প্রবীণের সম্মান প্রতিষ্ঠায় গোটা সমাজ সম্মানিত হয়

জীবনের পথপরিক্রমায় নবীন ও প্রবীণ বয়স দুটি মঞ্জিল মাত্র। সব মানুষকেই এই মঞ্জিল অতিক্রম করতে হবে। কোরআন মাজিদে উভয় মঞ্জিলের স্বরূপ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন দুর্বল অবস্থায়, দুর্বলতার পর তিনি দেন শক্তি, শক্তির পর আবার দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং তিনিই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।’ (সুরা-৩০ রুম, আয়াত: ৫৪)।

শৈশবে মানুষ দুর্বল থাকে, বার্ধক্যেও দুর্বলতার দিকেই ফিরে আসে। বার্ধক্যপীড়িত মানুষের প্রতি যত্নবান ও সহানুভূতিশীল হওয়া আল্লাহর বিধান।

শুদ্ধাচার ও শিষ্টাচার মানবজীবনের অলংকার। গর্ব, অহমিকা ও দুরাচার কলঙ্ক ও অন্ধকার। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা আমল করে নাও এসবের পূর্বেই—ওই দারিদ্র্য যা আত্মবিস্মৃত করে দেয়, ওই প্রাচুর্য যা দাম্ভিক করে তোলে, ওই রোগ-ব্যাধি যা জরাগ্রস্ত করে ফেলে, ওই বার্ধক্য যা বুদ্ধিহীন করে ছাড়ে।’ (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ২৩০৬)।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, ‘তোমরা পাঁচটি জিনিসের পূর্বে পাঁচটি জিনিসের মূল্যায়ন করো। যৌবনকে বার্ধক্যের আগে, অবসরকে ব্যস্ততার আগে, সুস্থতাকে অসুস্থতার আগে, সচ্ছলতাকে দারিদ্র্যের আগে এবং জীবনকে মৃত্যুর আগে।’ (তিরমিজি ও আবুদাউদ)।

উন্নত ও সুশীল সমাজ গঠনে প্রয়োজন পরিবারব্যবস্থা ও সৌজন্যবোধ, আদব-আখলাক, তাহজিব-তমদ্দুন, শিক্ষা-সংস্কৃতি। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে বলেন, ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন, তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত না করতে ও পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তাঁদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাঁদের উফ বলো না এবং তাঁদের ধমক দিও না; তাঁদের সঙ্গে সম্মানসূচক কথা বলো। মমতাবশে তাঁদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত করো এবং বলো, “হে আমার প্রতিপালক! তাঁদের প্রতি দয়া করো যেভাবে শৈশবে তাঁরা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।”’ (সুরা-১৭ বনি ইসরাইল, আয়াত: ২৩-২৪)।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মা-বাবার সঙ্গে সদাচারের একটি দিক হলো মা-বাবার বন্ধুস্থানীয় ও সমবয়সীদের সঙ্গে সদাচার ও সুসম্পর্ক রাখা।’ (মুসলিম শরিফ, পঞ্চম খণ্ড)। বলা বাহুল্য, এটা নবীন ও প্রবীণের মধ্যে সুসম্পর্ক ও সদাচারের এক অতুলনীয় ব্যবস্থা।

ছোট ও বড়, অনুজ ও অগ্রজ, এর বাইরে কেউ নেই; কিছুই নেই। এটি হতে পারে সময়ের ব্যবধানে, হতে পারে শক্তি, সম্মানে ও অবস্থানে বা পদমর্যাদায়। সবাই সহযাত্রী হয়ে নির্বিঘ্নে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ছোট ও বড় একে অন্যের সাহায্য–সহযোগিতা প্রয়োজন। তাই নিজেদের স্বার্থেই আমাদের সবার উচিত বড়কে সম্মান করা ও ছোটকে স্নেহ করা। এতে সুরক্ষিত হবে জীবনের শৃঙ্খলা। এই একটিমাত্র সূত্র অনুসরণ করলেই জীবন ও জগতের বহু জটিল সমস্যা এমনি এমনিই সমাধান হয়ে যায়। মানবতার মহান শিক্ষক প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘যে ছোটকে স্নেহ করে না এবং বড়কে সম্মান করে না; সে আমার উম্মত না।’ (আবুদাউদ ও তিরমিজি)। আসুন আমরা নবীজির সুন্নাতে জীবনকে সাজাই স্নেহ, মায়া, মমতা, প্রীতি, অনুরাগ, অনুকম্পা, দয়া, করুণা, প্রেম, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে।

আমাদের জীবনের সব প্রাপ্তি, সফলতা ও সার্থকতা আল্লাহর অনুগ্রহ ও কর্মের প্রতিফল।

তওবা, ক্ষমা, কর্তব্য সম্পাদনই মুক্তির পথ। কে কী করেছে, সেদিকে না তাকিয়ে আমাকে আমার দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। কোরআনের বাণী, ‘তোমরা তোমাদের কর্মফল ভোগ করবে, আমি আমার কর্মফল লাভ করব।’ (সুরা-১০৯ কাফিরুন, আয়াত: ৬)।

পিতা-মাতার জীবদ্দশায় সন্তানের দায়িত্ব হলো তাঁদের সম্মান ও শ্রদ্ধা করা, মহব্বত করা বা ভালোবাসা, মান্য করা বা আনুগত্য করা, খিদমত বা সেবাযত্ন করা, সামর্থ্য অনুপাতে সুখ–স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করা, প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করা, সম্ভব হলে কাছে থাকা অথবা মাঝেমধ্যে দেখা–সাক্ষাৎ করা।

মাতা-পিতার মৃত্যুর পর সন্তানের কর্তব্য হলো তাঁদের ঋণ থাকলে পরিশোধ করা ও আমানত থাকলে প্রত্যর্পণ করা, বৈধ অছিয়ত থাকলে তা পূর্ণ করা, নাজাতের জন্য দোয়া করা, দান-খয়রাত ও ইবাদতের মাধ্যমে ইসালে সওয়াব বা সওয়াব রেসানি করা, তাঁদের বন্ধুবান্ধব ও নিকট স্বজনদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা এবং সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য–সহযোগিতা করা এবং তাঁদের কবর জিয়ারত করা।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব

[email protected]