প্রশাসকের হাতে আছে আর পাঁচ মাস

মাত্র ছয় মাসের জন্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব পেয়েছেন খোরশেদ আলম ওরফে সুজন। কোভিডের কারণে পূর্বঘোষিত সময়ে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন না হওয়ায় সাবেক ও ভবিষ্যৎ মেয়রের মাঝখানে শূন্যস্থান পূরণের এই দায়িত্ব পেলেন তিনি। আওয়ামী লীগের তৃণমূলের এই নেতা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। দলের দুর্দিনে আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন সরব। নাগরিক দুর্ভোগ নিরসনের দাবিতে সৃজনশীল কর্মসূচি দিয়েও আলোচিত হয়েছিলেন। মহিউদ্দিন আহমদ ও আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি অংশ বাকশাল গঠন করলে খোরশেদ আলম সেই দলে যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বাকশালের ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতিও হন।

বাকশালপর্ব শেষ হলে আবার আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। কিন্তু বছর কয়েকের সেই বাঁকবদল দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনে। দলের শীর্ষ পর্যায়ে তাঁর যোগ্যতা নিয়ে সংশয় না থাকলেও, আনুগত্য নিয়ে সন্দেহের নিরসন বোধ হয় কখনো হয়নি। নইলে দলে নবাগতরা (ইদানীং ‘হাইব্রিড’ শব্দটি বহুল প্রচলিত) সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেলেও তিনি বারবার বঞ্চিত হবেন কেন? এমনকি সরকারি সংস্থাগুলোতেও তাঁর কোনো পদ জোটেনি। প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে মহানগর কমিটিতে সহসভাপতি হতে পারাটাই ছিল এত দিন পর্যন্ত তাঁর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। এসব দিক বিবেচনা করলে সিটি করপোরেশনের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া একধরনের চমকই বটে। আর যা–ই হোক, দলীয় হাইকমান্ডের দৃষ্টিসীমায় তো এলেন। এটা হয়তো একধরনের পরীক্ষাও। কিন্তু নিজেকে প্রমাণ করার জন্য সময়টা বড় কম পেলেন তিনি।

খোরশেদ আলম প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়েই করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম-দুর্নীতি বিষয়ে সতর্ক করেছেন। বলেছেন এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। তবে তিনি থাকবেন মাত্র ছয় মাস, ফলে তাঁর সতর্কতা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কতটা আমলে নেবেন, তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। সম্ভবত খোরশেদ আলম সেটা বুঝেই শুরুতেই রাজস্ব ও পরিচ্ছন্নতা বিভাগে ব্যাপক রদবদল করেছেন। একযোগে বদলি করেছেন ৪৬ ওয়ার্ড সচিবকে। এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, এই সচিবেরা দীর্ঘদিন একই জায়গায় কর্মরত ছিলেন, অনেকে নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন। কাজে গতিশীলতা আনার জন্যই এই বদলি।

তিনি অনিয়ম–দুর্নীতি রোধেও বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছেন। সিটি করপোরেশনের সাত শতাধিক গাড়ি ও ৩৬টি জেনারেটরের জন্য তেল কেনার ক্ষেত্রে চুরির ঘটনা প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছিল। এ ব্যাপারে কর্মচারী বরখাস্তসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। সরকারি মালিকানাধীন মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের পরিবর্তে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তেল কেনার স্বল্প মেয়াদি চুক্তি করে প্রকৃত চাহিদার চিত্রটিও বুঝতে চেয়েছেন। সিটি করপোরেশন পরিচালিত আইসোলেশন সেন্টারের কেনাকাটায় অনিয়ম খতিয়ে দেখতে কমিটি গঠন করেছেন। পরিচ্ছন্নতা বিভাগে কর্মী নিয়োগ নিয়েও তদন্ত কমিটি হয়েছে।

আ জ ম নাছির মেয়র থাকাকালে বিলবোর্ড উচ্ছেদ করে এবং নগরের সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্যোগ নিয়ে প্রশংসিত হয়েছিলেন। কিন্তু সুযোগসন্ধানীদের নগদ লাভের খপ্পরে পড়লে এসব উদ্যোগও কখন কীভাবে জনস্বার্থ পরিপন্থী হয়ে ওঠে, তার কিছু নমুনা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। প্রশাসক বলেছেন, তিনি এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। করপোরেশনের আইন ও এস্টেট বিভাগকে এ বিষয়ে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের মেয়াদ শেষ হয়েছে বলে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য তাঁদের দায়িত্ব তিন উপসচিবকে ভাগ করে দিয়েছেন প্রশাসক। পছন্দসই ও যোগ্য লোকদের নিয়ে একটি পরিষদ গঠন করার সুযোগ তাঁর ছিল। কিন্তু নিজে তিনি মাঠের মানুষ হয়েও আমলানির্ভর হয়ে পড়লেন কেন, এটা নিশ্চয়ই প্রশ্নসাপেক্ষ। তা ছাড়া ৪১টি ওয়ার্ডের কাজ মাত্র তিনজন কর্মকর্তার মাধ্যমে সম্পন্ন করা কতটা সম্ভব, সে প্রশ্নও উঠতে পারে। সম্ভবত দলীয় গ্রুপিং থেকে নিজেকে দূরে রাখার কৌশল হিসেবেই পরিষদ গঠনের পরিবর্তে এই আমলানির্ভরতা। চট্টগ্রামে এখনো প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী ও সদ্য সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সমর্থকদের মধ্যে উপদলীয় কোন্দল তীব্র। পরিষদ গঠন করলে তার সদস্য সংখ্যায় কোন পক্ষের পাল্লা ভারী হলো এ নিয়ে কথা উঠত নিঃসন্দেহে। এর আঁচ থেকে নিজেকে রক্ষা করলেন কৌশলে, এখন আমলাদের নিয়ে কাজ কতটা করিয়ে নিতে পারেন, সেটাই দেখার বিষয়।

দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ নিয়ে প্রশংসিত হয়েছেন খোরশেদ আলম। প্রশাসনের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও আপাতদৃষ্টিতে সফল বলা যাচ্ছে তাঁকে। কিন্তু নাগরিক সেবা, যা সিটি করপোরেশনের প্রধান কাজ, তাতে এখনো দৃশ্যমান উন্নতি দেখা যায়নি। নাগরিক সমস্যা চিহ্নিত করে তার সমাধানের জন্য ‘নগরসেবায় ক্যারাভান’ নামের একটি কর্মসূচি শুরু করেছেন। নিজে মোটরসাইকেলে চেপে সপ্তাহে অন্তত এক দিন নগরের বিভিন্ন অঞ্চল সরেজমিন পরিদর্শন করে, এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে তঁাদের ছোটখাটো সমস্যা তাত্ক্ষণিক সমাধানের চেষ্টা করছেন। এসব উদ্যোগে চমক আছে বলে যথেষ্ট প্রচার পাচ্ছে। কিন্তু এর কোনোটাই বড় ও স্থায়ী কাজ নয়।

নগরের ১৭০ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা বেহাল। খানাখন্দগুলোতে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা হলেও তীব্র বর্ষণে তা আবারও মুখব্যাদান করে আছে। আগ্রাবাদ এক্সেস রোড ও পোর্ট কানেকটিং রোডের অবস্থা বছরের পর বছর অপরিবর্তিত। সামনে শুষ্ক মৌসুম আসছে। এই সময়টা প্রশাসকের স্বল্প মেয়াদে দীর্ঘ সাফল্য হিসেবে প্রমাণের সুযোগ। এই সময়ের মধ্যে সড়ক সংস্কারকাজ সম্পন্ন করে ভোগান্তি থেকে রেহাই দিলে নগরবাসী তাঁকে মনে রাখবে। জলাবদ্ধতা নিরসনের নানা প্রকল্প চলছে। স্বল্প মেয়াদে এ নিয়ে অবশ্য খুব বেশি কিছু করার সুযোগ নেই।

খোরশেদ আলমের দায়িত্বভার গ্রহণের (৬ আগস্ট) এক মাস পূর্ণ হলো আজ। এর মধ্যে তাঁর সরব উপস্থিতি আমরা দেখেছি সংবাদমাধ্যমে। হাতে আছে আর মাত্র পাঁচ মাস। এবার হাতে-কলমে প্রমাণ দেওয়ার পালা।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক

[email protected]