প্রাণ-প্রাচুর্যের সন্ধানে

জানুয়ারির শেষ দিকে ঢাকায় শীতের ছিটেফোঁটাও নেই। কিন্তু গত বছরের ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখ রাতে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া স্টেশনে নেমে মনে হলো, শীত তখনো বিদায় নেয়নি। ভাগ্যিস জ্যাকেট সঙ্গেই ছিল। শাহবাজপুর চা-বাগানে পৌঁছানোর পর মনে হলো, শীত আরও খানিকটা বেড়েছে। রাতে ঘুমানোর আগেই পরের দিনের কর্মসূচি ঠিক হলো। পরিকল্পনা অনুযায়ী পরদিন সকালে দ্রুত বেরিয়ে পড়ি। চা-বাগানের দুটি টিলা জরিপ করে গাছপালার একটি তালিকা তৈরি করাই আমাদের মূল কাজ। এই টিলা দুটি মোটামুটি সংরক্ষিত। বাগান কর্তৃপক্ষ জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখার জন্য এখানে চাষবাস না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। এমন একটি শুভ উদ্যোগ নেওয়ায় তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ। সকালে দেখা হলো বাগানের মহাব্যবস্থাপকের সঙ্গে। সংক্ষিপ্ত আলাপচারিতার পর আমরা বিদায় নিলাম। তবে আমাদের সঙ্গী হলেন বাগানের উপব্যবস্থাপক। ছয়জনের দলটি এগিয়ে চলল টিলার দিকে।
তিন একর আয়তনের এই টিলা বিচিত্র গাছপালা, লতাগুল্ম আর তৃণরাজিতে পরিপূর্ণ। টিলার এক প্রান্ত থেকে আমাদের তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হলো। পথ তৈরি করার জন্য বাগানের একজন সুদক্ষ কর্মীও সঙ্গী হলেন। তিনি গাছপালা ভালোই চেনেন। আমরা যখন একটি গাছ চেনার চেষ্টা করছি, তখন তিনি বলেন, ‘এইটা বনাক। আঞ্চলিক নাম।’ বুঝতে অসুবিধা হলো না, এটা আসলে মাকড়িশাল। টিলাজুড়ে এই গাছের রাজত্ব। ঢাকায় মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে আছে একটি। আরেকটি গাছ রমনা পার্কে লাগিয়েছেন নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা। গত ২০ বছরে কত বনজঙ্গল ঘুরেছি, কিন্তু অল্প পরিসরে এত বৃক্ষবৈচিত্র্য খুব কমই দেখেছি। এখানকার প্রতিটি গাছই বুনো। এ কারণে সমতলের সঙ্গে গড়নের দিক থেকে কিছুটা ভিন্নতাও রয়েছে।

>সবকিছু মিলিয়ে আমাদের সংগ্রহ দাঁড়াল দেড় শ প্রজাতির মতো। তবে এতে তৃণ, বিরুৎ, বর্ষজীবীগুলো রাখা হয়নি। সত্যি, এমন ছোট্ট দুটি টিলায় এত উদ্ভিদবৈচিত্র্য আমাদের ধারণাতীত!

টিলার প্রায় মাঝামাঝি স্থানে পেলাম দুর্লভ মাধবীলতা। বুনো পরিবেশে এই প্রথম মাধবীলতার দেখা পেলাম। ভেবেছিলাম প্রকৃতিতে আর কখনো মাধবীলতা দেখতে পাব না। খুবই আনন্দ হলো। বুনো জলপাই, চালতা, লটকন, আমলকী, ডেফল, বহেড়া, জারুল, ডুমুর সমতল থেকে একেবারেই আলাদা। গাছে দু-একটা ফল দেখে জংলি কুল শনাক্ত করা গেল। উদাল, ঝুমকাভাদি, মাটাং, বনশিমুল দেখে বেশ চমৎকৃত হলাম। মোটা কাণ্ডের কয়েকটি কুমারীলতাও চোখে পড়ল। টিলাভর্তি লতাচালতা আর বুনো জুঁইয়ের ঝাড়। লতাচালতা বলধা গার্ডেনের সাইকিতেও আছে। টিলার ঢালে কোথাও কোথাও মাটি খুঁড়ে বেশ গভীর গর্ত বানানো হয়েছে। আলাপ করে জানা গেল, স্থানীয় লোকজন এখান থেকে আলু সংগ্রহ করেছেন। এত্ত বড় আলু! প্রকৃতিতে কত কিছুই না ঘটছে। ধীরে ধীরে আমাদের সংগ্রহের ঝুলি পূর্ণ হতে থাকল। শেষ প্রান্তে ঢালে এসে পেলাম জংলি পান আর ড্রাসিনা। এত দিন ভেবেছি, ড্রাসিনা বিদেশি গাছ। প্রথমে বিশ্বাস করতেই কষ্ট হলো এটা ড্রাসিনা। সঙ্গীদের জিজ্ঞেস করি, এখানে কি কখনো কেউ গাছ লাগিয়েছে? তাঁরা বললেন, না, এখানকার সবই বুনো। প্রাকৃতিকভাবেই জন্মেছে। তাহলে আর কি, ভুল ভাঙল, ড্রাসিনা এই অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছ। গাছটি অবশ্য তার প্রাণশক্তি ও নান্দনিকতার গুণে এখন সবার ঘরে পৌঁছে গেছে।
টিলার এমাথা–ওমাথাজুড়ে স্পষ্ট একটি সরু ক্যানেলের মতো। কোথাও গভীর, কোথাও অগভীর। ভেবেছিলাম জলসেচ বা অন্য কোনো প্রয়োজনে করা হয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই খটকা লাগল। এমন একটি প্রাকৃতিক টিলায় জলসেচের প্রয়োজনীয়তাই বা কী! পরে জানা গেল, এটা আসলে একটি পরিখা। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা মিত্রবাহিনীর মোকাবিলার জন্য তৈরি করেছিল। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিও ধারণ করছে টিলাটি। পরদিন একইভাবে দুই একর আয়তনের পাশের টিলায়ও জরিপ চালানো হলো। দুই টিলার মাঝখানে পেলাম বেশ বড় আকারের একটি দুলিচাঁপা। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের সংগ্রহ দাঁড়াল দেড় শ প্রজাতির মতো। তবে এতে তৃণ, বিরুৎ, বর্ষজীবীগুলো রাখা হয়নি। সত্যি, এমন ছোট্ট দুটি টিলায় এত উদ্ভিদবৈচিত্র্য আমাদের ধারণাতীত! এ কারণেই হিমালয়সহ এ অঞ্চলের ব্রিটিশ উদ্ভিদ সমীক্ষক জে ডি হুকার খাসিয়া পাহাড়ের উদ্ভিদবৈচিত্র্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁর বিখ্যাত হিমালয়ান জার্নাল-এ লিখেছেন ‘খাসিয়া পাহাড়ের গাছগাছালির বিস্তারিত বিবরণ লেখার অবকাশ এখানে নেই; কেননা, এগুলোর সংখ্যা ও বৈচিত্র্য এতই অধিক যে কেবল ভারত কেন, সম্ভবত গোটা এশিয়ায়ও এমন দ্বিতীয়টি আর নেই।’ (হিমালয়ের উদ্ভিদরাজ্যে ড্যাল্টন হুকার, দ্বিজেন শর্মা, পৃ.৮৯)
দুপুরের দিকে আমরা বেরিয়ে পড়ি পাথারিয়া পাহাড়লাগোয়া আরেকটি টিলার উদ্ভিদ সমীক্ষায়। দূরত্ব খুব বেশি নয়। টিলাটি অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত। পাহাড়ের নিকটবর্তী পথ ক্রমেই সরু ও দুর্গম হয়ে উঠল। পথের ধারে অসংখ্য রামবাসক ফুটেছে। প্রাকৃতিকভাবে রামবাসকের এত ফুল আগে কখনো দেখিনি। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামার পথেই একটি দুলিচাঁপা স্বাগত জানাল। পাশেই ঢাকি জামের গাছ। টিলার ঢালে সুদর্শন কালিকোরা ফল। কিছু গাছ অচেনা মনে হলো। একটি গাছ দেখতে অনেকটা বিলাতি গাবের মতো, কিন্তু কিছু বৈসাদৃশ্যও আছে। শেষ পর্যন্ত চেনা গেল না। ঘুরতে ঘুরতে পেয়ে গেলাম ঢাকার দুই দুলিচাঁপার মা-গাছদের। একটি সুবিশাল। আশপাশে দু-একটা ছানাপোনাও আছে। অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা আমাদের একমাত্র বুনো ম্যাগনোলিয়ার সন্ধান এখানেই পেয়েছেন। এই টিলাও মাকড়িশালের স্বর্গরাজ্য। গাছপালার এতই ঘনত্ব যে পড়ন্ত বিকেলেই যেন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এল। অল্প আলোয় গাছ চেনা এবং ছবি তোলা দুটিই প্রায় অসম্ভব। সেদিনের মতো কাজের সমাপ্তি টেনে আমরা ফিরে চললাম।
মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক। সাধারণ সম্পাদক, তরুপল্লব।
[email protected]