প্রবীণ সমাচার

প্রবীণত্ব তথা বার্ধক্য সম্পর্কে বিশ্বের তাবৎ জ্ঞানী-গুণী বহুবিধ সরস (স+রস) মন্তব্য করে গেছেন। এ স্থলে আমরা মাত্র তিনটি উদ্ধৃত করব: ১. গালিভারস ট্রাভেলস খ্যাত আইরিশ লেখক জনাথন সুইফট বলেছেন, ‘সবাই দীর্ঘ জীবন পেতে চায়, কিন্তু কেউই বুড়ো হতে চায় না। ২. অপর স্বনামখ্যাত ইংরেজ লেখক অস্কার ওয়াইল্ড বলেছেন, বৃদ্ধ বয়সীরা সবকিছুই বিশ্বাস করেন, মধ্যবয়সী লোকেরা সবকিছুতেই সন্দেহ পোষণ করেন, আর অল্পবয়সী লোকেরা সবই জানেন। ৩. তবে আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সবচেয়ে সুন্দর কথাটি বলেছেন, তিনি বলেছেন, ‘যৌবনের শেষে শুভ্র শরৎকালের ন্যায় একটি গভীর প্রশান্ত প্রগাঢ় সুন্দর সময় আসে, যখন জীবনের ফল ফলিবার এবং শস্য পাকিবার সময়।’

সে যা-ই হোক। অনেকগুলো বছর আগে পত্রিকান্তরে ‘বয়সের বিবর্তন’ শীর্ষক রম্য নিবন্ধে লিখেছিলাম, আপনি যে বুড়িয়ে গেছেন, সেটা উপলব্ধির তিনটি চিহ্ন হচ্ছে: যখন ১. সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে ওপরে না উঠে লিফটের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকবেন; ২. পানিতে ঝাঁপিয়ে না পড়ে তীরে বসে থাকতে ইচ্ছে করবে; ৩. আর পরদিন শরীর খারাপ হওয়ার ভয়ে রাতের মজাদার পার্টি ছেড়ে চলে আসবেন। জীবনে ৭৪টি শীত-বসন্ত অতিক্রম করে এসে এক্ষণে মনে হচ্ছে, ওগুলোর সঙ্গে তিনটি অনায়াসে যোগ করা যেতে পারে: যখন ১. আপনি সিট থেকে উঠে কোনো নারীকে বসতে দিতে ইচ্ছুক, অথচ উঠতে পারছেন না; ২. বিয়ের মজলিশে কিংবা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে গিয়ে ওয়াশরুমের খোঁজ করতে আপনিই প্রথম; এবং ৩. আপনি মাংসের টুকরায় কামড় দিতে গিয়ে দেখেন যে আপনার নকল দাঁত বেরিয়ে এসেছে।

আর চুল পাকা ছাড়াও অপর যে তিনটি জিনিস বাহ্যিকভাবে ইঙ্গিত দেয় আপনি বুড়ো হয়ে গেছেন, সেগুলো হচ্ছে প্রথম, কানে কম শোনা; দ্বিতীয়, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, আর তৃতীয়টি কী, সেটা স্মরণ করতে পারছি না। তো কানে কম শোনা প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল জনৈক বৃদ্ধ ভদ্রলোক অনেক দিন যাবৎ কানে খুব কম শুনছিলেন। চিকিৎসক কর্তৃক তাঁর কানে একটি ছোট্ট প্রায় অদৃশ্য শোনার যন্ত্র সংযোজনের পর তিনি ভালো শুনতে লাগলেন। এক মাস পর চিকিৎসক তাঁকে উদ্দেশ করে ‘আপনার পরিবারের সবাই এতে নিশ্চয়ই উৎফুল্লিত’ বলায় তিনি বললেন, ‘আমি এখনো তাদের বলিনি এবং তারা জানে না যে আমি এখন শুনতে পাই। তাই তাদের কথাবার্তা শুনে বিগত এক মাসে আমার উইল তিনবার পরিবর্তন করেছি।’

তা স্মরণশক্তি কমে যাওয়া নিয়েও মজার গল্প আছে: স্মরণশক্তির সমস্যাহেতু চিকিৎসক বৃদ্ধ দম্পতিকে কাগজ-কলমের সাহায্য নিতে বলেছেন। তো একদিন সন্ধ্যায় বুড়ো-বুড়ি টিভি দেখছিলেন; হঠাৎ স্বামী স্ত্রীকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘পাকঘরের ফ্রিজ থেকে আমার জন্য আইসক্রিম ও সঙ্গে কিছু স্ট্রবেরি নিয়ে এসো, প্লিজ। লিখে নাও, নতুবা তুমি ভুলে যাবে।’ ‘এই সামান্য জিনিস আনতে নিশ্চয়ই ভুল হবে না,’ স্ত্রী পাকঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর তিনি এক বাটি স্যুপ নিয়ে এসে হাজির হলে স্বামী নিস্পৃহ কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আমি তো ডিম ওমলেট চেয়েছিলাম।’

আমাদের রাজধানীতে দীর্ঘদিন সরকারের খেদমত করে অবসরে যাওয়া বুড়ো-বুড়িদের কল্যাণের জন্য অবসর ভবন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, আর ভবনটির প্রবেশপথে পাথরে খোদাই করে যথার্থই লেখা হয়েছে; প্রবীণদের সম্মান করুন। প্রবীণেরা সমাজের বোঝা নহে; পরিবার, সমাজ ও জাতির বাতিঘর। কিন্তু প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে প্রবীণেরা চিকিৎসা ও যানবাহনে যাতায়াত ইত্যাদি বিষয়ে বেশ কিছু সুবিধা ভোগ করে থাকেন। মালয়েশিয়ায় গেলাম, সেখান থেকে ট্রেনে সিঙ্গাপুরে যাওয়ার বেলায় পাসপোর্টে আমার বয়স দেখেই কনসেশন টিকিট দিয়ে দিল। আমাদের দেশে এমনটা ঘটবে কবে? কখন? কোথায়?

মার্কিন মুলুকে প্রবীণদের বুড়ো কিংবা বুড়ি বলা যাবে না, এটা ইতিপূর্বেই বলেছি। কিন্তু তাই বলে ওদেশে বুড়ো-বুড়িদের নিয়ে হাস্যরসাত্মক গল্পের কমতি নেই। এবারের তিন মাসের সফরে লব্ধ এমন অনেকগুলো গল্প থেকে বাছাই করে এতৎপরবর্তী তিনটি গল্প পরিশেষে পরিবেশন করছি—

এক. বিপত্নীক বুড়ো ও বিধবা বুড়ি বহুদিন যাবৎ ডেটিং করছিলেন। তো এক সন্ধ্যায় সাহস সঞ্চয় করে বুড়ো বিয়ের প্রস্তাব করতেই বুড়ি রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে বুড়ো কিছুতেই স্মরণ করতে পারছিলেন না তাঁর প্রস্তাবে বুড়ি কী জবাব দিয়েছিলেন। খানিকক্ষণ ইতস্তত করার পর তিনি বুড়িকে টেলিফোন করে বললেন, ‘এটা খুবই লজ্জার ব্যাপার যে গত রাতে আমার বিয়ের প্রস্তাবের জবাবে তোমার উত্তর কী ছিল, তা আমি কিছুতেই স্মরণ করতে পারছি না।’

‘তুমি মাকে বাঁচালে’, বুড়ি প্রত্যুত্তরে বললেন, ‘আমার স্মরণ আছে, গত রাতে কেউ একজনের বিয়ের প্রস্তাবে আমি “হ্যাঁ” বলেছিলাম; কিন্তু সে কে, সেটা স্মরণ করতে পারছিলাম না।’

দুই. তিনজন সিনিয়র সিটিজেন চিকিৎসকের চেম্বারে স্মরণশক্তির পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। ‘দুই দুগুণে কত হয়?’ চিকিৎসক একজনকে প্রশ্ন করতেই উত্তর এল, ১৭৭। একই প্রশ্ন দ্বিতীয়জনকে করলে পর এবার জবাব এল, বুধবার। চিকিৎসক তখন তৃতীয়জনের দিকে তাকিয়ে। প্রশ্ন করলেন, ‘দুই দুগুণে কত হয়?’ এবারে সঠিক উত্তর মিলল, চার।

‘চমৎকার! আপনি কী করে সঠিক উত্তর খুঁজে পেলেন? চিকিৎসক কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করাতে বুড়ো জবাবে বললেন, ‘আমি বুধবার থেকে ১৭৭ বিয়োগ করেছি।’

তিন. একজন লোকের বয়স ১০০ বছর। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো তাঁর এত দীর্ঘ জীবনপ্রাপ্তির কারণ কী, তখন তিনি বলতে লাগলেন, ‘দেখুন, আমার বিয়ে হয়েছিল ২৫ বছর বয়সে এবং বিয়ের প্রথম রাতেই বউয়ের সঙ্গে এই মর্মে বোঝাপড়া হয়েছিল যে স্বামী-স্ত্রীতে তর্কাতর্কি তো লাগবেই, যে তর্কে হারবে, সে রাগ প্রশমিত করার উদ্দেশ্যে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে বাড়িসংলগ্ন মাঠে মুক্ত বাতাস সেবন করবে।’

অতঃপর তিনি সহাস্যে বললেন, ‘আমি যে বিগত ৭৫ বছর বাইরে বাইরে থেকেছি ও মুক্ত বাতাস সেবন করেছি, তজ্জন্য আমার আয়ু বেড়ে গিয়েছে। হা হা হা!

পুনশ্চ: আমরা বুড়ো হওয়ার জন্য হাসাহাসি বন্ধ করি না, প্রায়ই হাসাহাসি বন্ধ করার জন্য বুড়ো হয়ে যাই।

আতাউর রহমান: রম্যলেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷