পোপ ও আয়াতুল্লাহর বৈঠকের রহস্য

ইরাকের নাজাফ শহরে গত ৬ মার্চ আয়াতুল্লাহ আলি আল সিস্তানি ও পোপ ফ্রান্সিস বৈঠক করেন
ছবি: ভ্যাটিকানের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

প্রায় তেরো শ বছর পর ঘটল এমন ঘটনা। সপ্তম শতাব্দীর পরে কোনো ক্যাথলিক খ্রিষ্টান পোপ শীর্ষ কোনো শিয়া আধ্যাত্মিক নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। ৮৪ বছর বয়সী ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের এই ধর্মগুরু আর ৯০ বছর বয়সী শিয়া গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ সিস্তানির দেখা হওয়া এক ঐতিহাসিক ঘটনা। এই সফরে পোপ নিকটবর্তী হলেন ইসলামের খলিফা হজরত আলীর (রা.) সমাধির। এই সমাধির কাছেই সিস্তানির বাড়ি, সেখানেই ৫০ মিনিটের বৈঠক করেন দুই ধর্মের দুই প্রতিনিধি। খ্রিষ্টানদের জন্য জেরুজালেম যেমন গুরুত্বপূর্ণ, শিয়া বিশ্বাসী মুসলমানদের জন্য নাজাফ তেমনই।
পোপ বলা চলে হঠাৎ করেই ইরাক সফরের ঘোষণা দেন। ভ্যাটিকানের ভাষায় এটা শান্তি তীর্থযাত্রা। কিন্তু কী ছিল ৭ মার্চের এ সফরের উদ্দেশ্য?

দৃশ্যত, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসের হাতে বিপর্যস্ত ইরাকি খ্রিষ্টানদের মনে ভরসা জোগানো ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের বার্তার কথাও ভ্যাটিকান বলছে। আর পোপ ফেরার পথে বিমানে বসে সাংবাদিকদের কাছে আয়াতুল্লাহ সিস্তানির কথাকেই নিজের কথা হিসেবে জানিয়েছেন। পোপের ভাষ্যমতে, সিস্তানি তাঁকে বলেছেন, ‘মানুষ ধর্মীয়ভাবে অথবা সৃষ্টিগতভাবে পরস্পরের ভাই’।

ইরানের আয়াতুল্লাহ খামেনির পরে শিয়াদের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ধর্মপুরুষ হলেন আয়াতুল্লাহ সিস্তানি। তিনি শুধু ধর্মীয় নেতাই নন, ইরাকের রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব ব্যাপক। ২০০৩ সালে আল–কায়েদা নেতা মুসাব আল-জারকাবি যখন আয়াতুল্লাহ বাকির আল-হাকিমকে ইমাম আলী (রা.)–এর মাজারের সামনে বোমা মেরে উড়িয়ে দেন, তখন সিস্তানি শিয়াদের প্রতিশোধ নেওয়া থেকে বিরত করেন। সে সময় ইরাকে আমেরিকানদের দাপট এতই ব্যাপক ছিল যে সিস্তানি চাননি শিয়া-সুন্নি সাম্প্রদায়িকতায় মার্কিনদের ‘ভাগ করো শাসন করো’ খেলা জিতে যাক। সে সময় শিয়া-সুন্নি যুদ্ধের সুফল আমেরিকাই পেত।

২০০৪ সালে এই সিস্তানিই এককভাবে নাজাফের জনপ্রিয় শিয়া তরুণ নেতা, সদর বাহিনীর কমান্ডার মুক্তাদা আল-সদরকে বিনাশ করায় মার্কিন-ইরাকি অভিযানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রক্তগঙ্গা বইয়ের দেওয়া ঠেকান।

২০১৪ সালে সিস্তানি ফতোয়া দেন, আইএসের বিরুদ্ধে বেসামরিক ইরাকিদের অস্ত্র ধারণ করা বৈধ। এভাবে কার্যত তিনি সশস্ত্র ইরাকি প্রতিরোধকে উৎসাহিত করেন। এই ইরাকি মিলিশিয়ারাই পরে ইরানের জেনারেল সোলাইমানির সুদক্ষ পরিচালনায় ইরাক থেকে আইএসের ভাড়াটে যোদ্ধাদের বিতাড়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই মিলিশিয়া বাহিনীর নাম হয় পপুলার মবিলাইজেশন ইউনিট (পিএসইউ)। এটা এমন এক জোট, যার ভেতরে ইরাকি দেশপ্রেমিকেরা আছেন, আবার আছেন ইরানপন্থীরাও।

পোপ জন ফ্রান্সিস এহেন সিস্তানি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন বলে জানান সাংবাদিকদের। সিস্তানিকে তাঁর ‘সাধু পুরুষ’ মনে হয়েছে, মনে হয়েছে ঈশ্বরের আপন। ‘তাঁর কথা শুনলে যে কারোরই এটা মনে হবে’, বলেন পোপ। তিনি এমন এক ব্যক্তি, যাঁর মধ্যে প্রজ্ঞা ও ঐশ্বরিক স্বজ্ঞা বিদ্যমান।’ সিস্তানি নাকি তাঁকে বলেছেন, ‘বিগত ১০ বছরের মধ্যে এই প্রথম কেউ তাঁর কাছে এল, যাঁর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না।’

নাজাফে সিস্তানির মধ্যবিত্ত বাড়িতে এই বৈঠক হয়। অবাক করা বিষয়, সিস্তানির সঙ্গে একজন অনুবাদক ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। তিনি তাঁর মুখপাত্র এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সহযোগীদের এই বৈঠক থেকে দূরে রাখেন। বিপরীতে পোপের সঙ্গে ছিলেন ভ্যাটিকান ও ইরাকের খ্রিষ্টানদের চার নেতা।

সিস্তানি যদি তা বলেও থাকেন, তবু পোপের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতেই হবে। পোপ আইএসের অত্যাচারে পলায়নরত খ্রিষ্টানদের স্বার্থের প্রশ্ন ইরাকি সরকার ও ইরাকের প্রভাবশালী শিয়া নেতার কাছে তুলেছেন। পোপের ভাষায়, সিস্তানি তাঁর প্রতি ‘শ্রদ্ধাশীল ছিলেন’ এবং পোপ সম্মানিত বোধ করেছেন। বিদায় নেওয়ার সময় ৯০ বছরের বৃদ্ধ সিস্তানি সাধারণত আসন ছেড়ে ওঠেন না। কিন্তু পোপের জন্য তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন এবং দুবার সালাম সম্ভাষণ জ্ঞাপন করেছেন।

আমেরিকান সংবাদমাধ্যমে যখন ক্রমাগতভাবে শিয়া হুমকির কথা বলা হচ্ছে, শিয়া আয়াতুল্লাহদের সন্ত্রাস ও অশান্তির উৎস বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে, সে রকম সময়ে পোপের তরফে একজন গুরুত্বপূর্ণ শিয়া নেতাকে এমন জ্যোতির্ময় হিসেবে উপস্থাপনারও অবশ্য রাজনীতি আছে। সেই রাজনীতি শান্তির, সেই রাজনীতি যুদ্ধ ও সাম্প্রদায়িক হানাহানির বিরুদ্ধে। কিন্তু পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে পোপের সফরের খবরে উভয় পক্ষের মোলাকাতের এই উষ্ণতা পাওয়া যায় না। বিবিসির খবরে মনে হয় পোপ কেবল আইএসের দ্বারা বিধ্বস্ত গির্জাগুলো দেখতে গিয়েছিলেন। জার্মান সরকারের গণমাধ্যম ডয়চে ভেলের ইংরেজি অনলাইন সংস্করণে পোপের বরাতে এই সফরকে ‘ক্লান্তিকর’ বলে অভিহিত করে শিরোনাম দেওয়া হয়েছে।

কেউ কেউ বলছেন, পোপ চালাকি করে ইরানের আয়াতুল্লাহকে খাটো করার জন্য ইরাকের আয়াতুল্লাহকে বড় করেছেন। কিন্তু ইরাকের আয়াতুল্লাহও জন্মগতভাবে ইরানি এবং শিয়া বিশ্বে তিনি ইরানের পক্ষে আর ইরাকে মার্কিন দখলদারির ঘোর বিরোধী। পোপ সম্প্রতি ইরানি আয়াতুল্লাহ শিরাজির কাছে চিঠি লেখেন। তেহরানের নিজস্ব দূতাবাস রয়েছে ভ্যাটিকান সিটিতে।

বন্ধুত্বের পুষ্পিত অভ্যর্থনা সত্ত্বেও উভয় তরফে পার্থক্য রয়ে গেছে। আইএস যখন ইরাকের শিয়া-সুন্নি, খ্রিষ্টান ও ইয়াজিদিদের নিধন করছিল, তখন মুসলমান ও খ্রিষ্টান যোদ্ধারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে। কিন্তু পোপের বিবৃতির মধ্যে সেই সব মুসলমানের কথা নেই, যারা আইএসকে মোকাবিলা এবং খ্রিষ্টানদের রক্ষার জন্য জান দিয়েছে। আর এ কারণে সিস্তানিও পোপের সঙ্গে যৌথ বিবৃতি দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। যেমনটা তিনি এর আগে আবুধাবিতে করেছিলেন আল-আজহারের শেখের সঙ্গে সাক্ষাতের পর।

সিস্তানির বিবৃতিতে মার্কিন আধিপত্যকে না বলা হয়, দখলদারি সরানোর কথা আসে এবং মার্কিন সন্ত্রাস ও অবরোধের নিন্দা জানানো হয়। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এই খবরও এসেছে যে পোপের দপ্তর থেকে মাসাধিককাল থেকে চেষ্টা করা হচ্ছিল, যাতে বাগদাদ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। জবাবে সিস্তানি কঠোর ভাষায় বলেন, সেটা অসম্ভব, যতক্ষণ না ফিলিস্তিন স্বাধীন হচ্ছে। এরপর ভ্যাটিকান বিষয়টি আর তোলেনি বলে বলা হয়। কিন্তু সিস্তানি ছাড়েননি। তাঁর বিবৃতিতে তিনি স্পষ্ট করেন যে ইরাকের পক্ষে ভ্যাটিকান যথেষ্ট কাজ করেনি। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত যখন হাজারো শিয়া যোদ্ধা খ্রিস্টানদেরসহ অন্য ইরাকিদের রক্ষার জন্য জীবন দিচ্ছিল, তখন ভ্যাটিকান তাদের সমর্থনে একটা বিবৃতি পর্যন্ত দেয়নি। অথচ পিএমইউর যোদ্ধাদের মধ্যে কেবল শিয়ারাই ছিল না, ছিল অন্যান্য ধর্মের মানুষও।

পৃথিবীতে একটা আজব তালিকা রয়েছে; সেটা হচ্ছে আমেরিকা প্রণীত সন্ত্রাসবাদী তালিকা। আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করা যোদ্ধারাও তাদের কাছে সন্ত্রাসী। পৃথিবীর একমাত্র খ্রিষ্টান যোদ্ধাদের একটি দলও এই তালিকাভুক্ত। তারা হলো আইএসবিরোধী খ্রিষ্টানরা। গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাইডেন-হ্যারিস জুটি ইরাকে এদের অবস্থানের ওপর বড় আকারের বোমা হামলা চালানোর নির্দেশ দেন।

ফ্রান্সিস ফিরে গেছেন। তবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই ধর্মীয় নেতার এই সাক্ষাৎ উভয়ের মধ্যে অবিশ্বাস কমাতে সাহায্য করতে পারে। এই বৈঠক ইরানের বিরুদ্ধে আরও কঠোর হওয়ার বিরুদ্ধে বাইডেন প্রশাসনকেও বার্তা দেবে। এটাকে নিছক আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি বলে খাটো করা যাবে না। যুদ্ধ ও বাদশাহি-পীড়িত মধ্যপ্রাচ্যে মানবিকতা ফেরাতে এই ঘটনা কতটা প্রভাব ফেলবে, তা অবশ্য এখনো দেখার অপেক্ষা।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]