পড়াশোনা চালানোর অনেক পথ খোলা আছে

বসনিয়ার একটি বিদ্যালয়ে করোনার কারণে ক্লাস চলছে খোলা জায়গায়
ছবি: রয়টার্স

প্রায় দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলছে। লকডাউন শুরুর কিছুদিন পর অনলাইনে শিক্ষার কার্যক্রম সচল রাখার কথা বলা হলেও কার্যত কিছুদিনের মধ্যেই সেই ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়ে। তথ্যপ্রযুক্তির অপ্রতুলতাকেই অনেকে এর জন্য দায়ী করে থাকেন। তবে আমি এর সঙ্গে পুরোপুরি একমত নই। শিক্ষার্থীরা ফেসবুক চালাতে পারলে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় থাকতে পারলে, অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখায় সমস্যা কোথায়?

আমেরিকায় লকডাউন চলাকালে সব ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম অনলাইনভিত্তিক করে দেওয়া হয় এবং এখন তা পুরোপুরি সচল আছে। আগামী ফল সেমিস্টার থেকে শতভাগ ইন-পারসন ক্লাস শুরু হবে। অনেকেই বলতে পারেন, আমেরিকা উন্নত দেশ ও শিক্ষা খাতে প্রচুর বরাদ্দ থাকার কারণে তাদের পক্ষে সম্ভব হলেও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কথাটির সঙ্গেও আমি একমত হতে অপারগ।


ইনফ্রাস্ট্রাকচার বলতে আমরা রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট বুঝলেও সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে এটা হচ্ছে যোগাযোগের মহাসড়ক; ইন্টারনেটের সংযোগ এর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। শুধু সড়ক বা ব্রিজই উন্নয়নের চাবিকাঠি নয়, উপাত্তের যাতায়াতও অনেক সময় মানুষের যাতায়াতের চেয়ে কম গুরুত্ব বহন করে না। যা-ই হোক, বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার সরকারের যে কর্মপরিকল্পনা রয়েছে, সেখানে তথ্যপ্রযুক্তির অবকাঠামোর উন্নয়ন অপরিহার্য। ডিজিটালাইজেশন এখন পুরোনো শব্দ। মানুষ এখন অনলাইন সুপার হাইওয়ে চায়।

বাংলাদেশে সেলুলার ফোন কোম্পানিগুলোর যে নেটওয়ার্ক কভারেজ আছে, ওগুলো ব্যবহার করেও আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সচল রাখতে পারি। যদিও আমাদের একটা বিশাল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে ওই ব্যবস্থাও অপ্রতুল। আসলে আপনি কোনটাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন, তার ওপর নির্ভর করবে আপনি তাতে কত বাজেট রাখবেন। তেমনি সরকারের বেলায়ও একই কথা। বাজেটের আকার ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন, জাতির জন্য শিক্ষাটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতে জিডিপির ২.১০ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে। কিন্তু ইউনেসকো এডুকেশন ফ্রেমওয়ার্ক একটি দেশের জিডিপির সর্বনিম্ন ৪-৬ শতাংশ রাখার পরামর্শ দেয়।

অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা শিক্ষা খাতে যথাক্রমে জিডিপির ৩.৮, ৩.৭ ও ৩.৬ শতাংশ ব্যয় করে। উন্নত দেশের কথা না হয় বাদই দিলাম। তারপর আবার বরাবরের মতো শিক্ষা খাতের বরাদ্দ বাড়িয়ে দেখানোর জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এবং তথ্য ও যোগাযোগ বিভাগের বাজেট একত্র করে শিক্ষা খাতে দেখানো হয়েছে। এ থেকেই অনুমেয়, আমরা কোথায় আছি।

বেসরকারি গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ৫৯.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণে অংশই নিতে পারেনি। এই পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে উচ্চশিক্ষায় তথা বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে অনলাইন-ভিত্তিক শিক্ষার কার্যক্রম শিথিল বা বন্ধ করা অযৌক্তিক বলে আমার মনে হয়। প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের অনলাইনে লেখাপড়ায় যোগাযোগমাধ্যম ছাড়াও অভিভাবকদের সচেতনতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অপর দিকে মাধ্যমিক স্তরে ক্যারিয়ার-সচেতন না হওয়ার কারণে সেটাও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তুলনা করা সমীচীন হবে না। এই করোনার সময় তথ্যপ্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা তৈরি করে শিক্ষা কার্যক্রম, অন্তত উচ্চশিক্ষায় সচল রাখা গেলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কম ক্ষতির সম্মুখীন হতো।

এখন অনেকেই মহামারির অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের তাগিদ দিচ্ছেন। তথ্যপ্রযুক্তির হাইওয়ে উন্নয়ন, কম্পিউটারসহ যোগাযোগমাধ্যমের সহজপ্রাপ্যতা তৈরি করে এই সংস্কারের কাজে হাত দেওয়া যেতে পারে।

কৃষি ক্ষেত্রে যেমন ঋণের ব্যবস্থা করা হয়, তেমনি শিক্ষা ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ঋণের আওতায় আনা যেতে পারে। স্বল্প বা নামমাত্র সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে দূরশিক্ষণের সরঞ্জামাদি যেমন কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ক্ষেত্র বিশেষে মুঠোফোন কেনায় ঋণ দেওয়া যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে বিরাটসংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য ব্যাংক বা স্টেট গভর্নমেন্ট থেকে ঋণ নিয়ে পড়ালেখা শেষ করেন। চাকরিজীবনে এসে সরকার বা ব্যাংকগুলোকে কিস্তি আকারে পরিশোধ করে থাকে। আমরা অন্তত শিক্ষা উপকরণে এই ঋণের ব্যবস্থা করতে পারি। বাংলাদেশে শিক্ষা ঋণের ব্যবস্থা ব্যাংকগুলোর আছে বললেও তার বাস্তব বরাদ্দ আমরা তেমন একটা দেখতে পাই না।

ছিটেফোঁটা থাকলেও তা পাওয়ার সুযোগ সবার থাকে না। এই যোগাযোগ সরঞ্জামাদির আপডেট করে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সমতালে শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখা এখন সময়ের দাবি। অন্যথায় দেশ হীরক রাজার দেশে পরিণত হতে পারে।

এবার আসি শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিকায়ন, সফটওয়্যারের ব্যবহারে পারদর্শী করা ও তার সহজলভ্যতা তৈরি করার বিষয়ে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তা শুরু করা যেতে পারে। আস্তে আস্তে তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে।

লকডাউন চলাকালে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, কার্যকর শিক্ষণপদ্ধতি, ফলাফল প্রভৃতি নিয়ে অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম। ক্যানভাস, ব্ল্যাকবোর্ড, সক্রেটিভ, গুগল ক্লাসরুম, জুম, প্রভৃতি অ্যাপসের মাধ্যমে দূরশিক্ষণ কার্যক্রম খুব ভালোভাবেই পরিচালনা করা যায়। এখানে অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করা, প্রজেক্ট দেওয়া, শিক্ষার্থীদের স্ক্রিপ্ট মূল্যায়ন করা, মার্কিং করা, স্টুডেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রভৃতি কাজ অনেক সময় ইন-পারসন ক্লাসের চেয়ে আরও ভালো করা যায়।

ইন্টারনেট, টেলিভিশন, কমিউনিটি রেডিও কভারেজ ব্যবহার করে সরকার শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার চেষ্টা করলেও অনেক অদৃশ্য কারণে যেন সবকিছু বন্ধ হয়ে আছে। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। একদম সবকিছু বন্ধ করে দেওয়ার চেয়ে, শতভাগ পৌঁছাতে না পারলেও অনলাইন এডুকেশন সচল রাখা উচিত। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করে, অতি দ্রুত কীভাবে তাদের এই শিক্ষার আওতায় আনা যায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু তাদের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না বলে যাদের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে, তাদের বঞ্চিত করার তো কোনো যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে না। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে কতটা কভারেজ রয়েছে, তা জানা থাকলেও উচ্চশিক্ষা তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের কভারেজ কতটা আছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হলগুলো খুলে দেওয়া সম্ভব হলে এই শিক্ষা কার্যক্রম শতভাগ পরিচালনা সম্ভব বলে অনেকেই মনে করেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে হলগুলো খোলা কতটা সম্ভব, তা পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে বলে আমার মনে হয়। চল্লিশোর্ধ্ব বয়সের মানুষ এই মহামারিতে সবচেয়ে ঝুঁকিতে। আমাদের শিক্ষার্থীদের বয়স ১৮ থেকে ২৫-এর মধ্যে, এটা একটা আশার দিক। অন্যদিকে হলগুলোর কমন স্পেসগুলো বন্ধ করে, হাইজিন মেনটেইন করে অন্য অফিস-আদালত যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালিয়ে যাচ্ছে, সেভাবে করা যায় কি না, তা ভেবে দেখা যেতে পারে। আসলে হলগুলো রেসিডেনসিয়াল ইউনিভার্সিটির একেকটা শিক্ষা ইউনিট। এই মহামারিতে বিদেশের স্টুডেন্ট হাউজিংগুলো যেভাবে চলছে, সেগুলো থেকে লার্নিং নিয়ে এই শিক্ষা ইউনিটগুলো ঢেলে সাজানো যেতে পারে।

১০০ বছর আগের একই পরিস্থিতির মুখে আজকের বিশ্ব। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যক্ষ্মায় ইউরোপ আর আমেরিকায় মারা যেত প্রতি সাত জনে একজন। যক্ষ্মার প্রতিরোধক টিকা আবিষ্কার হয় ১৯২১ সালে, সেই টিকা পৌঁছাতে সময় লেগে যায় আরও বেশ কিছু বছর। ওই পরিস্থিতিতে বাচ্চারা যাতে স্কুলে যেতে পারে, তার সমাধান হিসেবে জন্ম নেয় খোলা মাঠে স্কুলব্যবস্থা। এই আইডিয়া প্রথম চালু হয় জার্মানি আর বেলজিয়ামে ১৯০৪ সালে। আমেরিকায় খোলা মাঠে শিক্ষাদান শুরু হয় ১৯০৭ সালে। নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, সে বছর রোড আইল্যান্ডের দুজন চিকিৎসক প্রস্তাব দেন, শহরের খোলা জায়গাগুলোতে স্কুল বসাতে। পরবর্তী সময়ে উঁচু ভবনের ছাদে, খোলা চত্বরে এমনকি পরিত্যক্ত জায়গায় এই স্কুলিং পরিচালিত হতো।

ভারতশাসিত কাশ্মীরে উন্মুক্ত স্থানে পাঠদান ইতিমধ্যেই একটা সমাধান হিসেবে চালু হয়ে গেছে। সিঙ্গাপুরে বহু বছর ধরেই খোলা আকাশের নিচে লেখাপড়া শেখানোর চল রয়েছে। দেশটি শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্ত করে তোলার জন্য খোলা জায়গায় পাঠদানে সাফল্য পেয়েছে। ফিনল্যান্ডে জঙ্গলে স্কুল বেশ জনপ্রিয়। ডেনমার্কেও উন্মুক্ত স্থানে বিশেষ দিনে ক্লাস করার প্রথা চালু রয়েছে। বহু শিক্ষক ও স্কুল নিয়মিত এই বিশেষ দিনে বাইরে স্কুল শিক্ষার আয়োজন করেন। ডেনমার্কে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কোভিড-১৯-এর মধ্যে এই সংস্কৃতিকে আরও উৎসাহিত করেছে।
১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বোলপুরে শান্তিনিকেতনে উন্মুক্ত পরিবেশে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, লক্ষ্য ছিল প্রকৃতির সাহচর্যে আদর্শ প্রাকৃতিক পরিবেশে শিশুদের শিক্ষাদান। এমনকি শহরেও এ ধরনের স্কুলের কথা ভাবা যেতে পারে। এ ধরনের স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য পার্ক ও জনসাধারণের জন্য খোলা জায়গা কীভাবে বাড়ানো যায়, সেটাও ভাবা উচিত।

মো. কামরুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস এ অ্যান্ড এম ইউনিভার্সিটিতে গবেষণারত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।