প্রণোদনার অর্থ কোথা থেকে আসবে

টাকা। প্রতীকী ছবি
টাকা। প্রতীকী ছবি

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস বাংলাদেশেও থাবা বসিয়েছে। এর বিস্তার রোধ ও জনজীবন রক্ষার উদ্দেশ্যে সাধারণ ছুটির আকারে দেশজুড়ে একধরনের লকডাউন চলছে। ফলে অল্প-কিছু ব্যতিক্রম বাদে শিল্পকারখানার উৎপাদন থেমে গেছে; দোকানপাটে বেচাবিক্রি থমকে গেছে, ছোট-বড় নানা কাজ বন্ধ হয়ে গেছে, যান চলাচল থেমে গেছে, মানুষ গৃহবন্দী হয়ে পড়েছে। এসবের ফলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।

তবে অর্থনীতি যেন একেবারে স্থবির হয়ে না পড়ে, সে জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোট ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার একগুচ্ছ প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। এই অর্থ চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের প্রায় ১৪ শতাংশ। এবং চলতি অর্থবছরের প্রত্যাশিত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় আড়াই শতাংশ (চলতি বাজারমূল্যে)। দেশের ব্যবসায়ী-িশল্পপতিরা গত মাসের মাঝামাঝি থেকেই প্রণোদনা
দাবি করে আসছিলেন।

আর্থিক প্রণোদনা তাত্ত্বিকভাবে সংকটের কেইনসীয় সমাধান। অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে সরকারকে ব্যক্তি খাতে রাজস্ব প্রণোদনা দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। মানে, সরকারকে টাকা ঢালতে হবে যেন মানুষ সেই টাকা নিয়ে কেনাকাটা করে, ভোগ বাড়ায়। এমনভাবে টাকা ছাড়া হবে, যেন তা বাজারে চাহিদা তৈরি করে। কিছু ক্ষেত্রে নগদ সহায়তা দিয়ে, কিছু ক্ষেত্রে সাময়িক কাজের বিনিময়ে মজুরি দিয়ে, আর কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর করে চাহিদা তৈরি করা হবে। চাহিদার বিপরীতে পণ্য ও সেবা জোগান দিতে ব্যবসায়ী–শিল্পপতিরা উৎপাদন চালু রাখবেন। এসব পণ্য-সেবা বিক্রি হলে কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা মুনাফা করবেন আর কর্মী-শ্রমিকেরা বেতন-মজুরি পাবেন। সেই বেতন-মজুরি থেকে ব্যয় করা হলে চাহিদা তৈরি হবে বা চাহিদা সচল থাকবে।
এভাবে সামগ্রিক চাহিদা ক্রমে চাঙা করার মধ্য দিয়ে অর্থনীতিতে গতিময়তা ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে কেইনসীয় সূত্র বলে থাকে।

তবে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্রণোদনাগুচ্ছটি মূলত বাজারভিত্তিক। সরকার কোনো অনুদান বা এককালীন অর্থসহায়তা না দিয়ে বরং স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করেছে। প্রণোদনার অর্থ ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে নিতে হবে। এর ইতিবাচক দিক হলো এই অর্থ নির্বিচারে বিতরণ করা হবে না। পরববর্তী সময়ে পরিস্থিতি অনুসারে কিছু ঋণ মওকুফ হবে কি না, সেটা ভিন্ন বিষয়। এখানে সমস্যা হতে পারে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের, যারা হয়তো প্রয়োজন সত্ত্বেও সময়মতো ঋণ পাবে না নানামুখী সীমাবদ্ধতায় বা প্রক্রিয়াগত জটিলতায়। সে জন্য সুষ্ঠু তদারকি ও স্পষ্ট অথচ নমনীয় নীতিমালা প্রয়োজন হবে। না হলে এখানেও বড় অনিয়ম ঘটতে পারে।

প্রণোদনার অর্থ থেকে রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্মরত শ্রমিক-কমর্চারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের সুযোগ রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে নিম্ন ও সীমিত আয়ের কর্মজীবী কিছু মানুষ ন্যূনতম ভোগব্যয় মেটাতে পারবেন।

প্রশ্ন উঠেছে, এই টাকার জোগান কোথা থেকে আসবে? যেহেতু ব্যাংক থেকে ঋণ দিয়ে এই প্রণোদনা অর্থায়ন করা হবে, সেহেতু দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে পুনরায় অর্থায়ন করতে হবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক রেপোর সুদ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। ফলে একদিকে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কম সুদ ঋণ নিতে পারবে, অন্যদিকে নিজস্ব তহবিলে বাড়তি নগদ অর্থও পাবে। মোটকথা, মুদ্রানীতির সব রকম উপাদানকে কাজে লাগানোর বিকল্প নেই।

প্রণোদনাগুচ্ছ নিয়ে দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য কোনো কিছু এতে স্থান পেল না কেন? আপাতত এর কোনো জবাব নেই, যদিও সরকার চলমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি জোরদার করার কথা বলেছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ আছে ১৪ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা, যা বাজেটের প্রায় ৩ শতাংশ। আর স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ আছে ১৯ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা, যা বাজেটের ৩ দশমিক ৮১ শতাংশ। এসব বরাদ্দ দ্রুত বাড়ানো প্রয়োজন। সরকারের তহবিলে ইতিমধ্যে বেশ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক অনুদান যুক্ত হয়েছে, আরও হবে। অনুদানের অর্থ ও বিদেশি সহায়তা মিলিয়ে বাড়তি বরাদ্দ খুব কঠিন হবে বলে মনে হয় না।
সর্বোপরি অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগটা তো থাকছেই।

সরকার বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার সঙ্গে দেনদরবার শুরু করেছে মোট ২২ হাজার কোটি টাকা (২৬০ কোটি ডলার) পাওয়ার জন্য। করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব ঠেকাতে বিভিন্ন দেশকে সহায়তা দিতে এসব সংস্থা ইতিমধ্যে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। কাঙ্ক্ষিত সহায়তা পাওয়া গেলে তার বড় অংশই চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যয় হওয়ার কথা।

অভ্যন্তরীণ উৎসের কর-রাজস্ব থেকে খুব বেশি টাকা মিলবে না ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থবিরতার কারণে। তা ছাড়া নিয়মিত রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনার ব্যয়ভার মেটানোর বিষয়টিও রয়ে যাচ্ছে। তাই দেশের ভেতর থেকে বেশি করে ঋণ নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ট্রেজারি বিল, বন্ড ও সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ বাড়াতে হবে। প্রয়োজন হলে টাকা ছাপিয়ে নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে অবশ্য বাজারে টাকার সরবরাহ বেড়ে মূল্যস্ফীতির চাপ সৃষ্টি হওয়ার কিছুটা আশঙ্কা থাকছে।

আশা করা যায়, সরকারের তরফ থেকে দ্রুতই স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য বিশেষ অর্থ বরাদ্দসহ একটি বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনার ঘোষণা আসবে। তা না হলে ঘোষিত প্রণোদনা একপেশে হয়ে দাঁড়াবে।

আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]