প্রতিষ্ঠান ভাঙার বুলডোজার চলছেই

গত কয়েক মাসে ঢাকার আশপাশের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদ–নদীর তীরের টিনের ঘর থেকে শুরু করে চার-পাঁচতলা বিল্ডিং বুলডোজার দিয়ে ভাঙা হয়েছে। নদীর জায়গা অবৈধভাবে দখল করে এসব বাড়িঘর গড়ে তোলা হয়েছিল। এসব বাড়িঘরের কারিগরেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চরম ধান্দাবাজ এবং রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার প্রশংসা তাঁরা অনেকেই কুড়িয়েছিলেন। দখলদারদের মধ্যে কিছু এমপি সাহেবের নামও এসেছিল।

যাহোক, বুলডোজার দিয়ে এসব ভাঙার কাজ জনগণের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। পরে ঢাকার বাইরেও এসব বুলডোজারের দাপট সংবাদমাধ্যমে প্রচার পেয়েছিল। ভালো কথা।

খারাপ কথা হলো যখন বুলডোজারের মতো, তবে সশরীর খোদ বুলডোজার ব্যবহার না করে প্রতিষ্ঠান ভাঙা হয়। প্রতিষ্ঠান ভাঙার কাজ চালু হয়েছে বেশ কয়েক বছর ধরে। এখন ভাঙা বা ধ্বংসপ্রায় প্রতিষ্ঠানের তালিকায় সবচেয়ে প্রথমে কোনটি আসবে, তা নিয়ে খুব বেশি বিতর্ক হবে না, যদি বলি তালিকার শীর্ষ অবস্থানে আছে আমাদের নির্বাচন কমিশন। এই মুল্লুকে ব্রিটিশ আমলে স্থানীয় সরকার দিয়ে নির্বাচন শুরু হয়েছিল। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের অল্প কথায় খুব সুন্দর ইতিহাস আছে কুদরতে ইলাহী পনীর বনাম বাংলাদেশ (৪৪ ডিএলআর) মামলায় বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের রায়ে। আমাদের নির্বাচনের ইতিহাস কমবেশি এক শ বছরের। এই ইতিহাস মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনো দেশে আছে বলে চোখে পড়েনি।

তবে সেটা তো ইতিহাস। বর্তমান ভিন্ন। এখন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে না। সামনের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে বহু প্রার্থী ওয়াক-ওভার পাবেন। নির্বাচন কমিশন বারবার বলবে, কেউ প্রার্থী হতে না চাইলে, ভোটাররা ভোট দিতে না এলে আমরা কী করব। ভাঙা নৌকায় উঠতে না চাইলে সেটা তো মাঝির দোষ না। তবে নৌকা ভাঙা হয়ে গেছে। কমিশনার ও কর্মকর্তারা বেতন-ভাতাদি ভোগ করবেন, সে কারণেই আমাদের নির্বাচন কমিশন থাকবে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন এবং এই গোছের আরও কিছু কমিশন তৈরি করা হয়েছিল। নিশ্চয়ই ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বুলডোজার ছাড়াই।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জায়গাজমি প্রচুর। বেশ কয়েকটির আয়তন হাজার বিঘারও বেশি, তাই সহজে নদীগর্ভে বিলীন হবে না। সম্ভবত ড্রেজার দিয়েও কাজ হবে না। বুলডোজার, এক্সকাভেটর ইত্যাদি প্রয়োগ করে ভাঙতে সময় লেগে যাবে প্রচুর। তার থেকেও অনেক সোজা পথ হলো বেছে বেছে জুতসই উপাচার্য নিয়োগ করা। গত কয়েক বছরে সরকার সেই কাজটি করেছে চরম দক্ষতার সঙ্গে। ধ্বংস-দক্ষতা ও অক্ষমতার একটা অনুকরণীয় উদাহরণ রেখে গেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুস সোবহান নামীয় এক উপাচার্য। তিনি তাঁর মেয়াদের শেষ দিনে নিয়োগ দিয়ে গেছেন এক শ একচল্লিশ জনকে। তাঁর কন্যা ও জামাইকে নিয়োগের কাজটি সেরে ফেলেছিলেন আগেই। এবার ছাত্রলীগের জয়জয়কার (দ্রষ্টব্য: ৭ মের প্রথম আলো, প্রথম পৃষ্ঠা)। জেনেছি, একই ব্যক্তি দুই টার্মের বেশি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হতে পারেন না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সোবহান সাহেবের দুই টার্ম হয়ে গেছে, তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তো এখন আছে আরও এগারো গন্ডা। সরকারের কাছে সুপারিশ করছি, অন্য কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে তাঁকে আবার নিয়োগ দেওয়া হোক।

গোটা দশেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে ইদানীং অভিযোগ, অনুসন্ধান, তদন্ত ও সুপারিশ হয়েছে। হোয়াট ইজ টু কাকস, ইফ বেল পাকস; অর্থাৎ বেল পাকলে কাকের কী? তদন্ত যা হওয়ার হবে, সুপারিশমালাও তৈরি হবে এবং তথাস্তু। দেখতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধ্বংস হচ্ছে কি না। কাজটি অবশ্য প্রশংসনীয়ভাবে এগোচ্ছে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় আমরা শামিল হতে পারব না আগামী সিকি শতাব্দীতেও। মধ্যযুগের তৈমুর লং, চেঙ্গিস খান ইত্যাদির সুনাম আছে ভিন ভিন দেশের বিদ্যাপীঠ, পাঠাগার জ্বালিয়ে–পুড়িয়ে ছারখার করার। বর্তমান যুগে আমরা সেই কাজটি করছি বুলডোজার, এক্সকাভেটর আর ড্রেজার ছাড়াই।

করোনা মহামারি মোকাবিলায় আমদানি করা শতকোটি টাকার অতি জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জামাদি পড়ে ছিল বিমানবন্দরে প্রায় বছরখানেক ধরে। প্রথম আলোর এ–সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর মন্ত্রণালয় না অধিদপ্তর, কার যেন দিবানিদ্রা ভঙ্গ হয়েছিল। তবে বছরখানেক বিমানবন্দরে কালযাপনের পর এই সরঞ্জামাদির হালহকিকত সম্পর্কে এখন নিশ্চয়ই অনুসন্ধান হবে, তারপর তদন্ত এবং সবশেষে যথারীতি সুপারিশমালা।

টিকা কয়টি আছে, আসবে কি আসবে না, পাব কি পাব না, বানাব না আমদানি করব, চীন না রাশিয়া, না ভারত না যুক্তরাষ্ট্র, ইত্যাদি ইত্যাদি। সকালে সেতুমন্ত্রীর এক বয়ান, বিকেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, মাঝেমধ্যে হয়তো তথ্যমন্ত্রী এবং ঘোড়া রেসের শেষ ঘোড়ার মতো স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তার সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছেন প্রাইভেট কোম্পানির কিছু হর্তাকর্তাও। সরকারকে নসিহত করছেন ভারতের সঙ্গে টিকা নিয়ে দেনদরবার করতে হবে। খুঁটির জোর থাকলে আমরাও অনায়াসে এই ধরনের উপদেশ বিতরণ করতে পারতাম।

সম্পূর্ণ লেজেগোবরে অবস্থা। তবে এটা মোটামুটি স্পষ্ট যে আমরা জুন মাসের প্রথম থেকেই ভারতীয় গোছের করোনাভাইরাসের সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউয়ের সাক্ষাৎ পাব। অবশ্য এতে সরকার ছাড়াও আমাদের অর্থাৎ জনগণের অবদান খাটো করে দেখার উপায় নেই। রমজানের শেষ শুক্রবারের জুমাতুল বিদার উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। কথিত উচ্চ মধ্যবিত্ত এলাকার অর্থাৎ ধানমন্ডি, বনানী, গুলশানের মসজিদগুলোর বাইরের মাঠেও উপস্থিতি ছিল ঈর্ষণীয়। ধরে নিচ্ছি, এসব এলাকার কথিত উচ্চবিত্ত ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় দীক্ষিত পুরুষেরা তৃতীয় ঢেউয়ের ব্যাপারে তাঁদের অবদান নিশ্চিত করতে ছিলেন বদ্ধপরিকর।

১৯, ২০, ২১ ফেব্রুয়ারির পর্যটন বিপ্লব যেভাবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউকে সাদরে বরণ করা নিশ্চিত করেছিল, ঠিক সেভাবেই আমরা এখন ঈদের কেনাকাটা ও গ্রামে ভ্রমণ করে তৃতীয় ঢেউ অবধারিত করে ফেলছি। সরকার অবশ্যই তার অবদানও জোরেশোরে নিশ্চিত করেছে। লকডাউন বলতে বিশ্বের সচেতন দেশগুলো যে ধারণা প্রবর্তন করেছিল, তা আমাদের সরকার সগর্বে পাল্টে দিয়েছে। কলকারখানা খোলা; দোকান বন্ধ-খোলা; ৫টা, ৮টা, ৯টা এবং অতি শিগগির মাঝরাত; রিকশা, সিএনজি, গাড়ি চলবে তবে গণপরিবহন বন্ধ; তারপর সব চলবে। অফিস খোলা না বন্ধ, সেটা এখনো ঠাহর করতে পারছি না, তবে আদালত বন্ধ। এই গোঁজামিলের দুনিয়ায় স্বাস্থ্যসেবা ধ্বংস করতে বুলডোজারের কোনো প্রয়োজন নেই।

জুন মাসের শুরু থেকে স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থার যা কিছু অবশিষ্ট আছে, সেটাও নির্ঘাত ভেঙে পড়বে। শেষ মুহূর্তে এসে অবশ্যই আশা করছি যে তৃতীয় ঢেউ আসবে না, করোনার সুনামিতে আমরা ভেসে যাব না। তবে একটা প্রস্তুতি নিতে খুব বেশি কর্মযজ্ঞের প্রয়োজন হয়তো হবে না, এখন থেকেই কবর খোঁড়া আর কাফনের কাপড় জোগাড় করা।

দীর্ঘদিন করোনার অতিমারিতে নিঃসন্দেহে আমরা হতাশায় ভুগছি। ভারতের করোনা সুনামি এবং ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে রোগী ও তাঁদের আত্মীয়স্বজনের কান্না ও হাহাকার এবং সেই দেশের সরকারের নির্বুদ্ধিতাজনিত সৃষ্ট হাজার হাজার মৃত্যু আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। নিকট অতীতে সেই দেশের সরকার তাদের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের মত্ত উল্লাসে মেতে ওঠেনি। তাদের ভুলভ্রান্তিও প্রচুর, কিন্তু আমাদের বুলডোজার, এক্সকাভেটর আর ড্রেজার প্রয়োগের পারদর্শিতা অতি উচ্চ মানের। আমরা মেনেই নিয়েছি যে এ দেশে আইনের প্রয়োগ নির্ভর করে ব্যক্তির রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর। মেনে নিয়েছি দুর্নীতি, অদক্ষতা ও তেল মারা। অনেক রাজনীতিবিদের প্রায়ই সম্পূর্ণ বাস্তবতাবিবর্জিত উচ্চারণ ভেঙে গেছে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য।

প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়লে সমাজ কি দাঁড়িয়ে থাকবে?

ড. শাহদীন মালিক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক