প্রয়োজন প্রথা মানা, 'চাকা পুনরাবিষ্কার' নয়!

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

অষ্টম জাতীয় বেতনকাঠামোয় ‘সময়ের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য’ দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানসহ অধিকাংশ আইন ও বিধিবিধান সংশোধন বা নবায়ন করা হয়। বেতন স্কেলে ‘সংশোধনী’ আনার প্রধান উদ্দেশ্য ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ধারণ করে চাকরিজীবীদের জীবনমান মোটামুটি একই পর্যায়ে রাখা। অবশ্য ‘নবায়ন’ বা ‘সংশোধনীর’ ধারায় নিম্নতম (২০ নম্বর) ও উচ্চতম (১ নম্বর) গ্রেডে বেতনের অনুপাত যথাসম্ভব কমানোর একটা প্রচেষ্টা লক্ষণীয়; এতে নিচের দিকের কর্মচারীদের জীবনমান কিছুটা বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। আর কয়েক বছর পর হঠাৎ বেতন বৃদ্ধির ফলে সব চাকরিজীবীর জীবনমানই সাময়িকভাবে একটু বাড়ার কথা। তবে ১৯৯৭ সালে গৃহীত পঞ্চম জাতীয় বেতন স্কেল থেকে শুরু করে বেতন স্কেল দু–তিন ধাপে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুই বছরে বাস্তবায়ন করা এবং অ্যাডহক ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি ধারণ করার অন্তর্বর্তী ব্যবস্থায় প্রদত্ত ‘মহার্ঘ ভাতা’ বাদ দেওয়ার ফলে বেতন বৃদ্ধি এত কম হয় যে অধিকাংশ চাকরিজীবী জীবনমান বাড়ার সুযোগ কমে শূন্যের কোঠায় নেমে যায়।
অনেকে দাবি করছেন, অষ্টম বেতন স্কেলে প্রথমবারের মতো বেতন ‘দ্বিগুণ’ করা হয়েছে। বিসিএস ক্যাডারগুলোতে প্রারম্ভিক বেতন দেওয়া হয় ২০টি গ্রেডের মধ্যে নবম গ্রেডে। ১৯৭৩ সালে নবম গ্রেডে মূল বেতন ধার্য করা হয়েছিল ১৪৫ টাকা, যা মাত্র চার বছর পর ১৯৭৭ সালে দ্বিতীয় জাতীয় বেতন স্কেলে ৭৫০ টাকায় পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছিল; কত গুণ বেড়েছিল? তৃতীয় স্কেলে ১৯৮৫ সালে একই গ্রেডের বেতন ছিল ১৬৫০ টাকা; এবারও বৃদ্ধি দ্বিগুণের চেয়ে বেশি। তবে ১৯৯১, ১৯৯৭, ২০০৫ এবং ২০০৯ সালে প্রদত্ত চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম স্কেলে বেতন বৃদ্ধির হার দ্বিগুণের চেয়ে কম ছিল। কেউ কেউ বেতন ‘প্রায় দ্বিগুণ’ হবে বলে সরকারি চাকরিজীবীদের কাজের মান অনেক বৃদ্ধি পাওয়ার প্রত্যাশা করছেন।
বেতন বাড়ানো হলে চাকরিজীবীরা বরাবরই খুশি হন। কিন্তু এবার ২৮টি বিসিএস ক্যাডারের মধ্যে ২৬টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা এবং ক্যাডার সার্ভিসের বাইরে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা ও প্রাথমিক-মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকেরা বেতন স্কেল পরিমার্জনের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন। সরকার অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল ১ জুলাই থেকে বাস্তবায়নের জন্য গত ১৫ ডিসেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করার পরও এই আন্দোলন থামছে না; বরং তা নতুনভাবে চাঙা হচ্ছে। বস্তুত বেতন স্কেলটি চাকরিজীবী, এমনকি সরকারের জন্যও এক বিড়ম্বনায় পরিণত হয়েছে। কেন এমন হলো? এবারের স্কেলে দুটি প্রধান পরিবর্তন এর জন্য দায়ী। একটি হচ্ছে চাকরিজীবীদের প্রথাগতভাবে প্রাপ্য সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল রহিত করা; এটি মূল কমিশনেরই প্রস্তাব। অপরটি হচ্ছে গ্রেড-১ এর ওপর দুটি ‘সুপার গ্রেড’ সৃষ্টি; এটি ‘সৃষ্টি’ করেছে কমিশনের প্রস্তাব পর্যালোচনায় নিয়োজিত সচিব কমিটি।
এবারের বেতন কমিশন ১৭ সদস্যবিশিষ্ট। কমিশনের প্রধান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। বেতন কমিশনের সদস্যরা কনভেনশন বা প্রথা ভঙ্গ করে কোন মানের ‘শিল্প’ সৃষ্টি করলেন? গবেষণা ও আবিষ্কার বিষয়ে ‘চাকা পুনরাবিষ্কার’ (Reinventing the wheel) বলে একটি কথা আছে। গবেষণাকর্মে এটি নিষিদ্ধ; কারণ এতে নতুন কিছু আবিষ্কার হয় না; আবিষ্কৃত জিনিসের ডুপ্লিকেশন হয় মাত্র। বেতন কমিশন ‘বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির শতকরা হার’ নামক চাকার সাহায্যে দীর্ঘদিনে আবিষ্কৃত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল প্রতিস্থাপন করতে চেয়েছে।

>প্রশাসন ক্যাডার সব সময়ই অন্যদের চেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত; বর্তমানে একটু বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। গণবান্ধব সরকারকে সব পক্ষের প্রতি সুবিচারী, নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করতে হবে। সরকারের কর্তব্য হবে কনভেনশনাল সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল পুনর্বহাল করা

প্রতিষ্ঠিত প্রথা ভঙ্গ করে কমিশন যে ভুল করেছে, মন্ত্রিপরিষদের বিশেষ কমিটিও কেন তাকে বহাল রাখল? প্রজ্ঞাপন জারির আগে প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটিকে অর্থমন্ত্রী মহোদয় সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল পুনর্বহালের সম্ভাবনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন; এতে ২৬ ক্যাডারের আন্দোলন স্থগিত করা হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বহাল রেখে তাঁদের জন্য পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি হবে জেনে আন্দোলন স্থগিত রেখেছিলেন। এখন নাকি সব কিছু ‘অজ্ঞতাপ্রসূত’! সবার মনে রাখা দরকার, প্রধানত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করে। নতুন জ্ঞান সৃষ্টিকারী এসব প্রতিষ্ঠানের গবেষক-শিক্ষকেরা যদি ‘অজ্ঞ’ হন বা অন্ততপক্ষেÿ বেতন-ভাতা ও নিজেদের সম্মান-অসম্মান সম্পর্কে তাঁদের অজ্ঞতা থাকে, তাহলে ‘বিজ্ঞতা’ কাদের মধ্যে বিদ্যমান? সব ‘বিজ্ঞতা’ কি তাহলে গুটি কয়েক সিনিয়র আমলার মধ্যে সীমিত, যাঁরা জাতীয় অধ্যাপকদের জন্য ‘সুপার গ্রেড-২’ নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল রহিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ২৬টি ক্যাডারের অধিকাংশ এবং নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আর্থিকভাবে ÿক্ষতিগ্রস্ত হবেন। অনেক ক্ষেত্রে তঁাদের প্রাপ্য পদমর্যাদার নিচে অবস্থান করতে হবে। আগের ব্যাচ পেয়েছে, পরের ব্যাচ আর পাবে না বলেও ব্যাচগুলোর মধ্যে বৈতনিক বৈষম্য সৃষ্টি হবে। সিলেকশন গ্রেড রহিত হলে আন্দোলনরত ২৬ ক্যাডারের অধিকাংশ কর্মকর্তাকে চতুর্থ গ্রেডে চাকরিজীবন শেষ করতে হবে অথচ প্রশাসন ক্যাডারের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি শেষ হবে ১ নম্বর গ্রেডে, কেউ কেউ উঠে যাবেন ১ নম্বর ‘সুপার গ্রেডে’; এতে প্রান্তিক পদে বৈষম্য হবে পাঁচ থেকে সাত গ্রেডের! বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সদস্য হিসেবে আমি প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক উভয় পদে সিলেকশন গ্রেড (যথাক্রমে সপ্তম ও পঞ্চম গ্রেড) পেয়ে দীর্ঘদিন পদোন্নতি বঞ্চনার কষ্ট কিছুটা ভুলে থাকতে পেরেছি। কিন্তু প্যাটার্ন অনুসারে জাতীয়ভাবে পদ সৃষ্টি প্রায় ২০ বছর ধরে ঝুলে থাকার ফলে একই ক্যাডারের কোনো কোনো বিষয়ের এক থেকে নয় ব্যাচ জুনিয়র কর্মকর্তার অধীনে যঁাদের চাকরি করতে হচ্ছে তঁাদের যাতনা অসহনীয়। মূলত ক্যাডারটিকে ‘ডিমরালাইজ’ করে ফেলা হয়েছে।
যাহোক, সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল প্রথা বহাল রাখলে কী কী অসুবিধা হয় কমিশন বা সচিব কমিটি তা আজও খোলাসা করেনি। গত ১২ অক্টোবর ড. ফরাসউদ্দিন জানালেন, টাইম স্কেল পেয়ে কিছু জুনিয়র কর্মকর্তা-কর্মচারী বেতনের দিক দিয়ে সিনিয়রদের ডিঙিয়ে যাচ্ছিলেন। এটি সত্য হলে কমিশনের কর্তব্য ছিল বিধির যে ফাঁকে এটি ঘটত, সে ফাঁক বুজে দেওয়া, বিধানটি রহিত করা
নয়। তিনি বলেছেন, অন্যান্য দেশে বেতন কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রিপরিষদ; কোনো সচিব কমিটি নয়। কারণ, সচিবেরাও অন্যদের মতো একটি বেতনভুক পক্ষ। কোনো নির্দিষ্ট ‘পক্ষ’ অন্য সব পক্ষের ওপর এরূপ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পাওয়া নৈতিক নয়।
প্রশাসন ক্যাডার সব সময়ই অন্যদের চেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত; বর্তমানে একটু বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। বিশেষ সুবিধা পেয়ে সচিব কমিটি নিজ ক্যাডারের পক্ষে কাজ করতেই পারে। হলফ করে বলা যায় না, অন্য কোনো ক্যাডার পর্যালোচনার এরূপ সুযোগ পেলে বেতন স্কেলকে নিজ দলের পক্ষে নিতে চাইত না। কিন্তু গণবান্ধব সরকারকে সব পক্ষের প্রতি সুবিচারী, নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করতে হবে। সরকারের কর্তব্য হবে কনভেনশনাল সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল পুনর্বহাল করে নিজকে ও দেশবাসীকে বেতন স্কেল বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা করা। এতে সব চাকরিজীবীর মধ্যে সংহতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশা করা যায়।
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা, শিক্ষা গবেষক এবং বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সদস্য।
[email protected]