প্রধানমন্ত্রী, প্রবীণদের নিয়ে আপনাকে ভাবতেই হবে

এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। ফাইল ছবি
এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। ফাইল ছবি

ভারতে এক সমীক্ষায় তারা বলেছেন ৬০ বছরের উর্দ্ধে তাদের জনসংখ্যা শতকরা ১৯ ভাগ। যেহেতু ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ূ কিছু বেশি সেহেতু বাংলাদেশের ষাটোর্দ্ধ জনসংখ্যা ২০ ভাগ হওয়া স্বাভাবিক। অর্থ্যাৎ আমাদের দেশের ৫ ভাগের ১ ভাগ মানুষ জ্যেষ্ঠ নাগরিক। সমাজ এবং সরকারকে এদের জন্য ভাবতেই হবে।

প্রবীণদের অবদান সমাজ ও রাষ্ট্রে কতটা তা আমাদের ভাবতে হবে। আসলে না রাষ্ট্র, না সমাজ এ ব্যাপারে তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারে। পেছন ফিরে তাকালে দেখবেন এরা একটি পরিবার গড়েছেন অন্তত: ২০ থেকে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত, যখন তাদের বয়স ছিল, ভালো স্বাস্থ্য ছিল, তাদের চোখে স্বপ্ন ছিল, সন্তান-সন্ততি গড়ে তুলেছেন, প্রাণপণ পরিশ্রম করেছেন, সমাজ ও রাষ্ট্রের অগ্রগতিতে অবদান রেখেছেন।

প্রবীণদের সমস্যা:

মানুষ যেকোনো সময় রোগাক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু ৬০ পার হলেই তাদের কতগুলো মারাত্বক ব্যাধি আক্রমণ করতে পারে। যেমন: ডায়াবেটিসের বিভিন্ন জটিলতা, হৃদরোগ, মস্তিষ্ক, কিডনী ও লিভারের জটিলতা, নার্ভের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, অর্ধাঙ্গ রোগ। এগুলো বয়স্কদের মধ্যে কম বয়সের তুলনায় ১৫/২০ গুণ বেশি। অথচ তাদের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য। একদিকে ওষুধের দাম অন্যদিকে পথ্যের দুর্মূল্য এবং মাঝে মাঝে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং বার বার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়ার খরচ, সবমিলে বৃদ্ধদের চরম দুরাবস্থা।

বৃদ্ধদের প্রায়ই একাকীত্বের অভিশাপে ভূগতে হয়। প্রায়ই জীবনসঙ্গী একজন আগেই চলে যান এবং ছেলে-মেয়ে তাদের ভবিষ্যতের অনুসন্ধানে দেশে বা বিদেশে কাজ করতে বাধ্য হয়। একাকীত্বের সঙ্গে যুক্ত হয় বিষণœতা, যার জন্য চিকিৎসা দরকার। এই সমস্যাগুলোর সমাধান মোটেই সহজ নয়। কিন্তু উন্নতদেশগুলোতে সমাজ ও রাষ্ট্র এই দায়িত্ব নেয়। আমরা তো উন্নত দেশের দিকে দ্রত এগিয়ে যাচ্ছি, তা হলে আমরা এ দায়িত্ব নেব না কেনো?

ভারতে ব্যক্তিগত আয়করের ব্যাপারে ৩টি শ্রেণী বিভাগ করা হয়েছে:

এক) উপার্জনশীল তরুণ থেকে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত। তাদের এক ধরণের কর দিতে হয়, যেটা রাষ্ট্র নির্ধারণ করে। এরা প্রায়ই রোগমুক্ত, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং তাদের কর্মক্ষমতা এবং উপার্জন সবচাইতে বেশি। সুতরাং তাদের কর বেশি দিতে হবে।

দুই) যাদের বয়স ৬০ থেকে ৮০, এদের বলা হয় সিনিয়র সিটিজেন বা জ্যেষ্ঠ নাগরিক। তাদের কর্মক্ষমতা কমে যায়। প্রায়ই একাকী, নিসঙ্গ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত, দুর্বল অথচ তারাই সমাজে সব থেকে বেশি অবদান রেখেছেন কিছুদিন আগে পর্যন্ত। তখন তাদের বাড়তি খরচ, ওষুধ, পথ্য, ডাক্তারের ভিজিট এবং হাসপাতালে ভর্তি হলে তার জন্য বিরাট খরচ। এ সব বাস্তবতা বিবেচনা করে ভারত সরকার তাদের অনেক কর মওকুফ করেছেন।

তিন) ৮০ বছর বয়সের উর্দ্ধে: তাদেরকে তৃতীয় গ্রæপে ধরা হয়েছে। যাদের বলা হয় সুপার সিনিয়র সিটিজেন বা অতি জ্যেষ্ঠ নাগরিক। এদের সমস্যা আরো বেশি, এরা আরো রুগ্ণ, আরো বিষণœ। অথচ তাদের অনেককেই জীবন সংগ্রামের জন্য কাজ করতে হয়। এই বিবেচনায় ভারত সরকার তাদের সবচাইতে বেশি কর অবকাশ দিয়েছেন।

আমরা কি করতে পারি?

অন্য দেশের যা কিছু ভালো তা অনুসরণ করতে কোনো লজ্জা নেই। ভালো জিনিসকেই তো অনুসরণ করতে হয়। জ্যেষ্ঠ নাগরিক এবং অতি জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের করারোপের ব্যাপারে সামাজিক সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে ভারত সরকার যে সহানুভূতিশীল এবং দায়িত্বশীল পদক্ষেপ নিয়েছে, আমাদের বাজেটে যদি তার প্রতিফলন ঘটানো যায়, তা হলে সেটা হবে সত্যিকারের সমাজবান্ধব ও দায়িত্বশীলতার পরিচয়। বিশেষ করে জ্যেষ্ঠ ও অতি জ্যেষ্ঠ পেশাদার নাগরিকদের কথা আমাদের স্মরণ রাখা উচিত। এই ক্যাটাগরির শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, আইনজ্ঞ, শিল্পী, প্রকৌশলীসহ পেশাজীবীদের কথা অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে। যৌবনে এবং পরবর্ত্তী পর্যায়ে দিনের পর দিন সমাজ ও রাষ্ট্রকে তাঁরা যা দিয়েছেন জীবন হেমন্তে তার প্রতিদান কি তারা আশা করতে পারেন না? জীবনের পড়ন্ত বেলায় সরকার তাঁদের বাকি জীবনটাকে সহজ ও সুন্দর করার জন্য জাতীয় বাজেটে শতকরা ২০ জন মানুষের স্বপক্ষে একটা নতুন ধরণের অবস্থান নিতে পারেন না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী?

লেখক: অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি