প্রস্তাবিত শৃঙ্খলাবিধি কতটা সংবিধানসম্মত?

দীর্ঘ টানাপোড়েন শেষে সরকার ১১ ডিসেম্বর অধস্তন আদালতের দেড় হাজারের বেশি বিচারকের জন্য যে শৃঙ্খলাবিধি তৈরি করেছে, সে জন্য প্রথমেই সরকারকে ধন্যবাদ দিই। তারা একটা অচলাবস্থার অবসান করেছে। এখন আমরা পুনরায় পথচলা শুরু করতে পারব।

সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা শৃঙ্খলাবিধিতে কতিপয় বিধান যুক্ত করতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন, এটা সত্যি। তাঁর সঙ্গে অল্পসংখ্যক বিচারকের বদলি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলাবিধান নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিরোধ দেখা দিয়েছিল। সেসব বিষয়ে সরকারের যুক্তির একদম ভিত্তি ছিল না, তা বলব না। কিন্তু বিচারপতি সিনহা এককভাবে খসড়া শৃঙ্খলাবিধি করেননি। তিনি ছিলেন বলেই বিরোধ ছিল, নেই বলেই মিটেছে, এটাও সত্য নয়। আপিল বিভাগের ‘সর্বসম্মতভাবে’ ঘোষিত কোনো রায় বা সিদ্ধান্তকে একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত চিন্তার প্রতিফলন হিসেবে দাবি করা আপিল বিভাগের প্রতি কোনো সম্মাননা নয়। সমাজে এর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য।

শৃঙ্খলাবিধি তৈরির কাজটি ১৮ বছর আগে করার কথা ছিল। এই সময়ে সরকারগুলো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছে অধস্তন আদালতের বিচারকেরা সরকারি কর্মচারীর চেয়ে আলাদা কিছু নন। প্রসঙ্গত, এ ক্ষেত্রে বিএনপির নেতিবাচক ভূমিকার কোনো তুলনা হবে না, কারণ তারা মাসদার মামলার রায় বানচাল করতে মেয়াদজুড়ে পদ্ধতিগত ঘৃণ্য চেষ্টা চালিয়েছিল। সেই দলটি ১১ ডিসেম্বর জারি করা শৃঙ্খলাবিধির যে সমালোচনা করছে, তা তাদের মুখে মানায় না।

তবে জনমনে যদি ধারণা জন্মায়, ১১ ডিসেম্বরের শৃঙ্খলাবিধিই নিয়তি, তাহলে সমূহ সর্বনাশ। যা বেশি উদ্বেগজনক তা হলো বাকশাল গঠনের পর ও জিয়ার সামরিক ফরমানে তৈরি হওয়া ‘দ্বৈত শাসন’ মেনেই মাসদার মামলায় যে ১২ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, সরকারগুলো তা-ও মানতে চাইছে না।

সুপ্রিম কোর্টের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠনের সম্ভাবনা ইতিমধ্যে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাব সৃষ্টির চেষ্টা আগের চেয়ে প্রবল হয়েছে। পৃথক্করণ নয়, মনে হচ্ছে এটা আরও সংযুক্তিকরণের পথে যাচ্ছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট বার কিংবা বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস সমিতি, যারা মাসদার মামলার বাদী, তারা এ ক্ষেত্রে কার্যকর কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না। তাই সচেতন অংশের সামাজিক লড়াইটাই ভরসা।

গত ১৮ বছরে ১২ দফার কতটা পূরণ হয়েছে, তা দেখা যাক। এক. সাধারণ জনপ্রশাসনের সঙ্গে বিচার ক্যাডারকে মেশানো যাবে না। বাস্তবে এটা মিশে আছে। বিচারকদের জন্য সংবিধানে চারটি (১১৪-১১৬ক) ও সরকারি কর্মচারীদের জন্য ছয়টি (১৩৩-১৩৬) অনুচ্ছেদ আছে। কিন্তু যখন প্রজ্ঞাপন জারি করা হলো তখন রাষ্ট্রপতি শুধু ১৩৩ অনুচ্ছদে প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করলেন। অথচ ‘দ্বৈত শাসন’ মেনেও মাসদার রায় ১৩৩ ও ১৩৬ অনুচ্ছেদ বিচারকদের জন্য প্রযোজ্য নয় বলেছিল। প্রস্তাবিত প্রজ্ঞাপনটি তাই সংবিধানের সঙ্গে সংঘাত তৈরি করেছে। ১১৫ অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘প্রণীত বিধিসমূহ’ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারক নিয়োগ দেবেন। আর ১৩৩ অনুচ্ছেদ বলেছে, সংবিধানের বিধানাবলি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ ও তাঁদের কর্মের শর্তাবলি নিয়ন্ত্রণ করবেন। প্রস্তাবিত প্রজ্ঞাপন তাই বিচারকদের ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে কর্মচারী’ হিসেবে দেখেছে। এটা তাই ১১৫, ১১৬ ও ১১৬ক অনুচ্ছেদবিরোধী। মাসদারের রায় বলেছে, তেলে-জলে মেশে না, সেভাবে বিচারকদের সরকারি কর্মচারী বানানো যাবে না। কারণ, বিচারকেরা প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌম বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন।

দুই. বিচারক নিয়োগ করবে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন। এটা হয়েছে। বরখাস্ত ও অপসারণে পৃথক রুল থাকবে। এটা সবে প্রস্তাব করা হলো। আপিল বিভাগ এখন এটা খতিয়ে দেখবে। আমরা ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, যিনি মাসদার হোসেন মামলার মুখ্য আইনজীবী এবং মাসদার হোসেনের সঙ্গে একত্রে বসে আলাপ-আলোচনা করেছি। আমীর-উল ইসলাম একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বললেন, ১০৯ অনুচ্ছেদে ‘হাইকোর্ট বিভাগ’কে (এখন ৮৫ বিচারক) বিচারকদের ‘তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ’ ক্ষমতা দিয়েছে। ১১৬ অনুচ্ছেদ ‘সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ’ করতে বলেছে। কিন্তু আমরা গণমাধ্যমে জানলাম, শুধু দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আইনমন্ত্রীর আলাপ হয়েছে। আমরা (মাসদার হোসেনসহ) তাঁর সঙ্গে একমত, এতে ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদের শর্ত পূরণ হয়নি। বঙ্গভবন বা সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে কোনো বিবৃতি দেননি। সংবিধানের ৯৪ অনুচ্ছেদ বলেছে, প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট গঠিত। প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য। কর্মে প্রবীণতম অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি। তাহলে ওই আলোচনায় আপিল বিভাগ এবং ৮৫ বিচারপতি নিয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের অংশগ্রহণ দেখি না। ঐতিহ্যগতভাবে হাইকোর্ট বিভাগ ‘ফুলকোর্ট’ পরিচয়ে বিচারকদের শৃঙ্খলা বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়ে আসছেন।

তিন. বিসিএস (বিচার) ক্যাডার বিলুপ্ত করতে হবে। এর বাস্তবায়ন ঘটেছে। চার. জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন হবে। এটা হয়েছে। কিন্তু প্রেষণব্যবস্থা বন্ধ হয়নি। সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পদে প্রেষণে বিচারকেরা চাকরি করছেন। মাসদার রায়ের মূল লেখক বিচারপতি মোস্তাফা কামাল আমাকে বলেছিলেন, একটি আলাদা আইন কর্মকর্তা ক্যাডার করে প্রেষণ বিলুপ্ত করতে হবে। ওই ক্যাডার করার কথা কেউ মুখেও আনছেন না। এখন প্রস্তাব করা হয়েছে, বিচারকেরা প্রেষণে অর্থাৎ ‘সরকারি পদে’ থাকতে তাঁদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নেবেন না। বিচারকদের বদলি ও শৃঙ্খলাবিষয়ক সব ধরনের কাজের মূল মাধ্যম হলেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল (আরও এক ডজন বিচারক প্রেষণে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনে আছেন) ও আইনসচিব (আরও এক ডজনের বেশি বিচারক মন্ত্রণালয়ে আছেন)। তাঁরা কর্মরত জ্যেষ্ঠ জেলা জজ। এখন নয়া শৃঙ্খলাবিধির শর্ত হলো তাঁরাসহ প্রেষণে থাকা প্রত্যেক বিচারকের জবাবদিহি প্রধানমন্ত্রীর কাছে থাকবে। এই বিধান বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পরিপন্থী। এ ব্যবস্থার আমরা বিলোপ চাই। প্রেষণ বিষয়ে আমীর-উল ইসলামের দায়ের করা একটি রিটে রুল জারি হয়ে পড়ে আছে। এর আশু শুনানি কাম্য।

পাঁচ. শৃঙ্খলাসহ কর্মক্ষেত্রের সব শর্ত (বরখাস্ত ও অপসারণ ছাড়া), যা অন্যদের ক্ষেত্রে ১৩৩ অনুচ্ছেদের আওতায় আছে, তা সব ১১৬ ও ১৬৬ক-এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করতে হবে। বিচারকদের ‘সাংবিধানিক মর্যাদা’ অটুট থাকবে। বাস্তবে তাতে বিরাট ঘাটতি চলছিল। প্রস্তাবিত প্রজ্ঞাপন সেই ঘাটতি আরও গভীর করবে। আগেই বলেছি, ১৩৩ অনুচ্ছেদের আওতায় শৃঙ্খলাবিধি করে তাদের মর্যাদা সাংবিধানিক নয়, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী করা হয়েছে। এ জন্য শুধু আইন মন্ত্রণালয়কে দুষব না, এর পেছনে রয়েছে সেই অদৃশ্য আমলাতন্ত্র, যারা বাহাত্তরের সংবিধানের ‘ক্রান্তিকালীন বিধানাবলিতে’ লিখিয়ে নিয়েছিল, বিচারক নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানি কায়দায় চলবে। ২০১১ সালে যা তারা আবার নবায়ন করে নিয়েছে। এটা সেই ক্ষমতাধর আমলাতন্ত্র, যারা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স মামলার রায় বাস্তবায়ন করতে চায় না। সচিবের স্তরে জ্যেষ্ঠ জেলা জজদের উন্নীত করে আমরা চূড়ান্ত রায় পেলাম। কিন্তু রিভিউর নামে সরকার তা ঝুলিয়ে রেখেছে। এর দ্রুত ফয়সালা হোক।

ছয়. পে কমিশন করতে হবে এবং পে কমিশনের সুপারিশ মানতে হবে। পে কমিশন করাও আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব। মাসদার মামলার রায় মেনে বর্তমান সরকার জ্যেষ্ঠ জেলা জজদের বেতন স্কেল সচিবদের সমান করেছে। সরকারের এই পদক্ষেপ প্রশংসাযোগ্য।

সাত. নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারের সঙ্গে বিরোধ হলে সব সময় সুপ্রিম কোর্টের মত ‘প্রাধান্য’ পাবে। কিন্তু তা হরহামেশা লঙ্ঘনের অভিযোগ ছিল। এ জন্য পরামর্শ মানতে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের খসড়ায় সময় নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। আশা করব, মাসদার মামলার আইনজীবীরা এই একটি বিধি সংশোধনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবেন। আপিল বিভাগের অনুমোদিত খসড়া বিধিতে বলা ছিল, যেকোনো পরামর্শ সাত দিনের মধ্যে তামিল না হলে তা সুপ্রিম কোর্টকে জানাতে, ১৫ দিনের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করে সুপ্রিম কোর্টকে চিঠি দিতে, আর তাতে ব্যর্থ হলে তা শাস্তিযোগ্য অদক্ষতা বলে গণ্য হবে। এটি পুরো বিলোপ করে বরং লেখা হয়েছে, সরকার সময়সীমা ‘যথাসম্ভব’ অনুসরণ করবে। সময়সীমা প্রশ্নে যদি সরকার ও সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ অভিন্ন না হয়, তাহলে সুপ্রিম কোর্টের মত প্রাধান্য পাবে। ২৮ বিধিতে ‘যথাসম্ভব’ কথাটির বৈধতা নেওয়ার পর ২৯ বিধিতে ‘প্রাধান্য’ দেওয়ার বিধান সাংঘর্ষিক বটে।

আট. কর্মস্থলে বিচারকের মেয়াদ ঠিক থাকবে। তাঁদের বেতনসহ অন্যান্য ভাতার নিরাপত্তা থাকবে। সংসদ ও সরকারের সঙ্গে আদালত-ব্যবস্থার সম্পর্ক থাকবে না, বরং প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে। নয়া বিধি পরতে পরতে প্রাতিষ্ঠানিক পরাধীনতার রক্ষাকবচ তৈরি করেছে। নয়. সরকারের ওপর সুপ্রিম কোর্টের খাতওয়ারি বাজেট খরচে নির্ভরতা থাকবে না। শেখ হাসিনার প্রথম সরকার প্রশংসনীয়ভাবে এর বাস্তবায়ন ঘটালেও বাস্তবে মেডিকেল ব্যয়ের মতো খরচ অনুমোদনে প্রধানমন্ত্রীর তহবিলের মুখাপেক্ষিতা রয়ে গেছে। দশ. বিচারকদের বিষয় প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে বিচার্য হবে। এটা কার্যকর হয়েছে। এগারো. পৃথক্করণকে ‘অধিকতর অর্থপূর্ণ, সুস্পষ্ট, কার্যকর ও সম্পূর্ণ’ করতে সংবিধান সংশোধন করা সংসদ সদিচ্ছা দেখাবে। কিন্তু সংসদ তা করেনি।

বারো. অন্যান্য ক্যাডারের মতো বিচারকেরাও সমান আর্থিক সুবিধা পাবেন। এর লঙ্ঘন ঘটছে। শ্রেণি হিসেবে বিচারকেরা অবিচারের শিকার। সচিবেরা ৩ হাজার টাকার গৃহপরিচারিকা ভাতা পেতেন, সেটা জেলা জজরা পেতেন না। সেই ভাতা ৩২ হাজার টাকায় উন্নীত হলেও জেলা জজদের জন্য কিছুই করা হয়নি। যুগ্ম সচিবের ওপরের স্কেলে থাকা যুগ্ম ও অতিরিক্ত জজরা দেখছিলেন যুগ্ম সচিবরা গাড়িঋণ পান। তাঁরা পান না। ইদানীং তাঁরা দেখছেন, উপসচিবরাও গাড়ি কিনতে ৩০ লাখ টাকা ও মাসে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বাবদ ৫০ হাজার টাকা পান। তাঁরা তথৈবচ। এই বৈষম্য বিষয়ে হাইকোর্ট গত সপ্তাহে রুল জারি করেছেন।

আমীর-উল ইসলাম জানাচ্ছেন, প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগ কোনো ধরনের প্রশাসনিক কাজ করুন, সেটা বঙ্গবন্ধু চাননি। তাঁরা সেই যুক্তি মেনেছেন। সুতরাং অধস্তন আদালতের তদারকিতে প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের ভূমিকা লুপ্ত হওয়া দরকার। ১০৯ অনুচ্ছেদই পাক্কা, সব রকম নিয়ন্ত্রণ শুধুই হাইকোর্ট করবেন। এ জন্য হাইকোর্ট বিভাগের একটি সচিবালয় থাকবে। প্রধান বিচারপতিকে যথাসম্ভব বাইরে রেখে হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারকেরা একটি সমষ্টিগত নেতৃত্ব দেবেন। এ ধারণা আলোচনার দাবি রাখে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]