পোষ্য কোটার যৌক্তিকতা কোথায়

২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনের ধারাবাহিকতায় সরকার বাংলাদেশ রেলওয়ের ক্যাডারবহির্ভূত কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা প্রণয়ন করে তা ২০ নভেম্বর জারি করেছে। বিধিমালাটি অনেকাংশেই গতানুগতিক। তবে দু–একটি বিষয় নজরে আসার মতো।

এ বিধিমালার ৩ নম্বর বিধিটি নিয়োগ–সম্পর্কিত। এতে নিয়োগের পদ্ধতি ও যোগ্যতা সম্পর্কে সাধারণ আলোচনা রয়েছে। এর পরপরই এ বিধির ৩ নম্বর উপবিধিতে বলা হয়েছে, ‘নিয়োগ–সম্পর্কিত অন্যান্য বিধানে যাহাই থাকুক না কেন ১৪ থেকে ২০ গ্রেডে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মোট শূন্য পদের ৪০ শতাংশ পোষ্যদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।’ জানা যায়, ১৯৮৫ সালের নিয়োগ বিধিতেও এমনটি ছিল। তা–ও কথা থাকবে এ সংরক্ষণের নৈতিক দিকটি কোথায়? আর রাষ্ট্রের আইন ও বিধিবিধান সংবিধানের বিধানাবলির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ার কথা নয়।

সংবিধান চাকরি লাভে সবার সমান অধিকারের নিরঙ্কুশ স্বীকৃতি দিয়েছে। কিছুটা ব্যতিক্রম রেখেছে সমাজের অনগ্রসর গোষ্ঠী ও অঞ্চলের জন্য। রেলের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা কি এর আওতায় আসেন?

সংবিধান চাকরি লাভে সবার সমান অধিকারের নিরঙ্কুশ স্বীকৃতি দিয়েছে। কিছুটা ব্যতিক্রম রেখেছে সমাজের অনগ্রসর গোষ্ঠী ও অঞ্চলের জন্য। রেলের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা কি এর আওতায় আসেন?

পোষ্যের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ রেলওয়েতে নিম্নপক্ষে ২০ বছর চাকরি করেছেন, এমন কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত, জীবিত বা মৃত ব্যক্তির স্ত্রী ও সন্তান পোষ্য হিসেবে গণ্য হবেন। অনেক আগে থেকেই এ ব্যবস্থা চলছিল বলে কি কেউ এর যৌক্তিকতা ও সাংবিধানিক ভিত্তি নিয়ে কথা বলবেন না? নথিটি তো আইন মন্ত্রণালয়েও গিয়েছিল। সবাই এভাবে কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বিরাগভাজন হতে চাননি। এই দুর্বলতার কারণেই এমনটা হতে পারে। আর হতে পারে ভালোভাবে না দেখে কিংবা যাদের স্বার্থে বিধানটি
তাদের প্রতি যেকোনো কারণে অযৌক্তিক সুবিধা দেওয়ার ইচ্ছা থেকে।

বাংলাদেশ রেলওয়ে দেশের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। কখনো কোম্পানি চালিয়েছে, কখনো–বা নিয়ন্ত্রণে এসেছে সরকারের। কোম্পানির চাকরিতে কোথাও কোথাও পোষ্যদের নিয়োগের একটি রীতি ছিল এবং এখনো আছে। তবে সে কোম্পানি তো নিজের আয়ে চলে। ব্যবসা সম্প্রসারণও করে মুনাফা থেকে। বিনিয়োগকারীরা নেন মুনাফা। লোকসান হতে থাকলে জনবল ছাঁটাই করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ের অবস্থা ভিন্ন। ১৯৪৭–এর পর এটি সরাসরি সরকার পরিচালনা করছে।

সরকারের আওতাধীনেই এ সংস্থা সাধারণত লোকসানেই চলছে। এর হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন ও মাঝারি ধরনের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়ও সরকারি মঞ্জুরি থেকে মেটানো হয়। রেলের জন্য ব্যয়ের প্রয়োজন আছে। দরকার এর সেবাব্যবস্থার আরও সম্প্রসারণ। সুতরাং সরকারি এ সংস্থায় অধিকতর বিনিয়োগ সবাই সমর্থন করে। আর সে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে উত্তরোত্তর। বলার অপেক্ষা রাখে না, এটা জনগণের করের অথবা ভিন্ন কোনো দেশ থেকে পাওয়া ঋণ বা অনুদানের। যেটাই হোক সেটা জনগণের টাকা।

এসব বলার অর্থ বাংলাদেশ রেলওয়ে সব অর্থেই সরকারের টাকায় পরিচালিত একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এর আওতায় রেলপথের বর্তমান দৈর্ঘ্য ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার। সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে ৪ হাজার ৭০০ কিলোমিটারে উন্নীত করার। এখনকার জনবল ৪০ হাজার ২৭৫। রেলওয়ের পক্ষ থেকে সব সময় বলা হয় চাহিদার তুলনায় এটা অপ্রতুল। গত কয়েক দশকে পরিত্যক্ত হয়েছে বেশ কিছু স্টেশন। কিছু শাখা লাইন উঠিয়ে ফেলা হয়েছে। প্রয়োজনীয় সেবার জন্য রেলের কাঙ্ক্ষিত জনবল নেই। এটা নজরে আসে। জানা যায়, এ জনবল বড় রকম বৃদ্ধির জন্য কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ ব্যবস্থায়ও কারও আপত্তি নেই। রেলের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা অন্য সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের মতো বেতন–ভাতা ও পেনশন পান। রেলের বাসভবনে ভালোভাবে অবস্থানের সুযোগও রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে পরিবার–পরিজন ও নিজেদের যাতায়াতের জন্য রয়েছে ফ্রি পাসের ব্যবস্থা। এটাও যুগবাহিত রেওয়াজ। সবই বুঝলাম। তবে ১৪ থেকে ২০ গ্রেডের শূন্য পদে নিয়োগে তাঁদের পোষ্যদের জন্য কোনো কোটা রাখার যৌক্তিকতা লক্ষণীয় হয় না।

জানা যায়, ১৯৮৫–এর নিয়োগবিধির আগে এটা ৩০ শতাংশ ছিল। সে সময়ে উন্নীত হয় ৪০ শতাংশ। এই প্রথা অন্য সব চাকরিপ্রার্থীর রিজিকে হাত দিচ্ছে। আর সংবিধান প্রদত্ত অধিকারেরও ঘটাচ্ছে ব্যত্যয়। সুতরাং এ ধরনের সুযোগ-সুবিধার বিলুপ্তি সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্বের আওতায় আসে। এবারের বিধিমালাটি প্রণয়নের সময়ে বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া সংগত ছিল।

বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগসহ অন্য সব নিয়োগ অল্প কিছুকাল আগেও বহুবিধ কোটার আওতায় ছিল। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি এবং একপর্যায়ে ক্ষোভের মুখে সরকার ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত নিয়োগে সব ধরনের কোটা ব্যবস্থার অবসান ঘটায়।

রেলের নতুন নিয়োগবিধি প্রণয়ন, পর্যালোচনা, যাচাই, বিশ্লেষণ ইত্যাদির সঙ্গে যাঁরা সংশ্লিষ্ট ছিলেন, অতীতের ধারাবাহিকতায় এ ধরনের বিধান চালু রাখার যৌক্তিকতা তাঁরা তুলে ধরতে পারেন না। রেলের নিম্নপদস্থ চাকরিগুলোর ৪০ শতাংশ তাঁদের পোষ্যদের জন্য সংরক্ষিত থাকায় অন্য প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে বঞ্চিত হন। এ সংরক্ষণ কোনো বিবেচনাতেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। একটি রাষ্ট্র পরিচালনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্ষেত্রবিশেষে ভুলভ্রান্তি হয়। সুশাসনের স্বার্থে সেগুলো পর্যায়ক্রমে সময়ান্তরে সংশোধন করার আবশ্যকতা থাকে। রেলসহ সরকারি চাকরিতে পোষ্য কোটা যেখানে আছে, সেগুলো বাতিল করা এ ধরনেরই আবশ্যকতা।

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

[email protected]