প্রয়োজন ফুরালেই মৃত্যু?

অমিত মুহুরী। ফাইল ছবি।
অমিত মুহুরী। ফাইল ছবি।

কারাগারের ভেতরে এক সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে আরেক সন্ত্রাসী। বলা হচ্ছে, একই সেলে থাকা দুই সন্ত্রাসীর মধ্যে কলহ-বিবাদের সূত্র ধরে এই হত্যাকাণ্ড। এতে কারা কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। কিন্তু সেই প্রশ্ন ছাপিয়ে যে সন্দেহটা বড় হয়ে উঠছে সেটি হলো, এটি কারাভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া কলহ-বিবাদেরই পরিণতি, নাকি বাইরে বসে কোনো গডফাদারের ছক করা পরিকল্পনার বাস্তবায়ন, যাতে খোদ কারাগারের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত এক বা একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরও যোগসাজশ আছে?

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে গত ২৯ মে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী অমিত মুহুরী নিহত হন অপরাধজগতে প্রায় ‘অজ্ঞাতকুলশীল’ একজন রিপন নাথের হাতে। দীর্ঘদিন কারাগারের একই কক্ষে অমিতের সঙ্গে ছিলেন বেলাল নামের এক হাজতি। ঘটনার ঠিক আগের দিন এই কক্ষে ঢোকানো হয় রিপন নাথকে। মাত্র এক দিনের মাথায় এ রকম একজন ভীতিকর প্রতিপক্ষকে হত্যা করার সাহস ও শক্তির উৎস কোথায়, এটা নিশ্চয় ভেবে দেখার মতো বিষয়। একই কক্ষে থাকা বেলালের মতে, রাতে তাঁরা তিনজন পাশাপাশি শুয়ে ছিলেন। হঠাৎ ঘুম ভেঙে বেলাল দেখতে পান, রিপন একটি ইটের টুকরো দিয়ে ঘুমন্ত অমিতকে আঘাত করছেন। বেলালের চিত্কারে সেখানে কারারক্ষীরা ছুটে আসেন। এর আগে তাঁদের মধ্যে কোনো কলহ-বিবাদ হয়েছে কি না, বেলাল জানেন না। জেলা প্রশাসনের তদন্তকারী কর্মকর্তারও একই মত। পুলিশের একজন উপকমিশনারও বলেছেন, অমিত মুহুরীকে ঘুমন্ত অবস্থায় ভাঙা ইট দিয়ে আঘাত করেছেন রিপন নাথ। অর্থাৎ প্রত্যক্ষদর্শী বেলাল, জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের উপকমিশনারের বক্তব্য প্রায় অভিন্ন। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ বলছে অন্য কথা। তাদের মতে, কারাকক্ষে অমিত ও রিপনের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে রিপন ভারী কিছু দিয়ে অমিতকে আঘাত করলে গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়, সেখানেই মৃত্যু হয় তাঁর। এ দুই ধরনের বয়ানের মধ্যে কোনটি যথার্থ, এখনই তা বলা যাচ্ছে না। তবে কারা কর্তৃপক্ষের বক্তব্যে যে সরলীকরণ আছে, তা মেনে নেওয়া একটু কঠিনই। তা ছাড়া ‘ভারী কিছু’ মানে যদি বেলালের সাক্ষ্য অনুযায়ী ভাঙা ইট হয়, তাহলে কারাকক্ষে ‘ইট’ কী করে এল এবং হত্যাকাণ্ডের পর রক্তাক্ত ইটটি কোথায় গেল, সেই প্রশ্নও আসবে।

এ পর্যায়ে নিহত অমিত মুহুরী সম্পর্কে সংক্ষেপে বলা দরকার। পুলিশের চোখে এই অমিত ছিলেন ঠান্ডা মাথার খুনি। অন্তত আধা ডজন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে তাঁর জড়িত থাকার তথ্য আছে পুলিশের কাছে। যুবলীগের নেতা হেলালউদ্দিন চৌধুরীর (বাবর) ডান হাত ছিলেন তিনি।

২০১৩ সালের ২৪ জুন চট্টগ্রামে সিআরবি মোড় এলাকায় রেলওয়ের দরপত্র নিয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে যুবলীগের কর্মী সাজু পালিত ও শিশু আরমান নিহত হয়। এই জোড়া খুনের আসামি ছিলেন অমিত মুহুরী। এর আগে ২০১২ সালে নারীসংক্রান্ত এক ঘটনায় বন্ধু রাসেলকে পিটিয়ে ও ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে আহত করেন অমিত। পরে হাসপাতালে রাসেলের মৃত্যু হয়। অমিতের নৃশংসতার সবচেয়ে বড় শিকার ইমরানুল করিম নামের তাঁর আরেক বন্ধু। নিজের ঘরে এই বন্ধুকে খুন করে একটি ড্রামে ভরে তাতে অ্যাসিড ঢেলে দিয়ে লাশ গলানোর চেষ্টা করেছিলেন অমিত। পরে সেই ড্রাম নগরের একটি দিঘিতে ফেলে দিয়ে আসেন। পরে লাশ উদ্ধার করে সেই হত্যাকাণ্ডের হোতাকে শনাক্ত করতে সমর্থ হয় পুলিশ। এ ছাড়া সিটি কলেজ ছাত্রলীগের নেতা ইয়াছিনকে কুপিয়ে হত্যার অভিযোগও আছে অমিতের বিরুদ্ধে।

অমিতের মৃত্যুর পর হাসপাতালের গেটে আহাজারি করে তাঁর পিতা বলছিলেন, ‘রিপন তো অমিতের বন্ধু ছিল। বন্ধুকে কেন সে হত্যা করল?’ হায় পিতৃহৃদয়! এই অর্বাচীন পিতাকে কে বোঝাবে, অপরাধজগতে স্থায়ী শত্রু-মিত্র বলে কোনো ব্যাপার নেই। থাকলে খোদ তাঁর পুত্র অমিতের হাতেই খুন হতেন না তাঁর একাধিক বন্ধু।

অমিতের বাবা এবং ছোট ভাই (এখন ভারতে থাকেন) জেলখানার ঘটনাকে সাজানো বলে দাবি করেছেন। তাঁরা পক্ষান্তরে আঙুল তুলেছেন তাঁর পূর্বতন ‘গডফাদারে’র দিকে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, অমিত মুহুরীর মৃত্যু যেভাবেই হোক, সাধারণ মানুষের মনে তা স্বস্তি দিয়েছে। পিতার আহাজারি বা ফেসবুকের লাইভে এসে ভাইয়ের ক্ষুব্ধ-শোকার্ত বক্তব্য সামান্য সহানুভূতিও জাগাতে পারেনি সাধারণ নাগরিকের মনে। কারণ, এই সন্ত্রাসীরা বেঁচে থাকলে কোনো না কোনো দিন জামিনে বেরিয়ে এসে আবার হত্যা-সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ে—এমন উদাহরণ বিরল নয়। অপরাধজগতে অমিতের উত্থান যেমন নাটকীয়, পতনও তেমনই অনিবার্য ছিল। এর আগেও অনেক সন্ত্রাসীর এ রকম মৃত্যু থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায়। গডফাদারের কাছে প্রয়োজন ফুরালে বা সম্পর্কে আস্থার সংকট তৈরি হলে সেই সন্ত্রাসীকে সরিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না তারা। অমিতের ক্ষেত্রেও এ রকমই হয়েছে কি না, হলে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কে বা কারা আছেন, তা-ও উদ্‌ঘাটন জরুরি বলে মনে করি আমরা। না হলে এই ‘বড় ভাই’দের হাত ধরে আরও অমিত মুহুরীর উত্থান ঘটবে। বড় অপরাধী থেকে যাবে অধরা।

রিপন নাথের মতো একজন পাতি সন্ত্রাসীর হাতে অমিত মুহুরীর মতো ভয়ংকর সন্ত্রাসীর হত্যাকাণ্ড স্বাভাবিক বলে মনে হয় না। যদিও রিপন বারবার রাগের মাথায় নিজেই খুন করেছেন বলে যাচ্ছেন, কিন্তু সেটি যে শেখানো বুলি নয়, তার বিশ্বাস কী? তাঁকে যেকোনো উপায়ে ছাড়িয়ে আনা হবে এবং ভবিষ্যতে এর জন্য পুরস্কৃত করা হবে বলে আশ্বস্ত করলে তিনি এ রকম বলতেই পারেন। মাত্র আগের দিন তাঁকে এই কক্ষে স্থানান্তর করা হয়েছে বলেই সন্দেহটি দানা বাঁধে। তা ছাড়া কারা কর্তৃপক্ষের আচরণ আগাগোড়া রহস্যজনক। যেমন পত্রিকান্তরের সংবাদ অনুযায়ী, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘নিয়ম অনুযায়ী কারাগারে কোনো ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানানো হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের জানানো হয়নি। আমরা লোকমুখে শুনে মেডিকেলে গেছি।’

কেন পুলিশকে তাৎক্ষণিকভাবে জানানো হলো না? কেন ক্লোজড সার্কিট টিভি ক্যামেরায় (সিসিটিভি) ঘটনার দিন বিকেলের ১০ মিনিট ও পরের দিন সকালের ১৪ মিনিটের ফুটেজ নেই? ফুটেজের ধারাবাহিকতা না থাকায় রিপন নাথকে অমিতের কক্ষে ঢোকানোর এবং খুনের আলামত রক্তমাখা ইট ও কম্বল উধাও হওয়ার দৃশ্য দুটি পাওয়া যায়নি। বলা হচ্ছে বিদ্যুৎ–বিভ্রাটের কারণে এটা ঘটেছে। বিদ্যুতের কী তেলেসমাতি! বিভ্রাটের কী মোক্ষম সময়!

আগেই বলেছি, অমিতের মৃত্যু সামান্য সহানুভূতিও তৈরি করে না মানুষের মনে। কিন্তু অদৃশ্য সুতার টানে যারা অমিতদের নিয়ে পুতুলনাচের ইতিকথা তৈরি করে, আইনের হাত কি সেই ক্রীড়নকদের স্পর্শ করতে পারবে না কিছুতেই?

বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক