কোথায়?

হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি