প্যারিস টু পাটুরিয়া: মানুষ কেন শহর ছাড়ে?

লকডাউনের ঘোষণায় ঘরমুখী মানুষের ভিড়
ছবি প্রথম আলো

গত বছর মার্চের শেষে লকডাউন দেওয়া হয়েছিল ঢাকায়। এ বছর এপ্রিলের ৫ তারিখে লকডাউন শুরু হলো। অবস্থা তথৈবচ। যত সচ্ছল তত লকডাউন, যত গরিব তত চিচিংফাঁক। গতবার মানুষ হুড়মুড় করে ঢাকা ছেড়েছিল। এবার কেউ হুড়োহুড়ি করে বাজার করছে। অন্যদিকে চলছে জীবিকা বাঁচানোর মিছিল-বিক্ষোভ। প্রথম রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেলের চালকেরা, পরে বিভিন্ন মার্কেট ও বাজারের ব্যবসায়ীরা রাস্তায় নেমেছে। গতবার বাস-ফেরি-ট্রাক ভরে মানুষের গ্রামমুখী যাত্রাকে পরিহাস করা হয়েছিল। এসবকে অশিক্ষিত ও গরিবদের আত্মঘাতী আচরণ বলে মহামারির জন্য তাদেরই দোষারোপ করা হয়েছিল। প্রবাসফেরত শ্রমিকদেরও কম হুজ্জত পোহাতে হয়নি।

পরিস্থিতি অবনতির দায় কার?

এবার কিন্তু ফেব্রুয়ারি থেকে পুরো মার্চ পর্যন্ত সরকারি উদ্যোগে জেলায় জেলায় বাণিজ্য মেলা চলেছে, রাজধানীতে চলছে বইমেলা, চলেছে রাষ্ট্রীয় বিবিধ উৎসব। প্রথা-পার্বণ-বাণিজ্যের উশুল উঠতে দেরি বলে লকডাউনও এল দেরিতে। কিন্তু করোনা অপেক্ষা করে থাকবে না। ফলে যা হওয়ার তা–ই হয়েছে।

সংক্রমণ ও মৃত্যু রেকর্ড ছাড়াচ্ছে। আইসিইউ শয্যা খুঁজতে ৫টি হাসপাতাল ঘুরে শেষে মরে গেলেন যে মা, তাঁর সন্তানের কান্না গণমাধ্যমকে ভিজিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কেউ শিক্ষা নেয়নি। সরকারি হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়েনি, আইসিইউ বেড বাড়েনি। অক্সিজেন প্ল্যান্ট যেটা তৈরি হওয়ার কথা ছিল, তা অর্ধসমাপ্ত।

ইতিমধ্যে টিকার জোগানও ফুরাল বলে। অথচ পুরো একটা বছর সময় পাওয়া গিয়েছিল। এই সময়টায় প্রতিপক্ষের পেছনে যতটা ছোটাছুটি হয়েছে, জীবন বাঁচাতে ততটা তৎপরতা দেখা গেছে কি?

অনেকেই বলেন এই দেশের মানুষ নিয়ম মানে না, স্বাস্থ্যবিধি মানে না। তাদের জন্য প্যারিস, লন্ডন ও কুয়ালালামপুরের কয়েকটা ছবি নিচে দেওয়া হলো। লকডাউন শুরুর আগে এসব দেশের মানুষও হুড়মুড় করে রেলস্টেশনে, রাস্তায় বা এয়ারপোর্টে ছুটেছে। মহাসড়কে লক্ষ গাড়ির সারি, রাজধানীতে লকডাউনবিরোধী দাঙ্গা কি হয়নি সেখানে? প্যারিস থেকে পাটুরিয়া, মালয়েশিয়া থেকে মাওয়ায় একই দশা।

গত মার্চে ফ্রান্সে ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট তৈরি হওয়ার মতো অবস্থা আমাদের অন্তত হয়নি। https://www.youtube.com/watch?v=o1xMPwI-nM8
আগের হাল যেদিকে, পিছের হালও সেদিকে যায়। মানুষ বিশৃঙ্খল, কারণ রাষ্ট্র বিশৃঙ্খল ও অপ্রস্তুত। যদি সরকার প্রকৃত পরিস্থিতি সবাইকে জানিয়ে ধাপে ধাপে কী করতে হবে তা জানাত, যদি একের পর একটি খাত বন্ধ করে ওই সব খাতের লোকদের প্রস্তুতির নির্দেশনা দিত, যদি ঢাকায় যথেষ্ট ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করে চিকিৎসার প্রস্তুতি নিত, যদি দ্রব্যমূল্য বাড়তে না দিত, যদি পশ্চিম বাংলা ও কেরালার রাজ্য সরকারের মতো দরিদ্রদের ছয় মাসের খাদ্য সাহায্য দেওয়ার ঘোষণা দিত, তাহলে মানুষ এভাবে বনপোড়া হরিণের মতো ছুটত না। সঠিক নেতৃত্ব ও দিশা পেলে এই বিশৃঙ্খল জনতাও বিরাট শক্তি হয়ে উঠতে পারে, তা আমরা মুক্তিযুদ্ধসহ বড় বড় দুর্যোগে দেখেছি।
আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগে যত না কাবু হই, তার চেয়ে বেশি ভুগি অব্যবস্থাপনার দুর্যোগে।

মানুষ বড় শহর ছাড়ে কখন?

৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করে গণপরিবহনে স্বাস্থ্যকর যাত্রার আয়োজন করা হলো। কিন্তু ভাড়াই বাড়ল কেবল, কিছু মানুষ চলল পায়ে হেঁটে, কিছু মানুষ ডাবল ভাড়া দিয়ে দ্বিগুণ যাত্রীর বাসে ওঠাকেই ভাগ্য বলে মনে করল।

এ রকম অব্যবস্থাপনার নগরী ছেড়ে আবার যদি মানুষ গ্রাম-মফস্বলের দিকে দলেবলে যাত্রা করে, তাদের কি দোষ দেওয়া যাবে? সরকারি চাকুরেদের চিন্তা নেই। যারা বেকার, যারা দিন এনে দিন খায়, যাদের জীবন গায়ে-গতরে খাটার ওপর, যারা গত এক বছরে মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত থেকে গরিব, গরিব থেকে ভিখিরিতে পরিণত হয়েছে, তাদের জন্য যৌক্তিক আচরণ কোনটা? ঘরে থাকা নাকি রোজগারের খোঁজে বাইরে বের হওয়া? ঘর বলতে যাদের কাছে ৭-৮ জন মিলে গাদাগাদি বসবাস, চৈত্রের গরমে ঘরে থাকার হুকুম তাঁরা কীভাবে তামিল করবেন? এ জন্যই বলা হয়, ভাত দেওয়ার মুরদ নাই, কিল মারার গোঁসাই।

যারা পালাচ্ছে তারা জানে ঢাকায় কোনো আশ্রয় নেই। সরকারি সাহায্য নেই, রেশন নেই। অসুস্থ হলে হাসপাতালে সিট নেই। অনেকেই বাড়িভাড়া, মেসভাড়া, বস্তির ঘরভাড়া দিতে পারবে না। তাই হুড়মুড় করে ঢাকা ছাড়ার মধ্যে কেবল পলায়ন নেই, আছে যার যার মতো বাঁচার প্রস্তুতি। এ জন্যই বলা, সবার করোনা একরকম নয়। সচ্ছলের কাছে করোনা ভয়ানক, গরিবের ক্ষুধা তার চেয়েও ভয়ানক। জীবিকা না থাকলে জীবনের ভয় কমে যায়।

যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে মহামারি মোকাবিলা করা লাগে। ঢাকায় কতজনের তা আছে?তখন তাদের মনে হয়, একা একা মরার চেয়ে বাড়ি গিয়ে আপনজনের মধ্যে মরা ভালো। সেখানে অন্তত সেবা করার লোক পাওয়া যাবে, অভাবে সাহায্য পাওয়া যেতে পারে।

লকডাউনে মার্কেট খোলা রাখার দাবিতে ঢাকায় বিক্ষোভ
ছবি প্রথম আলো

গ্রাম কি বেশি নিরাপদ?

বিভিন্ন গবেষণাতেও দেখা গেছে, করোনার অর্থনৈতিক ধাক্কা শহরের চেয়ে গ্রাম শক্তভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছে। প্রবাসী শ্রমিকের টাকা পাঠানো করোনাকালে বেড়েছে। বিশ্বব্যাংক বলেছিল, ২০২০ সালে রেমিট্যান্স আসবে ১৪ বিলিয়ন ডলার। বাস্তবে এসেছে ২১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। এটা আগের বছরের চেয়ে ১৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি।

রবি মৌসুমে সবজির দামে মার খেলেও ধান ভালোই ফলেছে। দেশে যে খাদ্যাভাব হয়নি, বৈদেশিক রিজার্ভ যে বেড়েছে, সব ওই গ্রামের কৃষক পিতা তার প্রবাসী শ্রমিক পুত্র–কন্যাদের অবদান। অথচ সরকার কৃষকদের জন্য প্রতিশ্রুত অনুদান পুরোটা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। যা–ও বা টাকা ছাড় হয়েছে, তাতেও মধুখেকো মাছিদের উৎপাত। আরও ধন্যবাদ দিতে হয় পোশাক শ্রমিকদের। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার জীবন্ত জিম্মি তারা। তাদের উপার্জনও করোনাকালে গ্রামের দরিদ্রদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ কিছুটা কমিয়েছে।

বলপ্রয়োগের বেলায় রাষ্ট্র যতই শক্তিশালী হোক, জনগণের সুরক্ষার বেলায় এই রাষ্ট্র অতীব দুর্বল। অন্যদিকে জনগণ বা সমাজ রাষ্ট্রের সামনে যতই নাজুক হোক, আপন আপন উদ্যোগে টিকে থাকার সক্ষমতা তার এখনো রয়েছে।

লকডাউন এক দুধারি তলোয়ার

ভারত ও বাংলাদেশের গত এক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এই কৌশল ভালোও না মন্দও না। লকডাউন তখনই ভালো, যখন ওই সময়টা স্বাস্থ্য অবকাঠামো উন্নত করায় কাজে লাগানো হয়, জনস্বাস্থ্য বাবদ বাজেট বাড়ানো হয় এবং অভাবী মানুষকে খাওয়ানোর বন্দোবস্ত করা হয়।

গত বছরের লকডাউনের অভিজ্ঞতা কিছু শিক্ষা দেয়। ২০২০–এর করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা নিয়ে গবেষণা করেছেন তিনজন অধ্যাপক (https://www.sciencedirect.com/science/article/abs/pii/S0305750X20303430 )। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. তারিক ওমর আলী, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মির্জা হাসান ও যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান ইউনিভার্সিটির নওমি হাসান। গবেষণা থেকে তাঁরা ৫টি পর্যবেক্ষণে পৌঁছেছেন:

১. বাংলাদেশের নাগরিকেরা প্রথমে স্বেচ্ছায়ই লকডাউনের নিয়ম মান্য করেছিল।
২. কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তারা দেখল সরকারি ত্রাণ ব্যবস্থা অস্বচ্ছ ও অকার্যকর।
৩. প্রশাসনকে তখন লকডাউনের কড়াকড়ি উঠিয়ে নিতে দেখা গেল এবং নীতিনির্ধারকেরাও নীরবে এই নীতি থেকে সরে এলেন।
৪. বাংলাদেশে রাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা বা বৈধতা নির্ভর করে সংকটে নাগরিকদের সুরক্ষায় রাষ্ট্রের ভূমিকার ওপর এবং
৫. নাগরিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য থাকা মহামারি ব্যবস্থাপনার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় সরকারের কাছে।

তাঁরা জনগণের দায়িত্ব নেওয়ার বেলায় রাষ্ট্রের দুর্বলতা এবং আপন আপন সামাজিক শক্তিতে টিকে থাকার ব্যাপারে বাংলাদেশিদের সামর্থ্যের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। এই সামাজিক শক্তি বা সোশ্যাল ক্যাপিটালের দিক থেকে বড় বড় নগর এখন প্রায় দেউলিয়া। এখানে করোনাক্রান্ত পরিবারকে বাড়িছাড়া করার উদাহরণ আকছার। গবেষকেরা যে শক্তিশালী সমাজের কথা বলেছেন, সেটা আছে গ্রামে। শহরে রাষ্ট্র শক্তিশালী, সামাজিক মানবিকতা দুর্বল।

উল্টোভাবে বললে, বলপ্রয়োগের বেলায় রাষ্ট্র যতই শক্তিশালী হোক, জনগণের সুরক্ষার বেলায় এই রাষ্ট্র অতীব দুর্বল। অন্যদিকে জনগণ বা সমাজ রাষ্ট্রের সামনে যতই নাজুক হোক, আপন আপন উদ্যোগে টিকে থাকার সক্ষমতা তার এখনো রয়েছে।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]