প্রসবঘরটি কেমন হবে

প্রসব শব্দটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত হলেও মনে হয় ব্যাপারটি অত্যন্ত গোপনীয়। সহজ কথাটি সহজ করে কেউ বলতে চায় না অথবা এর প্রয়োজনীয়তাও উপলব্ধি করতে চায় না। বাংলাদেশে এখনো ৬২ শতাংশ প্রসবঘরেই হয়ে থাকে। ৩৮ শতাংশ হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে (সরকারি-বেসরকারি একেবারে তৃণমূল থেকে সবচেয়ে নামীদামি প্রতিষ্ঠানে)।
যেখানেই হোক না কেন—আমরা কখনোই কেমন জায়গায় একজন মা প্রসব করবেন, সেদিকে তেমন দৃষ্টি দিইনি অথবা এটিকে চিন্তা করার মতো বিষয় মনে করিনি। এ কারণে সেই আদিকাল থেকে ঘরে যখন প্রসব হয়, তখন সবচেয়ে নিকৃষ্ট অথবা গোপনীয় অন্ধকার জায়গাটিই বেছে নেওয়া হয়। অথচ এটা গোপনীয় ব্যাপার নয়, তবে সেটি হবে স্বাভাবিক পর্দার অন্তরালে। মা ও শিশুর সব রকম নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও পরিষ্কার জায়গাটি প্রসবের জন্য বাছাই করতে হবে। এ ব্যাপারে পরিবারপ্রধান ও যিনি প্রসব করাবেন, তাঁর উচিত আগে থেকেই অভিজ্ঞ ধাত্রী অথবা বর্তমানে সারা দেশে যারা কমিউনিটি স্কিল বার্থ অ্যাটেনডেন্ট আছেন, তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করে সঠিক জায়গাটি নির্বাচন করা। পরিবারের সবারই এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহায়তা করা উচিত।
যেমন গর্ভাবস্থার প্রথম মাস থেকেই পরিবারের ছোট-বড় সবারই উচিত, তাঁর খাবার, বিশ্রাম ও স্বাভাবিক সব প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রাখা। তাঁকে দিনে দুই ঘণ্টা বিশ্রাম বা ঘুমাতে দিতে হবে। সবাই যা খাবেন, তাকে তার চেয়ে একটু বেশি খেতে দিতে হবে—যেমন সবাই এক টুকরো করে মাছ খাচ্ছেন, সেখানে তাঁকে দুই টুকরো মাছ খেতে দেবেন, তাকে ভারী কাজ করতে দেবেন না। নিজেদের সবার রক্তের গ্রুপ জানবেন এবং প্রসূতি মায়ের রক্তের রিপোর্টের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে রাখবেন।
যদি বাড়ির বাইরে প্রতিষ্ঠানে প্রসব করানো হয়, তাহলে সেটি আগেই ঠিক করে রাখতে হবে। রাত-বিরাতে তাঁকে কীভাবে নেওয়া হবে, সে ব্যাপারটি পারিবারিকভাবেই আগে থেকে ঠিক রাখবেন। আর প্রসব যদি বাড়িতে করাতে হয়, তাহলে বাড়ির সবার সঙ্গে আলোচনা করে মা ও শিশুর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাটি ঠিক করতে হবে, যেটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও আলো-বাতাসপূর্ণ হবে। তাঁর নিজের শোয়ার ঘরেও একটি নিচু খাটে তাঁর প্রসবের আয়োজন করা যেতে পারে অথবা যেখানে খাট নেই, সেখানে পরিষ্কার মাদুর পেতে তার মধ্যেই করানো যেতে পারে। তবে ‘সেফটি কিট’ ও প্রয়োজনীয় যেসব জিনিস লাগবে, সেগুলো আগে থেকেই সেই ঘরে ঠিক করে রাখতে হবে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ যেন না হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধটি প্রসবকালে মায়ের আঁচলে বেঁধে রাখতে হবে।
কথা হচ্ছে, আমরা সবাই চাই প্রসব বাড়ির বাইরে হাসপাতাল অথবা ইউনিয়ন পর্যায়ে করানো হোক। কিন্তু এই মুহূর্তেই সেটি সম্ভব হচ্ছে না, কাজেই বাড়ির কথাটি আগেই বললাম। এবারে আসি প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে—ইউনিয়ন, থানা, জেলা ও হাসপাতালগুলোয় লেবার রুম বলে যে জায়গাটি আছে, বর্তমানে তার দিকে তাকাই। সব জায়গায় একই ব্যবস্থা নেই। কিন্তু সব জায়গায় একটি নির্দিষ্ট ঘর বা কক্ষ অবশ্যই থাকবে, সেটি আলো-বাতাসপূর্ণ লেবার রুম বা প্রসবকক্ষ হিসেবে নির্দিষ্ট থাকবে। এ রকম কক্ষ এখনো সব জায়গায় আছে, কিন্তু সেগুলোর মান ভালো নয়। প্রসূতি মায়েদের প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারির উৎসাহ দিতে হলে ‘লেবার রুমটি একটি নিরাপদ জায়গা’ ও সেটি ‘প্রসূতিবান্ধব’—এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
ঘরের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ যা-ই হোক না কেন, প্রতিটি লেবার রুমে ন্যূনতম দুটি টেবিল থাকতে হবে। কমপক্ষে একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার, একটি সাকার মেশিন, বাচ্চার হৃৎস্পন্দন শোনার জন্য ডপলার (প্রতিষ্ঠানগুলোতে সিটিজি) মেশিন থাকতে হবে। মায়ের শারীরিক অবস্থার জন্য একটি পালস অক্সি মিটারও রাখা প্রয়োজন। রুম-সংলগ্ন বাথরুম, স্নানাগার থাকা অবশ্যই বাঞ্ছনীয়। একটি আলমারিতে একলামশিয়া কিট, পিপিএইচ কিট, অক্সিটোসিন, জীবনরক্ষাকারী দ্রুত দেওয়ার জন্য কিছু ড্রাগস (Hydocortison/Saline/I/V Set/Blood Set/ Ambubag (বাচ্চা ও মা দুজনের জন্যই) রাখতে হবে। ব্যথা প্রশমনের জন্য ইনজেকশন অথবা এনটোনোক্স রাখা প্রয়োজন। সব সময়ই কমপক্ষে দুটি ডেলিভারি কিট হাতের কাছে রাখতে হবে। বর্তমানে সরকার যে মিডওয়াইফ নিয়োগ দিচ্ছে, নার্সিং কাউন্সিল দয়া করে তাঁদের যদি লেবার রুম ইনচার্জ করে দেন, তাহলে তাঁকে প্রসবকক্ষের জন্য স্থায়ীভাবে দেওয়া যাবে। এ ব্যাপারে সরকার, নার্সিং পরিচালক, মিডওয়াইফারি দপ্তর, নার্সিং রেজিস্ট্রারসহ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
জন্মের পরপরই যেন শিশুটি মায়ের বুকে যেতে পারে এবং দুধ খেতে পারে, সে ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রসবকালে কোনো জটিলতার জন্য মায়ের যদি অপারেশনের দরকার হয়, তবে দ্রুত প্রেরণের ব্যবস্থা রাখতে হবে, যেমন তৃণমূলে কোথায় যাবে, তাদের মোবাইল নম্বর ও বাহন রাখতে হবে, এটি আগে থেকেই ঠিক রাখা প্রয়োজন। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোতে সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টার মধ্যেই যেন অপারেশন করা যায়, সে জন্য নীতিমালা থাকতে হবে। সব জিনিসই আমাদের আছে, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না—যেমন ঢাকা মেডিকেল কলেজে লেবার ওয়ার্ড, লেবার রুম, এমনকি মহিলাদের মেডিকেল ওয়ার্ডও সবচেয়ে করুণ অবস্থার মধ্যে আছে।
আমরা জানি জায়গার তুলনায় রোগীর চাপ অনেক বেশি, তবু প্রসবকালে ও প্রসব-পরবর্তী সময়ে তাঁরা একটু নিশ্চিন্ত জায়গা পাবেন, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা কী বাঞ্ছনীয় নয়? ঢাকা মেডিকেল কলেজে মেডিসিন বিভাগের জন্য বিশাল একটি ভবন করে দেওয়া হয়েছে, সেখানে ছাত্রদের পড়ানোর ব্যবস্থাসহ গবেষণার কাজও করা যায়। আর সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই যেন ‘প্রসূতি কক্ষ’ (লেবার রুম) দ্রুত তৈরি করা হয়।
অধ্যাপক (ডা.) রওশন আরা বেগম: বিভাগীয় প্রধান (প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগ), হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।