প্রজা থেকে নাগরিকে উত্তরণে আর কত দিন লাগবে

রিপাবলিক–এর অনুবাদ হিসেবে ‘প্রজাতন্ত্র’ শব্দটা কেমন যেন। প্রজাতন্ত্রে প্রজাদের ইচ্ছায়ই চলবে সব, তাঁরাই হবেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক। কিন্তু রিপাবলিকে তো প্রজা থাকার কথা নয়, থাকার কথা নাগরিক, যাঁদের সংবিধানে স্বীকৃত বিভিন্ন অধিকার থাকবে। রিপাবলিকের বাসিন্দারাও নিজেদের নাগরিক বলেই পরিচয় দেন, প্রজা নয়। প্রজা তো থাকত রাজাদের সময়। তাহলে কেমন একটা স্ববিরোধিতা এসে গেল না? মনে হচ্ছে, প্রজাতন্ত্র কথাটা সঠিক পরিস্থিতিকে তুলে ধরছে না।

বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মতো আমাদের পূর্বপুরুষেরাও বাস করতেন রাজাদের অধীনে প্রজা হিসেবে—সেটুকুই অধিকার নিয়ে, যেটুকু রাজারা দিতেন অনুকম্পাভরে। ঔপনিবেশিক যুগের আগেও তা–ই ছিল, ছিল ব্রিটিশদের শাসনামলেও। একসময় রাজারা ছিলেন সার্বভৌম। মোগল সম্রাটেরা যখন স্থানীয় রাজাদের একে একে তাঁদের অধীনে নিয়ে এলেন, সার্বভৌমত্ব গেলেও তাঁদের রাজা পদবি ব্যবহারে কোনো বাধা দেওয়া হয়নি। এমনকি প্রাদেশিক নবাবদের অধীনে যে বড় জমিদারেরা ছিলেন, তাঁরাও রাজা–মহারাজা উপাধি সাড়ম্বরে ব্যবহার করতে থাকলেন। গোপাল ভাঁড়ের সুবাদে খ্যাত মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন বাস্তবে নবাব সিরাজউদ্দৌলার অধীনে নদীয়ার জমিদার। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেও এ নীতি বহাল থাকল। তারা বরং ছিল আরেক কাঠি সরেস। প্রাদেশিক গভর্নরদের মোগল পদবি ছিল সুবাদার, একই সঙ্গে তঁার সামরিক পদবি ছিল সিপাহসালার বা প্রধান সেনাপতি। সেই সুবাদারকে ইংরেজরা এক ধাক্কায় বানিয়ে দিল জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার বা জেসিও, লেফটেন্যান্টেরও নিচে।

ব্রিটিশ বাংলায় ছোটখাটো জমিদারদের বাসস্থানও স্থানীয়ভাবে রাজবাড়ি নামেই পরিচিতি পেত, আর প্রজাসাধারণ তাদের মহারাজ বা রানি নামেই সম্বোধন করতেন। সার্বভৌমত্ব না–ই থাকুক, এই রাজা–মহারাজারা বাস্তবে কিন্তু ছিলেন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। জবাবদিহির কোনো ব্যাপার ছিল না তাঁদের। ‘রাজবাড়ি’র সামনে দিয়ে জুতা পায়ে বা ছাতা মাথায় যাওয়াও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হতে পারত। প্রজাদের কাজ ছিল এই রাজামশাইদের মেনে চলা, চাষবাস করা এবং খাজনা দেওয়া। সেই খাজনা তাঁদের সামর্থ্যের তুলনায় নিতান্ত কম ছিল না। কারণ, সার্বভৌম ব্রিটিশ সরকার ছাড়াও তাতে ভাগ ছিল জমিদারের, ছিল নায়েব-গোমস্তাদেরও। কৃষকের পাঁচ টাকার সবজি বিভিন্ন ঘাটে খাজনা দিয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে যেমন চল্লিশ টাকা হয়ে যায় আরকি।

ব্রিটিশ ভারতে ‘নেটিভ’দের যখন সীমিত রাজনীতির সুযোগ দেওয়া হলো, তখন যে দুটো বড় দল গড়ে উঠল, সেই কংগ্রেস বা মুসলিম লিগ ঠিক প্রজাদের দল ছিল না। অভিজাত, বিত্তবানেরাই দলগুলোর নিয়ন্ত্রণ করতেন। কমিউনিস্ট পার্টি ছিল, তাদের দর্শনে কৃষক–শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার বিষয়ও ছিল, কিন্তু তাদের কার্যকলাপ ছিল সীমিত। বাংলার প্রজাদের বিবেচনায় নিয়ে প্রথম যে রাজনৈতিক দল ব্যাপক প্রসার লাভ করে, তা হচ্ছে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক প্রজা পার্টি। নেতৃত্বে একজন উচ্চশিক্ষিত বিত্তশালী মানুষ আসীন থাকলেও এই দল বাংলার প্রজাদের সুখ–দুঃখ বিবেচনায় নেয়। ফলে প্রতিষ্ঠিত দুটি রাজনৈতিক দলকে পেছনে ফেলে অবিভক্ত বাংলার প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হন এ কে ফজলুল হক। ব্রিটিশদের বিদায়ের পর ১৯৫০ সালে গৃহীত পূর্ববঙ্গ জমিদারি উচ্ছেদ ও প্রজাস্বত্ব আইনের বদৌলতে কৃষক–প্রজারা তাঁদের চাষবাসের জমির ওপর একধরনের মালিকানার অধিকার অর্জন করলেন বহু যুগ পর।

দেশভাগ-উত্তর পাকিস্তানে পূর্ববঙ্গের মানুষকে নাগরিকের প্রাপ্য অধিকার অর্জনের জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে, যার চূড়ান্ত পর্যায় ছিল মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানে রাজনৈতিক ক্ষমতার দখলদার যাঁরা ছিলেন, পূর্বের রাজাগজাদের মতোই তাঁরা, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের মানুষকে প্রজাজ্ঞান করতেন। নাগরিক হিসেবে তাঁরা সমান অধিকারের হকদার, বিষয়টি নতুন রাজারা কখনোই মানতে পারেননি। এ দেশের মানুষকে স্থায়ীভাবে প্রজা বানানোর জন্য তাঁরা ২৫ মার্চের গণহত্যা শুরু করেন, তবে এ প্রচেষ্টায় শেষতক পরাজিত হয়ে তাঁদের পাততাড়ি গোটাতে হয়।

বার্নার্ড শর একটি মিলনাত্মক নাটক আর্মস অ্যান্ড দ্য ম্যান। এর শেষ দৃশ্যে নাটকের সুইস নায়ক যখন নায়িকার বুলগেরীয় বাবাকে রাজি করানোর জন্য তার বিপুল বিত্তবৈভবের বিবরণ দিচ্ছিল, নায়িকার বাবা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, তুমি কি সুইজারল্যান্ডের সম্রাট? নায়ক উত্তর দিল, সুইজারল্যান্ডের সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থানে আমি অধিষ্ঠিত, আমি একজন স্বাধীন নাগরিক।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয় এবং প্রস্থানের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে একজন স্বাধীন নাগরিক হিসেবে আমরাও নিজেদের তেমনি সম্মানিত মনে করতাম, যদিও অমন বিত্তবৈভবের ছিটেফোঁটাও ছিল না আমাদের।

আমাদের এ অনুভূতি অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। রাজা রাজা ভাবটা একটা রোগের মতো অনেকের মধ্যেই সংক্রমিত হয়েছিল। চারপাশের অনেককেই তারা মনে করত প্রজাস্থানীয়। ১৯৬০ সালের আগে যাঁদের জন্ম, তাঁদের মনে থাকবে যে ঢাকার প্রশস্ত রাস্তাগুলোর মাঝখানে দুটো গাড়ি যাওয়ার মতো জায়গা থাকত পাকা আর বাকিটা কাঁচা, প্রায়ই ঘাসে ঢাকা। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে গাড়ি ছিল খুবই কম। একজন জুনিয়র সরকারি কর্মকর্তা ভাগ্যগুণে প্রাপ্ত একটা অতি প্রাচীন, তোবড়ানো জিপে করে যাচ্ছিলেন। পেছন থেকে হর্ন দিচ্ছিল কয়েকটি গাড়ির একটি ছোট বহর। নির্বুদ্ধিতা বা গোঁ যে কারণেই হোক, সরকারি গাড়িচালক সঙ্গে সঙ্গে সাইড দেননি। বেশ খানিক পরে যখন সাইড দিলেন, একটি গাড়ি তাঁকে পেরিয়ে সামনে গিয়ে পথরোধ করে থামল। গাড়িতে একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বসে ছিলেন। তাঁর কয়েকজন সঙ্গী সেই জিপের চালককে নামিয়ে বেধড়ক পিটুনি দিয়ে রক্তাক্ত করলেন তাঁর বেয়াদবির শাস্তি হিসেবে। সেই গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি চুপচাপ সামনে তাকিয়ে বসে রইলেন।

কিছুদিন আগে একটি খবর দেখলাম পত্রিকায়। গুরুত্বপূর্ণ এবং ক্ষমতাধর এক নেতা বিশাল গাড়িবহর নিয়ে তাঁর জন্য ‘নির্ধারিত’ ফেরিতে উঠলে সঙ্গে অন্য আরও দুটি গাড়িও উঠে পড়ে। নির্দেশ সত্ত্বেও তাঁরা নেমে না যাওয়ায় গাড়ির মালিকদের ওপর নেতার পাইক–বরকন্দাজরা চড়াও হন এবং পিটিয়ে গুরুতর আহত করেন। আহত ব্যক্তিদের একজন বলেন যে পুলিশ এবং স্থানীয় লোকজন উদ্ধার না করলে তাঁদের মেরেই ফেলত। প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইনের দ্বারস্থ হবেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এতে ঝামেলা আর ভোগান্তি তো আরও বাড়বে।’ বাস্তব প্রজাসুলভ বক্তব্য।

৫০ বছর তো কাটল, প্রজা থেকে নাগরিকে উত্তরণে আর কত দিন লাগবে আমাদের?


মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব