পেশোয়ারের কিসসা কাহিনির বাজারের এক ‘কাপুর হাভেলি’

পেশওয়ারের কাপুর হ্যাভেলিতে শশী কাপুর
সংগৃহীত

ভারত ভাগের ৭৩ বছর হয়ে গেল। দুই বছর পর প্লাটিনাম জয়ন্তী।

ভারত-ভাগ কোটি কোটি মানুষের জন্য ছিল দেশভাগ। এই ভাগাভাগির পার্শ্বফল হিসেবে ঘৃণা, খুন, লুট—সবই হয়। সহায়-সম্পত্তি রেখে শিকড় ছেড়ে উদ্বাস্তু হতে হয় হিন্দু, মুসলমান, শিখ—সবাইকে। রক্ত আর অশ্রুভেজা সে ইতিহাস বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারতে সবারই কমবেশি জানা। ইতিহাসের সেই ক্ষত মুছে দেওয়া সহজ নয়। মুছে দেওয়ার চেষ্টাও বেশি হয়নি। বরং সেই ক্ষতকে আরও ক্ষতবিক্ষত করার চেষ্টাই জারি আছে সাত দশক ধরে। পেশোয়ারের ‘কিসসা কাহিনি বাজারে’র সাম্প্রতিক ‘কাহিনি’ সে বিবেচনাতেই অনন্য।

কিসসা কাহিনি বাজারের তারকারা

পেশোয়ার পশতুনদের জনপদ। খাইবার পাখতুনখাওয়ার রাজধানী। আগে ছিল উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন শহর পেশোয়ার। বহু সংস্কৃতির এক মিলনকেন্দ্র ছিল একদা। দেশভাগের আগে এই শহরেই থাকতেন আজকের বলিউডের কাপুর পরিবার। শহরের ঢাকি মুনওয়ারশ শাহ এলাকায় তাদের বাড়ি ‘কাপুর হাভেলি’ ছিল নজরকাড়া। রাজ কাপুরের দাদা দেওয়ান বশেশ্বরনাথ ওই বাড়ি বানান।

একই পাড়াতেই কয়েক শ গজের মধ্যে দিলীপ কুমারদের বাড়ি। যিনি আসলে মোহাম্মাদ ইউসুফ খান! রাজ কাপুর ও দিলীপ কুমারের জন্ম এই পাড়াতেই। বলিউডে রাজ কাপুর ও দিলীপ কুমারের বন্ধুত্ব পেশোয়ারের বন্ধুত্বেরই ধারাবাহিকতা মাত্র।

ঢাকি মুনওয়ারশ শাহ এলাকা পেশোয়ারের বিখ্যাত কিসসা কাহিনি বাজার অঞ্চলের একাংশ। একদল লোক পেশাদার গল্প বলিয়ে এখানে ‘কিসসা’ শুনিয়ে ভালো আয় করত আগে, এখনো এ পেশা একেবারে হারায়নি। তা থেকেই ওই নাম। এই এলাকার রাজনৈতিক তাৎপর্যও অনেক। আবদুল গাফফার খানের নেতৃত্বে খোদাই খিদমতগারদের ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম থামাতে ব্রিটিশরা এখানে গণহত্যা চালিয়েছিল ১৯৩০-এর এপ্রিলে। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে এই ঘটনা ‘কিসসা কাহিনি গণহত্যা’ নামে পরিচিত।

কাপুররা সাময়িকভাবে এলাকা ছাড়েন ১৯৪০-এর দিকে। ইউসুফ খানদের পরিবার তারও আগে। ১৯৪৭-এর আগে পর্যন্ত সবারই মৃদু আসা-যাওয়া ছিল। ৪৭-এ ‘দেশভাগের গণভোটে’ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পাকিস্তানভুক্তির পক্ষে ভোট দেয়। এরপর হয়ে গেল উভয় দেশের মধ্যে কয়েক দফা যুদ্ধ।

কাপুর ও খানদের আর পেশোয়ার ফেরা হয়নি। এভাবেই পাঞ্জাব আর বাংলার দুই দিকের কোটি কোটি মানুষও দেশভাগের আগে-পরে জন্মভূমি, জন্মভিটা এবং আজন্মস্মৃতি রেখে উৎখাত হয়েছে। ১৯৫১ সালে উপমহাদেশজুড়ে যে শুমারি হয়, তাতে দেখা গিয়েছিল, ভারতে ৭৩ লাখ এবং পাকিস্তানে ৭২ লাখ স্থানচ্যুত মানুষ আছে। এদের মূল অংশই দেশভাগের শিকার। যাদের অনেকেই শত শত বছরের সম্পদগত উত্তরাধিকারও হারিয়েছিলেন সেদিন।

তবে ইতিহাস হয়তো নিজেকে সংশোধনও করতে চায়। অন্তত কাপুর ও খানদের পরবর্তী প্রজন্ম স্বস্তি পাবে এই ভেবে যে তাদের পূর্বপুরুষের স্মৃতিস্মারক যত্নের সঙ্গে রক্ষিত আছে। পেশোয়ারে প্রাদেশিক সরকার বলিউড স্টারদের কিসসা কাহিনি বাজারে থাকা বাড়িঘর রক্ষায় উদ্যোগী হয়েছে সম্প্রতি।

‘মুঘল-ই-আজম’-এর নায়ক ৯৭ বছর বয়সী দিলীপ কুমারের জন্য এটা যে কত বড় আনন্দদায়ক হয়েছে, সে খবর প্রচারমাধ্যম আসে তাঁর টুইটের সূত্রে গত ৩০ সেপ্টেম্বর। সর্বশেষ ১৯৮৮ সালে নিজের শৈশবের বাড়ি দেখতে গিয়েছিলেন তিনি পেশোয়ারে।

১৯৯০-এ ঋষি কাপুর ও রণধীর কাপুর বেড়াতে গিয়ে বাবা-দাদাদের জন্মভিটা থেকে মুম্বাইয়ের কিছু মাটি নিয়ে এসেছিলেন সঙ্গে। এ থেকে জন্মভূমি থেকে উৎখাত হওয়া মানুষের আবেগের গভীরতা টের পাওয়া যায়। ঋষি কাপুর বরাবর পেশোয়ার নিয়ে নস্টালজিয়ায় ভুগতেন। মৃত্যুর আগে আরেকবার সেখানে যেতে চেয়েছিলেন। সে ইচ্ছা অপূর্ণই থাকল। বাংলা, পাঞ্জাবসহ দক্ষিণ এশিয়ার সব বিভক্ত হওয়া সীমান্তের দুই দিকেই অপূর্ণ ইচ্ছার এ রকম হাহাকার আজও কানে বাজে।

কাপুর হাভেলির অন্দরমহল
সংগৃহীত

রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয়ভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ না হলে বাংলা ও পাঞ্জাবে এ রকম স্মৃতিচিহ্ন রক্ষার উদ্যোগ খুব কম। কিছু কিছু রক্ষা করা গেলেও রীতিমতো আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়েছে।

পেশোয়ারে রাজ কাপুর ও দিলীপ কুমারদের স্মৃতিচিহ্ন রক্ষার আয়োজনে স্থানীয় লোকজন খুশি। আজকের বলিউডের সুপরিচিত নায়ক শাহরুখ খানের পৈতৃক বাড়িও পেশোয়ারের ওই অঞ্চলে। তাঁর বাবা তাজ মোহাম্মদ খান এখানেই বড় হন। দিল্লিতে জন্ম হলেও শাহরুখও কিছু সময় কিসসা কাহিনি পাড়ায় থেকেছেন। বলিউডের প্রথম প্রজন্মের নায়ক কাপুর পরিবারের পৃথ্বীরাজ কাপুর অভিনয় শুরু করেন পেশোয়ার থেকেই। বরাবরই তিনি মজা করে নিজেকে বলতেন ‘হিন্দু পাঠান’। মধুবালাও এক অর্থে পেশোয়ারের সন্তান। তাঁর পিতা আতাউল্লাহ খান পেশোয়ারের পশতুন।

কিসসা কাহিনি বাজারের মানুষ নিজেদের এলাকার বলিউড তারকাদের জন্য গর্ব লালন করে। এমনকি নয়াদিল্লি বনাম ইসলামাবাদের তীব্র সামরিক-রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যেও এই গর্ব কমেনি। পেশোয়ার কর্তৃপক্ষও তাদের শুভবোধ থেকে পিছু হটেনি। ‘কাপুর হাভেলি’কে কেবল সংরক্ষণই করা হচ্ছে না—এটাকে উপমহাদেশের সবার জন্য একটা পরিদর্শনযোগ্য জায়গায় রূপান্তর করা হচ্ছে এখন।

কেবল চলচ্চিত্র তারকা নয়, দেশভাগের সময়কার ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, বিখ্যাত শিক্ষাবিদদের স্মৃতিচিহ্নগুলোও এভাবে রক্ষা করতে চাইছে পেশোয়ার।

এ রকম উদ্যোগ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যত্র নয় কেন

এটা এমন এক উদ্যোগ, যা পাকিস্তানের সর্বত্র এবং উপমহাদেশের অন্যত্র ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হওয়া দরকার। ১৯৪৭-এর পর থেকে ভারত-পাকিস্তানে এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশেও দেশভাগের আগে-পরে দেশত্যাগকারীদের সম্পত্তি বেহাত হয়েছে। পরবর্তীকালে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘এনিমি প্রপার্টি’র নামে এ রকম সম্পদ সরকারি জিম্মায় গিয়ে অন্যদের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামের আইনের মাধ্যমে এটা হয়েছে এবং আইনের চোখ ফাঁকি দেওয়া প্রচুর দখল-বেদখল হয়েছে। এভাবে দেশভাগের পর উপরিউক্ত তিন দেশেই বহু পরিবারের স্মৃতিস্মারক ও সাংস্কৃতিক শিকড় উপড়ে গেছে। যাকে একধরনের সাংস্কৃতিক উৎপাটন হিসেবে দেখা যায়। সাধারণ বসতবাড়ি ছাড়াও এসব স্মৃতিচিহ্নের মধ্যে ছিল বিখ্যাত বইয়ের দোকান থেকে শুরু করে জমিদারবাড়ি পর্যন্ত। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের উপাদানগত মূল্য ছাড়াও এসব স্মারক স্থানীয় স্থাপত্যশিল্পের অনন্য হদিসও বটে।

সব কটি সম্ভব না হলেও এসবের কিছু কিছু সংরক্ষণ করা জরুরি ছিল। যে সংরক্ষণ উপমহাদেশের এই তিন দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বন্ধনকে জ্বালানি জোগাতে পারত। নতুন প্রজন্ম এতে দক্ষিণ এশিয়ার সাংস্কৃতিক ও আধ্যত্মিক উৎসবিন্দুগুলো চিনতে শিখত। জনগণ পর্যায়ে তখন তিন দেশের মানুষের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ কমত। পেশোয়ারে প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষ সে রকম বিবেচনা থেকেই হয়তো এসব কাজ করে থাকবে। তারা কাপুর ও খানদের বাড়িগুলো রীতিমতো কিনে নিয়ে সংরক্ষণ করছে। যে পেশোয়ার থেকে নিয়মিত কেবল উগ্রবাদী খুনোখুনির সংবাদই পাওয়া যায়, সেখান থেকে আসা সর্বশেষ সংবাদটি দারুণ ব্যতিক্রমই বলতে হবে। এটা যেন খান আবদুল গাফফার খানের সেই খোদাই খিদমতগারের অহিংস রাজনীতিরই এক নবজাগরণ।

এ উদ্যোগ পাকিস্তানের চিরবৈরী ভারতজুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হচ্ছে। এ রকম সাংস্কৃতিক উদ্যোগ যে বিভেদবাদী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে মিসাইলের চেয়ে কার্যকর, সেটাই প্রমাণ করল যে পেশোয়ার সরকার। এ রকম উদ্যোগ যে বাণিজ্যিকভাবেও সফল হতে পারে, তারও আলামত দেখা যাচ্ছে। ভারতের বহু মানুষ আওয়াজ দিয়েছে শিগগিরই তারা পেশোয়ার যাবে ঘুরে দেখতে। পাঞ্জাবের ফয়সালাবাদে (পূর্বের লয়ালপুর) ভগত সিংহের পৈতৃক স্মৃতিচিহ্ন রক্ষার আয়োজনও ইতিমধ্যে প্রশংসিত হয়েছে ভারতজুড়ে। অনেক শিখ সেখানে যাচ্ছে।

ভগত সিংয়ের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করতে পাকিস্তান সরকার আট কোটি রুপি খরচ করে। কাপুর হাভেলি রক্ষায় দেওয়া হয় পাঁচ কোটি রুপি। যেকোনো রাষ্ট্রের জন্য এটা সামান্য অর্থ। কিন্তু এতে যে সাংস্কৃতিক ইতিহাস রক্ষা পায়, তা অমূল্য।

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনার মুখে পেশোয়ারে এই মুহূর্তে হিন্দি সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ। কিন্তু সেখানকার সরকার রাজনীতির ওই উত্তেজনা থেকে ইতিহাসকে আপাতত আড়াল করছে। বলিউডের মুভি বন্ধ হলেও বলিউডের তারকাদের জীবনকে জীবন্ত রাখার চেষ্টা আছে। সঠিকভাবেই তারা মনে করছে, সাংস্কৃতিক এসব উত্তরাধিকার কোনো একক দেশের সম্পদ নয়—বরং তা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার সম্মিলিত সাংষ্কৃতিক পুঁজি।

আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক